রাজনীতিকে অর্থবহ করে তুলতে জনগণের সেবাকে প্রাধান্য দিতে হবে। জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক দল হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়ার মাধ্যমও হলো জনসেবা। আর যদি রাজনীতির মাঠের কথিত ‘নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা’ উদ্দেশ্য থাকে, তখন পেশিশক্তির প্রয়োগ শুরু হয়। আর এটিই রাজনীতিকে দূষিত করে। যা বিগত সময়ে দেখে আসছে বাংলাদেশের মানুষ। শুধু তাই নয় এসবের মাধ্যমে ধ্বংস হয়েছে ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র। কার্যকর গণতন্ত্র বা কল্যাণময় সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজন নৈতিক, শিক্ষিত ও জনগণনির্ভর রাজনীতি গড়ে তোলা—যেখানে যুক্তি, আদর্শ ও মানবিকতা হবে রাজনীতির মূল ভিত্তি, পেশিশক্তি নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি নানা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে ন্যারেটিভের মাধ্যমে। স্বার্থান্বেষী ন্যারেটিভগুলো বাংলাদেশের মানুষকে ঐকবদ্ধ জাতি হিসেবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়নি। সৃষ্টি করেছে বিভাজন, অনৈক্য-যা কিনা ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জেন জি অবশ্য সেই ন্যারেটিভের বড় অংশ ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে, তবে আরও অনেক পথ পারি দিতে হবে। রাজনীতি হলো আদর্শভিত্তিক কর্মকাণ্ড, যার লক্ষ্য জনগণের কল্যাণ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন সাধন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শ ও নৈতিকতার পরিবর্তে পেশিশক্তি, অর্থবল ও প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে। এই প্রবণতাটি গণতন্ত্রের শেকড়কে মারাত্মকভাবে দুর্বল করছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকেও বিপর্যস্ত করে ফেলছে। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এই প্রবণতা চরম আকার ধারণ করবে বলেও আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। অবশ্য তার আগাম চিহ্ন দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানের সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনায়।
চব্বিশের ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগশূন্য মাঠে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি। জামায়াত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। হারিয়েছে শীর্ষ নেতাদের। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত অনেক বেশি সুসংগঠিত হয়ে মাঠে কাজ করছে। যাতে দলটির জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। জনগণের আস্থাও অর্জন করছে দলটির জনবান্ধব কর্মসূচি ও নেতাদের বক্তৃতায়। এমতাবস্থায় মাঠে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হচ্ছে একে অপরের। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিল ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিলোপ করে নতুন বন্দোবস্ত করা। এমন অবস্থায় যখন দেশ চলছে, তখন বিএনপি ও তার বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরুচ্ছে। হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা অপরাধের চিত্র উঠে আসছে। তবে, দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব এসব বিষয়ে নিয়েছে পদক্ষেপ, করেছে বহিষ্কার। যা গণতন্ত্রের জন্য ভালো খবর। অন্যদিকে ক্লিন ইমেজে যখন জামায়াত সারাদেশে কাজ করছে তখন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে এক সময়ের সহযোদ্ধা বিএনপির কর্মীদের দ্বারা।
সম্প্রতি নোয়াখালীতে একটি মসজিদে ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটি কোরআন ক্লাসে হামলা চালায় স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা। তাদের অভিযোগ মসজিদে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাবে না। হামলায় অন্তত ৫০ জন আহত হন বলে দাবি শিবিরের। অন্যদিকে আরেকটি ঘটনা ঘটে একটি কাপড়ের দোকানে। যেখানে পর্দানশীন নারীরা বোরখা কিনতে গেলে দর কষাকষির একপর্যায়ে বিএনপি কর্মী নারীদের উপর লাঠি দিয়ে হামলা চালায়, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এসব কারণে বেশ সমালোচিত হচ্ছে বিএনপি। অন্যদিকে শেরপুরে জামায়াতের প্রার্থী ও শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি হাফেজ রাশেদুল ইসলামের জনসংযোগ কর্মসূচিতে বিএনপির নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দলটি। স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়েরও করেছেন জামায়াতের এই প্রার্থী। এমতাবস্থায় পেশিশক্তির ব্যবহার নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাংগঠনিক কাঠামোতে জামায়াত ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি পেশিশক্তির প্রয়োগ শুরু করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়বে। তবে এখন পর্যন্ত জামায়াতের পেশিশক্তির প্রয়োগ বা প্রতিপক্ষকে হামলার ঘটনা না ঘটলেও অদূরে আত্মরক্ষামূলক হলেও যে পাল্টা ঘটবে তাতে অবাক করার কিছু থাকবে না। অতীতে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ যেভাবে প্রতিপক্ষকে মাঠ থেকে বিতাড়িত করেছিল পেশিশক্তি দিয়ে সেই ফর্মূলা আর চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর ঘটবে না। কারণ মানুষ সচেতনভাবে এখন রাজনৈতিক দল ও আদর্শকে সমর্থন করবে।
খুব সম্ভবত এমন ইমেজ সংকটে থাকাবস্থায় আগামী নির্বাচনে ভালো করার জন্য পেশিশক্তি নির্ভরতা বিএনপির পন্থা না হয় তা নিশ্চিত করতে এখনি দলীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মনোনয়ন পেতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা হয়তো নিজ নিজ এলাকায় প্রভাব বলয় তৈরি ও দেখানোর জন্য এসব করছে। আদতে এতে দল হিসেবে ইমেজ সংকট তৈরি করবে। যার প্রতিবিম্বিত হবে আসন্ন নির্বাচনে। চব্বিশের অভ্যুত্থানে যেভাবে কায়েমি শক্তিকে ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ করেছে, আগামীতে যেকোনো ফ্যাসিবাদী শক্তিকেও থামিয়ে দেবে। কারণ এমন ঘটনাগুলো গণতন্ত্রকে অবমূল্যায়ন করে থাকে। অতীতে রাজনীতিতে পেশিশক্তির ব্যবহারের ফলে ভয়ভীতি, দমননীতি ও সন্ত্রাসের কারণে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। নষ্ট হয়েছে তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এর ফলে নির্বাচনের প্রকৃত রূপ বিকৃত হয়ে পড়ে। জনগণের হাতে থাকা ক্ষমতা সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীরা কুক্ষিগত করেছিল।
আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচনে বেশ কয়েকটি প্রধান চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর অনেকগুলো সরকারের সাথে জড়িত। আর কিছু আছে দেশের অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে জড়িত। বিদ্যমান ও সম্ভাব্য সংকটগুলো দুপক্ষকে সমঝোতার মাধ্যমে সমানে এগিয়ে আসতে হবে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর দলগুলোর দেয়া ব্রিফিং বেশ নতুন কিছু সংকট ও জটিলতার আভাস প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আমলাদের মধ্যে বিভাজন ও বিভিন্ন মতের বলে ট্যাগিং করা। তবে হ্যাঁ রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে আমলা পাওয়া যাবে না এটা যেমন সত্য, দলকানা আমলা দিয়ে দেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করাও কঠিন। কারণ, তাদের মধ্যে নীতিবোধের চেয়ে রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দিয়ে নিজের সুবিধা হাসিল করার প্রবণতা বাড়ে। তাই বৃহত্তর স্বার্থে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার বিষয়ে আমলাদের কিভাবে কাজে লাগানো যায়, তা গভীরভাবে ভাবতে হবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে। একই সঙ্গে সরকারে থাকা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নিয়ে রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির পক্ষ থেকে যে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তারও নিরসন করা উচিৎ।
মাঠের রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ সুবিধা না করতে পারলেও আভ্যন্তরীণভাবে ও স্বল্প পরিসরে প্রকাশ্যে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপড়তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। ফ্যাসিবাদের দোসর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলমের সাথে সাক্ষাতও করেছেন। যা নিয়ে বেশ সমালোচনা হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। আওয়ামী লীগও চেষ্টা করছে দেশি-বিদেশি শক্তির মাধ্যমে ফিরে আসতে। অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ ফ্যাসিবাদীদের শীর্ষ নেতাদের বিচার চলছে। বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্রও করা হচ্ছে নানান ন্যারেটিভ ও আলোচনার মাধ্যমে। যদিও সকল আলামত লাইভ। যা বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার জন্য যথেষ্ট বলেই দাবি আইনজীবী, প্রসিকিউটর ও আদালত সংশ্লিষ্টদের।
