ঢাকা ০২:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যা ঘটেছিল জবি শিক্ষার্থী অবন্তিকার সঙ্গে

প্রাণোচ্ছল, প্রতিবাদী এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধে সোচ্চার ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী অবন্তিকা। হঠাৎই সাঙ্গ হলো সব। ফেসবুক স্ট্যাটাসে এক সহপাঠী ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। শুক্রবার (১৫ মার্চ) রাতে নিজ বাড়িতে আত্মহত্যার পর আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। অবন্তীকা মৃত্যুর আগে ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন সেখানে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী হিসেবে সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহাকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু স্ট্যাটাসে তার সঙ্গে কী ঘটেছিল তার পরিষ্কার কিছু লিখেননি। অবন্তীকার মৃত্যুর পর এই প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে যে কী এমন ঘটেছিল তার সঙ্গে যে কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

শুক্রবার অবন্তীকা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসের এক অংশে লেখেন- আমার ওপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এত ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে।

আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইছিলাম। এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার। পোস্টের শুরুতে তিনি লেখেন- আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। ফেসবুকে এই পোস্ট দেবার পর আত্মহত্যার পথ বেছে নেন আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের এই শিক্ষার্থী।

গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে ‘কনসার্ট ফর জহির’ নামে একটি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন অবন্তীকা। সেখানে আত্মহত্যা প্রতিরোধে নানা সচেতনামূলক কথা বলেন তিনি। এরপর তিনি ছিলেন নিজ বাড়ি কুমিল্লায়। এর আগে ১৯শে ফেব্রুয়ারি অবন্তীকাদের ব্যাচের একটি ব্যক্তিগত ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে দেখা যায়, আম্মান অবন্তীকাকে শাসিয়ে ম্যাসেজে লিখছেন- ফারদার এই ধরনের টেক্সট এই জাতীয় গ্রুপে আসলে ভালো হবে না। মেডেল গলায় ঝুলিয়ে দিবোনি। এর রিপ্লেতে অবন্তীকা লেখেন- কিছু বাদ রাখচো নাকি থ্রেট দিচ্ছো যে? রিপ্লেতে আম্মান লেখেন- এখন পর্যন্ত খুব সসম্মানে আছিস। এখান থেকে বের হয়ে যা। গায়ে পাড়া দিয়ে কোনো কিছু খাড়া করলে গাড়া মুরদা তুলে কাউকে ধুতে সময় বেশি নিবোনা।

অবন্তীকার সহপাঠীরা জানান, নানানভাবে অবন্তীকাকে থ্রেট করে আসছিল আম্মান। অবন্তীকার বাবা মারা গেছেন। এনিয়েও বেশ মানসিক চাপে ছিলেন। একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা পাননি অবন্তীকা। তাদের দাবি উল্টা অবন্তীকেই পড়তে হয়েছে হয়রানির মুখে। ফেসবুক স্ট্যাটাসে অবন্তীকা এই বিষয়ে লেখেন- আম্মান আমাকে সেক্সুয়ালি এবিউজ কমেন্ট করায় আমি তার প্রতিবাদ করলে আমাকে দেখে নেয়ার জন্য দ্বীন ইসলামের শরণাপন্ন করায়। এরপর তিনি লেখেন- দ্বীন ইসলাম আমাকে প্রক্টর অফিসে ডেকে নারী জাতীয় গালিগালাজ করে। তিনি উল্লেখ করেন তাকে ৭ বার প্রক্টর অফিসে ডাকা হয়। আরেক অংশে অবন্তীকা বলেন- দ্বীন ইসলাম তাকে ডেকে নিয়ে … তুই এই ছেলেরে থাপড়াবি বলসোস কোনো?

