ঢাকা ০৩:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
কৃষি জমি রক্ষায় অভিযান, শাজাহানপুরে ভেকু জব্দ চাঁদা না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে মারধর করে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর মনোনয়নপত্র জমার সময় ভাইয়ের সঙ্গে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি। ব্যারিস্টার খোকনকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করল জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগের নিলামে বাংলাদেশের চার ক্রিকেটার প্রশাসন ক্যাডারের জন্য এবার ১৮৩৩ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় বরাদ্দ ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ ৪ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা বিএনপি দিন দিন সাংগঠনিকভাবে আরও দুর্বল হচ্ছে: ওবায়দুল কাদের যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যাঞ্চলে টর্নেডোর আঘাত, শিশুসহ নিহত ৫ ১ মাসে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সম্পদ কমেছে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি

রমনার বটমূলের গাছটি বটগাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ

উদ্বেলিত কণ্ঠে জনসমুদ্রে, লোকে লোকারণ্যে, বর্ণাঢ্য রং–বেরঙের পোশাকে সুসজ্জিত জনতা, মনে হলো সারা বাংলাদেশ এসে সমবেত হয়েছে বটমূলে এক জাতীয় উত্সবে নববর্ষের প্রাণপ্রাচুর্যের এক উজ্জীবিত আনন্দোত্সব। রমনার ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আজ এক মহোত্সবে পরিণত হয়েছে।

রমনায় বর্ষবরণের এ অনুষ্ঠান শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। সে আয়োজনের সাথে জড়িত একজন বলেন, ১৯৬৭ সালে বাঙালি সংস্কৃতির আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মনে পড়ে সরকারি হামলা ও তার প্রতিবাদী অভিব্যক্তির কথা। থমথমে ভাব চারদিকে। আজিমপুরে সন্‌জীদাদের (ড. সন্‌জীদা খাতুন) ফ্ল্যাটে শুনি সেই প্রতিরোধী বজ্রকণ্ঠ। ছায়ানটের সভা বসেছে। সভায় ঠিক হলো, প্রতিবাদ হিসেবে নববর্ষের অনুষ্ঠান হবে উন্মুক্ত ময়দানে, সর্বসাধারণের সমাগমে। সন্‌জীদা প্রস্তাব করলেন, কোনো বড় গাছের নিচে অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা। ওয়াহিদুল হক এতে সায় দিয়ে আমার দিকে তাকালেন, ‘চেনা কোনো জায়গা আছে?’ হঠাৎ মনে পড়ে গেল, রমনা পার্কের মহিরুহ অশ্বত্থের কথা। দোয়েল পাখির ছবি তুলতে গিয়ে একদিন গাছটার সন্ধান পাই। চারদিক তখন ছিল জংলি ঘাসে আচ্ছাদিত আর বেশ নিভৃত ছিল জায়গাটা। ছায়ানটের কর্মকর্তাদের বললাম গাছটার কথা। সেদিনই শেষ বিকেলে ওয়াহিদুল, সন্‌জীদা, কমল সিদ্দিকী, পিয়ারু (আনুয়ারুল হক) ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে গেলাম গাছ দেখতে। সবার পছন্দ হলো। কিন্তু বেশ পরিষ্কার করে নিতে হবে গাছের গুঁড়ির চারধার আর কেটে নিতে হবে জংলা আগাছা।

জায়গা তো পছন্দ হলো। কিন্তু কী করে ওখানে অনুষ্ঠান করা যায়? জায়গাটা সরকারি। অনুমতি চাইতে গেলে নির্ঘাত পণ্ড হয়ে যাবে সবকিছু। বিপদ এড়ানোর একটা পথ বের করা হলো। উল্লিখিত জায়গার সন্নিকটেই রমনা রেস্টুরেন্ট। মোয়াজ্জেম ভাই (মোয়াজ্জেম আহম্মদ চৌধুরী) তখন সম্পূর্ণ ভার নিয়েছেন রেস্তোরাঁ পরিচালনার। মোয়াজ্জেম ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হলো, রেস্তোরাঁ আয়োজন করবে পয়লা বৈশাখের এক বিক্রয় মেলা। কাগজের ঠোঙায় মুড়ি-মুড়কি ও অন্য খাবারদাবার রেস্তোরাঁর সামনে সাজিয়ে বিক্রয় করা হবে। পুলিশ বা সরকারি লোক এলে যেন বলা যায়, রমনা রেস্টুরেন্টই আয়োজন করেছে বৈশাখী অনুষ্ঠানটা।