দেশের রাজনীতি ও বিচার প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের এহেন চেষ্টা নাই যা করে না ফ্যাসিবাদের আতুর ঘর প্রতিবেশ দেশ ভারত। বাংলাদেশের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার নানা ফন্দিও আঁটছে দেশটি। এজন্য নামসর্বস্ব দল ও গোষ্ঠীর পিছনে বড় ধরনের বিনিয়োগ করে থাকে নির্বাচনের আগে। আগামীতেও যে এমনটি করবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই ফ্যাসিবাদের রাস্তা সকল দিক তেকে বন্ধের উদ্যোগ সরকারের অগ্রাধিকারে থাকার বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অতীতের নির্বাচন প্রক্রিয়াসহ যেকোনো ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে গণমাধ্যমগুলোর নিষ্ক্রিয়তা বা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সত্যকে ঝুঁকি নিয়ে হলেও প্রকাশ করতে না পারার জন্য। এমন চরিত্র থেকে বের হতে না পারলে, কিংবা নির্দিষ্ট কোনো দলের হয়ে সাফাই গায়ক হলে নব্য সংকট ও ফ্যাসিবাদের উত্থান অবশ্যম্ভাবী। স্বাধীন মত ও সত্যকে তুলে ধরতে হবে।
নির্বাচন কমিশন(ইসি) সংস্কারের অংশ হিসেবে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আরপিও সংশোধন করছে। তবে নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় প্রতীক পছন্দ করার ক্ষেত্রে আগের যে নিয়ম অর্থাৎ নিজের বা অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতীক পছন্দ করার সুযোগ পেত। তবে প্রস্তাবিত আরপিও সংশোধনীতে জোটবদ্ধ রাজনৈতিক দলকে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বাধ্যবাধতার বিধান রেখেছে ইসি। এতে আপত্তি জানিয়ে আগের নিয়ম বহাল রাখতে সরকারকে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। জনবান্ধব কর্মসূচির কারণে দলটি ক্রমশ জনগণের কাছাকাছি যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বলয় বা জোট গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। অনেক দূর এগিয়েছে বলেও মনে হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে পাঁচ দফা আন্দোলনে জামায়াতের পাশাপাশি কয়েকটি দল কর্মসূচি পালন করছে। সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ দাবিটি হলো জুলাই সনদকে আইন ভিত্তি দেয়া। এমন দাবি রয়েছে এনসিপিরও। রাজনীতিতে আসলে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন জামায়াত। চরম নিপীড়ন, নির্বিচার ও বিচারিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে জামায়াতের সার্ভাইভাল পাওয়ার এবং রাজনৈতিক দৃশ্যপটে শক্তিশালী রূপে আসাটা বিএনপির আশায় গুড়েবালি বা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছেন অনেকে। এর পরোক্ষ ইঙ্গিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। তিনি অনেক বক্তৃতায় বলেছেন আগামীর নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জের, সহজ হবে না। সম্ভবত তিনি বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জামায়াতের কর্মকাণ্ডকে ইঙ্গিত করেছেন। তৃণমূল বিএনপিতে আরও জটিলতা দেখা দেবে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে। প্রার্থিতা বাছাই দলটির জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের হবে। কারণ মাঠে অনেকে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করছে। এমন চ্যালেঞ্জ উতরে নির্বাচনকালীন দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা ও গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় অবদান কতটা রাখতে পারবে তা দেখতে আরও কয়েকটি দিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ দলটির হাইকমান্ড অন্তত ২০০ নেতাকে গ্রিন সিগনাল দিয়েছে। অনেক জেলার নেতাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে বিএনপির নীতিনির্ধারণী বডি।
লেখক- সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আব্দুল্লাহ জিহাদী