অবন্তীকার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বলেন, ও খুবই শক্ত মনমানসিকতার মেয়ে ছিল। ও নানাভাবে করা অপমান সে সহ্য করতে পারে নাই। শুধু অবন্তীকা নয় এর আগে আরও একটি মেয়ে আম্মানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিল সেখানেও প্রতিকার মেলেনি। তিনি বলেন, একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে আম্মানের সঙ্গে শত্রুতা হয় অবন্তীকার। সে আমরা মিউচুয়ালি মিটিয়ে নেই। কিন্তু এরপর থেকে আম্মান পিছু নেয়। অবন্তীকার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টা করে। এটাতে ব্যর্থ হবার পর সে নানাভাবে ডিস্টার্ব করতে থাকে।

সহপাঠীদের দাবি, আম্মানের সঙ্গে অবন্তীকার প্রথম বিবাদ বাধে দুই বছর আগে। শুক্রবার রাতে অভিযুক্ত আম্মান এক ফেসবুক পোস্টে তা খোলাসা করেন। এতে বলা হয়, ২০২২ সালে একটি ফেইক আইডি থেকে আমাদের ১৪ জন শিক্ষার্থীর নামে গুজব ছড়ানো হয়। এতে অবন্তীকার নামও ছিল। এরপর আমি সবাইকে নিয়ে কোতোয়ালি থানায় যাই। সেখানে অবন্তীকা নিজেও উপস্থিত থেকে থানায় জিডি করেন। এরপর অবন্তীকা ভুল স্বীকার করলে আমরা মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করেন।

অবন্তীকার এক বান্ধবী বলেন, এই ঘটনার পর থেকেই উত্ত্যক্ত করা শুরু করে আম্মান। মানসিক যন্ত্রণা দিতে থাকে। ও একাধিকবার প্রক্টোরিয়াল অফিসে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা পায়নি। দ্বীন ইসলাম স্যার তাকে ইগনোর করে কুরুচিপূর্ণ কথাও নাকি বলেছিল। অবন্তীকা খুব শক্ত মনমানসিকতার মেয়ে ছিল। মনের কষ্ট অন্যকে বুঝতে দিতো না। একদিন আংকেল আন্টিকে ক্যাম্পাসে দেখি। এরপর প্রশ্ন করলে জানায়, আব্বু-আম্মুকে এনেও লাভ হলো না। আম্মান ওকে অনলাইনে হেয় করে কথা বলতো, থ্রেট দিতো, বাজে ভাষায় কথা বলতো। আবার ডিবেটিং ক্লাবে সকলের সামনে নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করতো। তার পরিচিতজনদের মধ্য দিয়ে ইউটিজিং করতো।

ডিবেটিং সোসাইটির এক সদস্য বলেন, আম্মান একরোখা স্বভাবের ছেলে। তার নেতৃত্ব গুণ থাকলেও মেয়েদের সম্মান দেবার মতো মানসিকতা ছিল না। ছাত্র রাজনীতি করা একাধিক বন্ধুদের সঙ্গে মিশতো। তাই আমাদের হেয় করে কথা বলতো। কিন্তু অবন্তীকা আপুর সঙ্গে বাজে আচরণ করতো। এগুলো আমরা দেখেও কিছু বলতে পারিনি। এই ছাত্রী বলেন, ভার্সিটির নিপীড়ক বিরোধী সেল অচল। এই সেল যদি সচল থাকতো অবন্তীকা আপু যদি সুষ্ঠু বিচার পেতেন তাহলে আজ আমাদের মাঝ থেকে আপু চলে যেতেন না।

ওদিকে অবন্তীকার মৃত্যুর পর থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। তারা সুষ্ঠু বিচার দাবির পাশাপাশি অভিযুক্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কার দাবি করেন। এসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ৬টি দাবি জানান। শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাবি উত্থাপন করেন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রেজওয়ান হক। দাবিগুলো হলো- হত্যার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে, অভিযুক্ত আম্মান সিদ্দিকী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে, জরুরি সিন্ডিকেট আহ্বান করে অভিযুক্তদের স্থায়ী বহিষ্কার করতে হবে, ভিকটিমের পরিবারকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বাদী হয়ে মামলা করতে হবে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেল কার্যকর করতে হবে।