তাড়াহুড়ো করে ছায়ানট আমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে ফেলল। অনুষ্ঠানের স্থান: রমনার বটমূল। আসলে কিন্তু গাছটা বট নয়, অশ্বত্থ। তাতে কী আসে যায়—দুটোই ঘনিষ্ঠ প্রজাতি! পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতের আঁধারে মাইক লাগানো হলো। মধ্যরাত পর্যন্ত খেটে পিয়ারু, আনোয়ার জাহান এবং আর্ট কলেজের কয়েকজন মিলে মঞ্চ তৈরি করল। কমল সিদ্দিকী গাছের পোকা মারার জন্য রাতের বেলায় কয়েক দফা স্প্রে করে ফেলল—সন্‌জীদার কড়া নির্দেশ, গানের সময় শিল্পীদের গায়ে যেন পোকামাকড় না পড়ে। তা হলে গান সব পণ্ড হয়ে যাবে। বেচারি কমল বারবার আমার কাছে আসে পরামর্শের জন্য।

বসার জন্য সে রকম ভালো ব্যবস্থা করা যায়নি সময়ের অভাবে—না শিল্পীদের, না শ্রোতাদের জন্য। তবু যথাসময়ে তানপুরায় নববর্ষের শুভাগমনকে সাদর সম্ভাষণ জানানো হলো। আমাদের বুক ঢিপ ঢিপ করছে। হঠাৎ যদি পুলিশের আবির্ভাব হয়।

বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানের আগেও পঞ্চাশের দশকের দিকে ঢাকা শহরের কিছু কিছু বাড়িতে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান লক্ষ করা যায়। পঞ্চাশের শেষের দিকে নাসিরুল হক সাহেব তার আরমানিটোলার হাসিনা হাউসে বর্ষবরণের আয়োজন করেছিলেন। অনুষ্ঠানকক্ষ কৃষ্ণচূড়ার ফুলের বড় বড় গুচ্ছ দিয়ে সাজানো হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে অনেকে গান গেয়েছিল ও নেচেছিল। এতে কলিম শরাফী এবং ঐকতানের অনেক নবীন শিল্পীও অংশ নিয়েছিল। এ ছাড়া হুসনেআরা মাক্কীর ফ্ল্যাটেও নববর্ষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।

পয়লা বৈশাখে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৩৭০ সনের সকালবেলা। সে অনুষ্ঠানে বিদ্যায়তনের উদ্বোধনের ব্যাপার ছিল বলে অনুষ্ঠান হয়েছিল তখনকার ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে। পরে এরই নাম হয় উদয়ন স্কুল। পরের বছর অনুষ্ঠান হলো প্রাঙ্গণের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। সেটা হলো সন্ধ্যাবেলায়। লাল কৃষ্ণচূড়ার স্তবক সজ্জিত শাখা-প্রশাখার নিচে তৈরি হতো মঞ্চ। পয়লা বৈশাখ প্রভাতে রমনার বটমূলে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার অঙ্গীকারে সমৃদ্ধ হবার, উজ্জীবিত হবার পুণ্যস্থানে পরিণত হয়েছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

কৃষি জমি রক্ষায় অভিযান, শাজাহানপুরে ভেকু জব্দ

রমনার বটমূলের গাছটি বটগাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ

আপডেট সময় ০৬:০৬:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

উদ্বেলিত কণ্ঠে জনসমুদ্রে, লোকে লোকারণ্যে, বর্ণাঢ্য রং–বেরঙের পোশাকে সুসজ্জিত জনতা, মনে হলো সারা বাংলাদেশ এসে সমবেত হয়েছে বটমূলে এক জাতীয় উত্সবে নববর্ষের প্রাণপ্রাচুর্যের এক উজ্জীবিত আনন্দোত্সব। রমনার ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আজ এক মহোত্সবে পরিণত হয়েছে।

রমনায় বর্ষবরণের এ অনুষ্ঠান শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। সে আয়োজনের সাথে জড়িত একজন বলেন, ১৯৬৭ সালে বাঙালি সংস্কৃতির আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মনে পড়ে সরকারি হামলা ও তার প্রতিবাদী অভিব্যক্তির কথা। থমথমে ভাব চারদিকে। আজিমপুরে সন্‌জীদাদের (ড. সন্‌জীদা খাতুন) ফ্ল্যাটে শুনি সেই প্রতিরোধী বজ্রকণ্ঠ। ছায়ানটের সভা বসেছে। সভায় ঠিক হলো, প্রতিবাদ হিসেবে নববর্ষের অনুষ্ঠান হবে উন্মুক্ত ময়দানে, সর্বসাধারণের সমাগমে। সন্‌জীদা প্রস্তাব করলেন, কোনো বড় গাছের নিচে অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা। ওয়াহিদুল হক এতে সায় দিয়ে আমার দিকে তাকালেন, ‘চেনা কোনো জায়গা আছে?’ হঠাৎ মনে পড়ে গেল, রমনা পার্কের মহিরুহ অশ্বত্থের কথা। দোয়েল পাখির ছবি তুলতে গিয়ে একদিন গাছটার সন্ধান পাই। চারদিক তখন ছিল জংলি ঘাসে আচ্ছাদিত আর বেশ নিভৃত ছিল জায়গাটা। ছায়ানটের কর্মকর্তাদের বললাম গাছটার কথা। সেদিনই শেষ বিকেলে ওয়াহিদুল, সন্‌জীদা, কমল সিদ্দিকী, পিয়ারু (আনুয়ারুল হক) ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে গেলাম গাছ দেখতে। সবার পছন্দ হলো। কিন্তু বেশ পরিষ্কার করে নিতে হবে গাছের গুঁড়ির চারধার আর কেটে নিতে হবে জংলা আগাছা।

