যানজটে বিপর্যস্ত রাজধানীবাসীর কাছে ‘ভিআইপি’ নামের মুভমেন্ট একটি বড় বিরক্তি ও ক্ষোভের কারণ। কখনো অন্য গাড়িকে থামিয়ে রেখে সাইরেন বা পুলিশের হুইসেল বাজিয়ে চলে যায় গাড়ি। কখনো বা রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে গাড়ি চলতে দেখে নিজে নিজে চিৎকার করে ক্ষোভ ঝাড়েন নাগরিকেরা। আবার কারো বা চুপ করে দেখা ছাড়া উপায় থাকে না। সাইরেন বাজিয়ে রাস্তা ফাঁকা করে, আগে যাওয়ার জন্য অন্য গাড়িকে থামিয়ে নিজে চলে যাওয়া কিংবা রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে চলে যাওয়া দেখাতে এখন যেন অনেকটাই অভ্যস্ত নগরবাসী।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ১ নম্বর ফেরিঘাটে ভিআইপি প্রটোকল দেওয়ার নামে একজন যুগ্ম সচিবের অপেক্ষায় প্রায় তিন ঘণ্টা ফেরি না ছাড়ায়, অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যু হয়। এই ঘটনা এখনো অনেকের ভোলার কথা নয়।
ফেসবুকে মো. কামরুজ্জামান নামক একটি আইডি থেকে ভিআইপি প্রটোকলের কারণে মুমূর্ষু একজন রোগীসহ অ্যাস্বুলেন্স আটকে রাখার একটি ভিডিও পোস্ট করে লেখা হয়, “ভিআইপি মুভমেন্টের জন্য রোগীসহ অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখলো ৩০ মিনিট। রোগীর পরিবার ও পথচারীদের অনুরোধেও কোনো কাজ হয়নি।” ফেসবুকে পোস্টটি ভাইরাল হয়।
রেলমন্ত্রীর ‘আত্মীয়’ পরিচয় দিয়ে বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের সময় তিন যাত্রীকে জরিমানা করার পর ট্রেনের টিটিইকে বরখাস্ত করার ঘটনাটিও অন্যতম আলোচিত ঘটনা।
আবার তথাকথিত ভিআইপি ছাড়াও তাদের আত্মীয়-পরিজনের গাড়িও সড়কে এক ধরনের মূর্তিমান আতংক। এসব থামানোর দায়িত্ব যাদের তারাও যেন অনেকটা অসহায়। রাজধানীর বাইরে জেলা, উপজেলা শহর, বিমানবন্দর, ফেরিঘাট, লঞ্চঘাট, বাস টার্মিনাল কোথায় নেই তাদের দাপট!
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার জানান, “বাংলাদেশের কোনো সড়কেই কোনো ভিআইপি’র জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা থাকার কথা নয়। বিধি অনুযায়ী, তাদের জন্য নিরাপত্তা প্রটোকল থাকবে। কিন্তু তাদের চলাচলের জন্য কোনো সড়ক বন্ধ বা অন্য কোনো যানবাহনের চলাচল বাধাগ্রস্ত করা যাবেনা। তারা কোনো অগ্রাধিকারও পাবেন না। উল্টোপথে চলা বা অন্য গাড়ি সরিয়ে চলাচলের সুযোগ নেই কোনো ভিআইপির।”
সাবেক এই আমলা বলেন, “সড়কে যারা নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে, তারা কেউ জনপ্রতিনিধি, আবার সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বা বাহিনীর বড় কর্তা। এছাড়াও সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ীরাও প্রটোকল নেওয়ার নামে বিশৃঙ্খলা তৈরিতে পিছিয়ে নেই।”
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাষ্ট্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হলেন ভিভিআইপি (ভেরি ভেরি ইম্পর্টেন্ট পার্সন)। এর পরের ধাপে আছেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা, যাদের বলা হয় ভিআইপি (ভেরি ইম্পর্টেন্ট পার্সন)। আর ব্যবসা-বাণিজ্যে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাদের বলা হয় ‘কমার্শিয়ালি ইম্পর্টেন্ট পার্সন’ (সিআইপি)।
প্রথম দুই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় বিবেচনায় নির্ধারিত হন। আর সিআইপি ঠিক করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, যেসব ব্যক্তি অবস্থান, দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক দিয়ে বিশেষ গুরুত্ব বহন করেন এবং যাদের নিরাপত্তাহানি হলে দেশ ও জাতি গভীর সংকটে পতিত হয় তাদের ভিভিআইপি এবং ভিআইপি বলা হয়। বাংলাদেশের আইন অনুসারে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান ভিভিআইপি মর্যাদা ও নিরাপত্তা ভোগ করেন। তাছাড়া জাতির জনকের পরিবারের সদস্যদের বিশেষ নিরাপত্তা বিধানের আইন আছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভিভিআইপি। আর ভিআইপি হলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, সংসদ সদস্য, সিনিয়র সচিব, সচিব, তিন বাহিনী প্রধান, পুলিশের প্রধান। তবে সরকার প্রয়োজন অনুয়ায়ী অন্য কাউকে ভিআইপি মর্যাদা দিতে পারেন৷। বাংলাদেশের কোনো সড়কেই কোনো ভিআইপি’র জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থাপনা নেই। বিধি অনুযায়ী তাদের জন্য নিরাপত্তা প্রটোকল থাকবে৷ কিন্তু তাদের চলাচলের জন্য কোনো সড়ক বন্ধ বা অন্য কোনো যানবাহনের চলাচল বাধাগ্রস্ত করা যাবেনা। তারা কোনো অগ্রাধিকারও পাবেন না। উল্টো পথে চলা বা অন্য গাড়ি সরিয়ে চলাচলের সুযোগ নেই কোনো ভিআইপির।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, “নিরাপত্তা প্রটোকলের রেডবুক আছে। আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া চলাচলের সময় রাস্তার একপাশ ফাঁকা করে নিরাপত্তা দেওয়ার বিধান আর কারো ক্ষেত্রে নেই। আর বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথিদের বেলায় সরকার কেস টু কেস সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা তা অনুসরণ করি। কোনো বাংলাদেশি ভিআইপি এই সুবিধা পান না। তারা সাধারণ নিয়মেই চলাচল করবেন।”