এই ঘটনার বিষয়ে অভিযুক্ত দ্বীন ইসলাম ফেসবুকে একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, প্রথমত আমি একজন মানুষ, দ্বিতীয়ত আমি একজন শিক্ষক, তৃতীয়ত আমি দুইজন কন্যাসন্তানের বাবা। তিনি ফেক আইডির বিষয়ে জিডির বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, অবন্তীকার মা আমাকে জানান হলের বন্ধুরা ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে না এতে অবন্তীকা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। তখন আমি তাদেরকে প্রক্টর অফিসে লিখিতভাবে অভিযোগ করার পরামর্শ দেই। তখন অবন্তীকার মা বলে যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন আর এ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছি না এবং বলেন আমি আমার মেয়েকে হলে রাখবো না, এতে করে তার পড়াশোনা খারাপ হয়ে যাবে এবং সে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়বে। তখন আমি তাকে বলি আপনি অভিভাবক যা ভালো মনে করেন সেটাই করেন।

তিনি বলেন, সুইসাইড নোটে প্রক্টর অফিসে আম্মানের বিরুদ্ধে আনীত যৌন হয়রানি ও ভয়ভীতির অভিযোগের বিচার না পাওয়ার বিষয়টি তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল স্যার ভালো বলতে পারবেন। এ সম্পর্কে আমি অবগত নই।

অবন্তীকার এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তা জানিয়ে সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল বলেন, একটা অভিযোগ অবন্তীকা নভেম্বর মাসে দিয়েছিল। পরে তাকে ডাকা হলে সে আর যোগাযোগ করেনি। তাই এ বিষয়ে পরবর্তীতে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

অবন্তীকার অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা না নেয়াই সাবেক প্রক্টরকে দুষছেন অবন্তীকার বন্ধুরা। তাদের দাবি অবন্তীকার শেষ অভিযোগ আমলে নিলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতো না। অবন্তীকার বান্ধবী তাবাস্‌সুম প্রাপ্তি ফেসবুকে লেখেন- কিছু পোস্ট দেখে আমার মনে হয়েছিল মেয়েটা ভালো নেই। সে আমার কাছে আর্তনাদ করে বলতো, ওরা আটজন এমনভাবে আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলেছে, প্রত্যেকটা মানুষ এর কাছে গিয়ে গিয়ে আমি কয়জনকে প্রমাণ করবো? কেউ আমার কথা শুনবে?

এই এ সকল কারণে অবন্তীকার ক্যাম্পাস জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে বলে জানান অবন্তীকার মা। তিনি বলেন, কয়েকজন সহপাঠীর মানসিক উৎপীড়নের কারণেই মেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। আমি কীভাবে বেঁচে থাকবো আর? অবন্তীকার সহপাঠীদের নাম উল্লেখ করে তার মা বলেন, আম্মান, রাফি, মাহিয়ান, লাকি, রিমি, আখি, ও বন্যা আমার মেয়েকে মানসিক টর্চার করতো। আমি সুষ্ঠু বিচার চাই। দ্বীন ইসলামের বিচার চাই।

এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ঘটনাটি অনেক পুরনো হওয়ায় এটি জানা ছিল না এবং সাম্প্রতিককালে অবন্তীকা এমন কোনো অভিযোগও করেনি। তারপরেও পুরনো ফাইল দেখে মনে হচ্ছে যে মানসিক চাপটা সে নিতে পারেনি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

এ ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্রদল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। এই ঘটনায় পরপরই আম্মানকে সাময়িক বহিষ্কার ও দ্বীন ইসলামকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একইসঙ্গে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এ ঘটনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত অনুযায়ী ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হবে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটামের মধ্যে গতকাল রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আম্মান ও শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে।