জায়গা তো পছন্দ হলো। কিন্তু কী করে ওখানে অনুষ্ঠান করা যায়? জায়গাটা সরকারি। অনুমতি চাইতে গেলে নির্ঘাত পণ্ড হয়ে যাবে সবকিছু। বিপদ এড়ানোর একটা পথ বের করা হলো। উল্লিখিত জায়গার সন্নিকটেই রমনা রেস্টুরেন্ট। মোয়াজ্জেম ভাই (মোয়াজ্জেম আহম্মদ চৌধুরী) তখন সম্পূর্ণ ভার নিয়েছেন রেস্তোরাঁ পরিচালনার। মোয়াজ্জেম ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হলো, রেস্তোরাঁ আয়োজন করবে পয়লা বৈশাখের এক বিক্রয় মেলা। কাগজের ঠোঙায় মুড়ি-মুড়কি ও অন্য খাবারদাবার রেস্তোরাঁর সামনে সাজিয়ে বিক্রয় করা হবে। পুলিশ বা সরকারি লোক এলে যেন বলা যায়, রমনা রেস্টুরেন্টই আয়োজন করেছে বৈশাখী অনুষ্ঠানটা।

তাড়াহুড়ো করে ছায়ানট আমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে ফেলল। অনুষ্ঠানের স্থান: রমনার বটমূল। আসলে কিন্তু গাছটা বট নয়, অশ্বত্থ। তাতে কী আসে যায়—দুটোই ঘনিষ্ঠ প্রজাতি! পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতের আঁধারে মাইক লাগানো হলো। মধ্যরাত পর্যন্ত খেটে পিয়ারু, আনোয়ার জাহান এবং আর্ট কলেজের কয়েকজন মিলে মঞ্চ তৈরি করল। কমল সিদ্দিকী গাছের পোকা মারার জন্য রাতের বেলায় কয়েক দফা স্প্রে করে ফেলল—সন্‌জীদার কড়া নির্দেশ, গানের সময় শিল্পীদের গায়ে যেন পোকামাকড় না পড়ে। তা হলে গান সব পণ্ড হয়ে যাবে। বেচারি কমল বারবার আমার কাছে আসে পরামর্শের জন্য।

বসার জন্য সে রকম ভালো ব্যবস্থা করা যায়নি সময়ের অভাবে—না শিল্পীদের, না শ্রোতাদের জন্য। তবু যথাসময়ে তানপুরায় নববর্ষের শুভাগমনকে সাদর সম্ভাষণ জানানো হলো। আমাদের বুক ঢিপ ঢিপ করছে। হঠাৎ যদি পুলিশের আবির্ভাব হয়।

বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানের আগেও পঞ্চাশের দশকের দিকে ঢাকা শহরের কিছু কিছু বাড়িতে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান লক্ষ করা যায়। পঞ্চাশের শেষের দিকে নাসিরুল হক সাহেব তার আরমানিটোলার হাসিনা হাউসে বর্ষবরণের আয়োজন করেছিলেন। অনুষ্ঠানকক্ষ কৃষ্ণচূড়ার ফুলের বড় বড় গুচ্ছ দিয়ে সাজানো হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে অনেকে গান গেয়েছিল ও নেচেছিল। এতে কলিম শরাফী এবং ঐকতানের অনেক নবীন শিল্পীও অংশ নিয়েছিল। এ ছাড়া হুসনেআরা মাক্কীর ফ্ল্যাটেও নববর্ষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।

পয়লা বৈশাখে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৩৭০ সনের সকালবেলা। সে অনুষ্ঠানে বিদ্যায়তনের উদ্বোধনের ব্যাপার ছিল বলে অনুষ্ঠান হয়েছিল তখনকার ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে। পরে এরই নাম হয় উদয়ন স্কুল। পরের বছর অনুষ্ঠান হলো প্রাঙ্গণের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। সেটা হলো সন্ধ্যাবেলায়। লাল কৃষ্ণচূড়ার স্তবক সজ্জিত শাখা-প্রশাখার নিচে তৈরি হতো মঞ্চ। পয়লা বৈশাখ প্রভাতে রমনার বটমূলে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার অঙ্গীকারে সমৃদ্ধ হবার, উজ্জীবিত হবার পুণ্যস্থানে পরিণত হয়েছে।