প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি যখন সড়কে চলাচল করে, সেটি নিয়ে কিন্তু কোনো মাথাব্যথা নেই সাধারণ পথচারীদের। তারা মনে করেন, নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধায় এটা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যখন তথাকথিত ভিআইপিরা প্রোটোকল নেওয়ার নামে ব্যক্তিগত গাড়ির সাইরেন বাজিয়ে রাস্তার একপাশ খালি করে চলাচল করেন, তখনই ভোগান্তিটা চরমে পৌঁছে এবং ক্ষুব্ধ হন সাধারণ মানুষ।
সড়কে ভিআইপি প্রটোকল দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। তারাও একরকম অসহায় হয়েই এসব প্রটোকল দিতে বাধ্য হন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্যও করতে চায়নি পুলিশ বিভাগ।
তবে কয়েক বছর আগে রাজধানীতে দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সড়কে নেমে পুলিশকে সাথে নিয়ে উল্টোপথে আসা গাড়ি আটকেছিলেন কয়েকদিন। পুলিশও তখন বেশ তৎপর হয়ে অনেক গাড়ি আটক ও জরিমানা করে। এরপর বেশ কিছুদিন সড়কে ওই ধরণের নৈরাজ্য বন্ধ ছিল। তারপর আবারও একই অবস্থা।
২০১৯ সালের মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ির ওই ঘটনা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ালে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিভিআইপি) বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
তথাকথিত ভিআইপির নামে সড়কে ইচ্ছামতো চলাফেরা দেশের কোনো আইন সমর্থন করেনা বলে উল্লেখ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়াও।
এই আইনজীবী বলেন, ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশের ১০৬(২) (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ফায়ার সার্ভিসের যানবাহন, অ্যাম্বুলেন্স এবং অন্যান্য বিশেষ শ্রেণির গাড়ি চলাচলে অগ্রাধিকারের জন্য শর্তসাপেক্ষে বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারে সরকার।
কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিধিমালা প্রণয়ন হয়নি। এ ছাড়া পরিপত্র জারি করে অ্যাম্বুলেন্স চলাচলে অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা যায়। সিটি করপোরেশন আইনেও এ রকম উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। দেশে সড়কগুলোর অবস্থা নাজুক।
সরকারের যেকোনো ধরনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মন্ত্রী, পুলিশের ঊর্ধ্বতন সহ নানা ব্যক্তিকে প্রটোকল দেওয়ার নামে সড়কে সকল ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে তাদের যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করা এখন একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে করে হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে।
ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “সরকারের সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি।” পুলিশকেও আরো কঠোর হওয়ার দাবি জানান এই আইনজীবী।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, ভিআইপি সংস্কৃতির কারণে সড়কে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সীমাহীন পর্যায়ে চলে গেছে।
তিনি বলেন, “ক্ষমতার এ ধরনের সীমাহীন অপব্যবহার কোনোভাবেই একটা গণতান্ত্রিক দেশে হতে পারে না। ভিআইপিদের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা চিহ্নিত থাকতে হবে যে কোন কোন সুযোগ-সুবিধা তারা পাবেন আর কোনটা পাবেন না।”
“বাংলাদেশে ভিআইপিদের জন্য সুবিধার সীমারেখা রয়েছে। যারা ভিআইপি তাদের কার্যালয় নির্ধারিত, তাদের চেয়ার নির্ধারিত, তাদের গাড়িটা নির্ধারিত, তাদের বাড়ি নির্ধারিত। এই ধরনের সুযোগ-সুবিধা তাদের থাকবে,” বলেন তিনি।
তবে জনগণের ব্যবহারযোগ্য যে সুযোগ-সুবিধা যেমন রাস্তাঘাট, তা তারা দখল করে নেবেন বা বন্ধ করে দেবেন, এটি কোনো ভিআইপি আচরণ হতে পারে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তার মতে, “ভিআইপি হতে গেলে ভিআইপি সত্ত্বা অর্জন করতে হয়। সেটা জোর করে আদায় করা যায় না। মানুষকে বিপদে ফেলে জিম্মি করে ভিআইপি সুবিধা ভোগ করা কোন অবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”