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

যা ঘটেছিল জবি শিক্ষার্থী অবন্তিকার সঙ্গে

আপডেট সময় ১২:৫৮:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ মার্চ ২০২৪

প্রাণোচ্ছল, প্রতিবাদী এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধে সোচ্চার ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী অবন্তিকা। হঠাৎই সাঙ্গ হলো সব। ফেসবুক স্ট্যাটাসে এক সহপাঠী ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। শুক্রবার (১৫ মার্চ) রাতে নিজ বাড়িতে আত্মহত্যার পর আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। অবন্তীকা মৃত্যুর আগে ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন সেখানে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী হিসেবে সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহাকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু স্ট্যাটাসে তার সঙ্গে কী ঘটেছিল তার পরিষ্কার কিছু লিখেননি। অবন্তীকার মৃত্যুর পর এই প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে যে কী এমন ঘটেছিল তার সঙ্গে যে কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

শুক্রবার অবন্তীকা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসের এক অংশে লেখেন- আমার ওপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এত ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে।

আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইছিলাম। এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার। পোস্টের শুরুতে তিনি লেখেন- আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। ফেসবুকে এই পোস্ট দেবার পর আত্মহত্যার পথ বেছে নেন আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের এই শিক্ষার্থী।

গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে ‘কনসার্ট ফর জহির’ নামে একটি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন অবন্তীকা। সেখানে আত্মহত্যা প্রতিরোধে নানা সচেতনামূলক কথা বলেন তিনি। এরপর তিনি ছিলেন নিজ বাড়ি কুমিল্লায়। এর আগে ১৯শে ফেব্রুয়ারি অবন্তীকাদের ব্যাচের একটি ব্যক্তিগত ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে দেখা যায়, আম্মান অবন্তীকাকে শাসিয়ে ম্যাসেজে লিখছেন- ফারদার এই ধরনের টেক্সট এই জাতীয় গ্রুপে আসলে ভালো হবে না। মেডেল গলায় ঝুলিয়ে দিবোনি। এর রিপ্লেতে অবন্তীকা লেখেন- কিছু বাদ রাখচো নাকি থ্রেট দিচ্ছো যে? রিপ্লেতে আম্মান লেখেন- এখন পর্যন্ত খুব সসম্মানে আছিস। এখান থেকে বের হয়ে যা। গায়ে পাড়া দিয়ে কোনো কিছু খাড়া করলে গাড়া মুরদা তুলে কাউকে ধুতে সময় বেশি নিবোনা।

অবন্তীকার সহপাঠীরা জানান, নানানভাবে অবন্তীকাকে থ্রেট করে আসছিল আম্মান। অবন্তীকার বাবা মারা গেছেন। এনিয়েও বেশ মানসিক চাপে ছিলেন। একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা পাননি অবন্তীকা। তাদের দাবি উল্টা অবন্তীকেই পড়তে হয়েছে হয়রানির মুখে। ফেসবুক স্ট্যাটাসে অবন্তীকা এই বিষয়ে লেখেন- আম্মান আমাকে সেক্সুয়ালি এবিউজ কমেন্ট করায় আমি তার প্রতিবাদ করলে আমাকে দেখে নেয়ার জন্য দ্বীন ইসলামের শরণাপন্ন করায়। এরপর তিনি লেখেন- দ্বীন ইসলাম আমাকে প্রক্টর অফিসে ডেকে নারী জাতীয় গালিগালাজ করে। তিনি উল্লেখ করেন তাকে ৭ বার প্রক্টর অফিসে ডাকা হয়। আরেক অংশে অবন্তীকা বলেন- দ্বীন ইসলাম তাকে ডেকে নিয়ে … তুই এই ছেলেরে থাপড়াবি বলসোস কোনো?

অবন্তীকার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বলেন, ও খুবই শক্ত মনমানসিকতার মেয়ে ছিল। ও নানাভাবে করা অপমান সে সহ্য করতে পারে নাই। শুধু অবন্তীকা নয় এর আগে আরও একটি মেয়ে আম্মানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিল সেখানেও প্রতিকার মেলেনি। তিনি বলেন, একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে আম্মানের সঙ্গে শত্রুতা হয় অবন্তীকার। সে আমরা মিউচুয়ালি মিটিয়ে নেই। কিন্তু এরপর থেকে আম্মান পিছু নেয়। অবন্তীকার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টা করে। এটাতে ব্যর্থ হবার পর সে নানাভাবে ডিস্টার্ব করতে থাকে।

সহপাঠীদের দাবি, আম্মানের সঙ্গে অবন্তীকার প্রথম বিবাদ বাধে দুই বছর আগে। শুক্রবার রাতে অভিযুক্ত আম্মান এক ফেসবুক পোস্টে তা খোলাসা করেন। এতে বলা হয়, ২০২২ সালে একটি ফেইক আইডি থেকে আমাদের ১৪ জন শিক্ষার্থীর নামে গুজব ছড়ানো হয়। এতে অবন্তীকার নামও ছিল। এরপর আমি সবাইকে নিয়ে কোতোয়ালি থানায় যাই। সেখানে অবন্তীকা নিজেও উপস্থিত থেকে থানায় জিডি করেন। এরপর অবন্তীকা ভুল স্বীকার করলে আমরা মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করেন।

অবন্তীকার এক বান্ধবী বলেন, এই ঘটনার পর থেকেই উত্ত্যক্ত করা শুরু করে আম্মান। মানসিক যন্ত্রণা দিতে থাকে। ও একাধিকবার প্রক্টোরিয়াল অফিসে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা পায়নি। দ্বীন ইসলাম স্যার তাকে ইগনোর করে কুরুচিপূর্ণ কথাও নাকি বলেছিল। অবন্তীকা খুব শক্ত মনমানসিকতার মেয়ে ছিল। মনের কষ্ট অন্যকে বুঝতে দিতো না। একদিন আংকেল আন্টিকে ক্যাম্পাসে দেখি। এরপর প্রশ্ন করলে জানায়, আব্বু-আম্মুকে এনেও লাভ হলো না। আম্মান ওকে অনলাইনে হেয় করে কথা বলতো, থ্রেট দিতো, বাজে ভাষায় কথা বলতো। আবার ডিবেটিং ক্লাবে সকলের সামনে নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করতো। তার পরিচিতজনদের মধ্য দিয়ে ইউটিজিং করতো।

ডিবেটিং সোসাইটির এক সদস্য বলেন, আম্মান একরোখা স্বভাবের ছেলে। তার নেতৃত্ব গুণ থাকলেও মেয়েদের সম্মান দেবার মতো মানসিকতা ছিল না। ছাত্র রাজনীতি করা একাধিক বন্ধুদের সঙ্গে মিশতো। তাই আমাদের হেয় করে কথা বলতো। কিন্তু অবন্তীকা আপুর সঙ্গে বাজে আচরণ করতো। এগুলো আমরা দেখেও কিছু বলতে পারিনি। এই ছাত্রী বলেন, ভার্সিটির নিপীড়ক বিরোধী সেল অচল। এই সেল যদি সচল থাকতো অবন্তীকা আপু যদি সুষ্ঠু বিচার পেতেন তাহলে আজ আমাদের মাঝ থেকে আপু চলে যেতেন না।

ওদিকে অবন্তীকার মৃত্যুর পর থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। তারা সুষ্ঠু বিচার দাবির পাশাপাশি অভিযুক্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কার দাবি করেন। এসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ৬টি দাবি জানান। শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাবি উত্থাপন করেন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রেজওয়ান হক। দাবিগুলো হলো- হত্যার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে, অভিযুক্ত আম্মান সিদ্দিকী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে, জরুরি সিন্ডিকেট আহ্বান করে অভিযুক্তদের স্থায়ী বহিষ্কার করতে হবে, ভিকটিমের পরিবারকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বাদী হয়ে মামলা করতে হবে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেল কার্যকর করতে হবে।

এই ঘটনার বিষয়ে অভিযুক্ত দ্বীন ইসলাম ফেসবুকে একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, প্রথমত আমি একজন মানুষ, দ্বিতীয়ত আমি একজন শিক্ষক, তৃতীয়ত আমি দুইজন কন্যাসন্তানের বাবা। তিনি ফেক আইডির বিষয়ে জিডির বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, অবন্তীকার মা আমাকে জানান হলের বন্ধুরা ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে না এতে অবন্তীকা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। তখন আমি তাদেরকে প্রক্টর অফিসে লিখিতভাবে অভিযোগ করার পরামর্শ দেই। তখন অবন্তীকার মা বলে যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন আর এ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছি না এবং বলেন আমি আমার মেয়েকে হলে রাখবো না, এতে করে তার পড়াশোনা খারাপ হয়ে যাবে এবং সে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়বে। তখন আমি তাকে বলি আপনি অভিভাবক যা ভালো মনে করেন সেটাই করেন।

তিনি বলেন, সুইসাইড নোটে প্রক্টর অফিসে আম্মানের বিরুদ্ধে আনীত যৌন হয়রানি ও ভয়ভীতির অভিযোগের বিচার না পাওয়ার বিষয়টি তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল স্যার ভালো বলতে পারবেন। এ সম্পর্কে আমি অবগত নই।

অবন্তীকার এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তা জানিয়ে সাবেক প্রক্টর অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল বলেন, একটা অভিযোগ অবন্তীকা নভেম্বর মাসে দিয়েছিল। পরে তাকে ডাকা হলে সে আর যোগাযোগ করেনি। তাই এ বিষয়ে পরবর্তীতে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

অবন্তীকার অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা না নেয়াই সাবেক প্রক্টরকে দুষছেন অবন্তীকার বন্ধুরা। তাদের দাবি অবন্তীকার শেষ অভিযোগ আমলে নিলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতো না। অবন্তীকার বান্ধবী তাবাস্‌সুম প্রাপ্তি ফেসবুকে লেখেন- কিছু পোস্ট দেখে আমার মনে হয়েছিল মেয়েটা ভালো নেই। সে আমার কাছে আর্তনাদ করে বলতো, ওরা আটজন এমনভাবে আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলেছে, প্রত্যেকটা মানুষ এর কাছে গিয়ে গিয়ে আমি কয়জনকে প্রমাণ করবো? কেউ আমার কথা শুনবে?

এই এ সকল কারণে অবন্তীকার ক্যাম্পাস জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে বলে জানান অবন্তীকার মা। তিনি বলেন, কয়েকজন সহপাঠীর মানসিক উৎপীড়নের কারণেই মেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। আমি কীভাবে বেঁচে থাকবো আর? অবন্তীকার সহপাঠীদের নাম উল্লেখ করে তার মা বলেন, আম্মান, রাফি, মাহিয়ান, লাকি, রিমি, আখি, ও বন্যা আমার মেয়েকে মানসিক টর্চার করতো। আমি সুষ্ঠু বিচার চাই। দ্বীন ইসলামের বিচার চাই।

এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ঘটনাটি অনেক পুরনো হওয়ায় এটি জানা ছিল না এবং সাম্প্রতিককালে অবন্তীকা এমন কোনো অভিযোগও করেনি। তারপরেও পুরনো ফাইল দেখে মনে হচ্ছে যে মানসিক চাপটা সে নিতে পারেনি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

এ ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্রদল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। এই ঘটনায় পরপরই আম্মানকে সাময়িক বহিষ্কার ও দ্বীন ইসলামকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একইসঙ্গে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এ ঘটনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত অনুযায়ী ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হবে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটামের মধ্যে গতকাল রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আম্মান ও শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে।