ঢাকা ০৮:৪৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রমাদান : নিয়ামতের সম্ভার ও মুমিনের প্রস্তুতি | প্রথম পর্ব

প্রচণ্ড উত্তাপের পর অবশেষে যখন এক পশলা বৃষ্টি এসে নামে-সেটা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচার মতো। উত্তপ্ত আবহাওয়ার শাসনে রুক্ষ মাটিতে যখন বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাগুলো এসে পড়ে, এক অদ্ভুত সোঁদা মাটির গন্ধ নাকে এসে লাগে। এক হৃদয় শীতল করা বাতাস এসময় বয়ে যায়। প্রতিবার বৃষ্টি শেষে নিয়ম করে একবার বাইরে বের হই শুধু এই বাতাসটা গায়ে মাখার জন্য। মাঝে মাঝে রিকশা নিয়ে এমনিতেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই, যাতে এই বাতাসটা আরও বেশি করে গায়ে লাগে। এসময়টাতে মন মেজাজ ফুরফুরে হয়ে যায়, সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করে, খুব ভালো হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, সবাইকে ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করে।

আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাদানকেও এরকম মৃদু শীতল বাতাসের সাথে তুলনা করেছেন। যে বাতাস নিমিষেই আমাদের মন ভালো করে দেয়, আমাদের হৃদয়ের সমস্ত দুঃখকষ্ট দূর করে দেয়। যে একবার এই বাতাস গায়ে মাখে-সে আর কখনো দুঃখী হবে না। সুবহানআল্লাহ!

তবে এটা এমন এক বাতাস যার স্থায়িত্ব হয় খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খুব অল্প কিছু সৌভাগ্যবান বান্দাই কেবল এই বাতাসে রোমাঞ্চিত হওয়ার সুযোগ পায়। প্রতিবছর আমাদের সামনে রমাদান এসে হাজির হয়। সারা মুসলিম বিশ্বে এক উৎসব উৎসব রব শুরু হয়। সেহরি, ইফতার, তারাবীহ, শবে কদর, ঈদের খুশি-এই সবকিছুর ভিড়ে রমাদানটা কেমন জানি নির্দিষ্ট কিছু আচার-অনুষ্ঠানে ঘুরপাক খেতে থাকে। চোখের পলকেই সেই রমাদান আবার চলেও যায়। কিন্তু কয়জন রমাদান নামের সেই শীতল বাতাসে নিজেদের প্রশান্ত করতে পারে? কয়জন আছে যারা নিজেদের গুনাহগুলোকে মাফ করিয়ে নিতে পারে? নিজেদের পাপের বোঝা হালকা করে, এক বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে জাহান্নামের আগুন থেকে অনন্ত সুখের জান্নাতে নিজের নামটা লিখিয়ে নিতে পারে কয়জন! এই লেখাটি সেই সৌভাগ্যবানদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার এক অসাধারণ ম্যানুয়াল।

আস-সিয়াম ও রমাদান পরিচিতি
আল কুরআনুল কারীম, রমাদান ও সিয়াম সাধনা একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আল কুরআনুল কারীমের সম্মানের কারণেই রমাদান মাস সম্মানিত হয়েছে। আর রমাদান মাসের মূল কর্মকাণ্ডই হচ্ছে, সিয়াম সাধনা। সে পরিপ্রেক্ষিতে সর্বপ্রথমে সিয়াম ও রমাদান সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা প্রয়োজন।

‘আসসাওম’ (الصوم) অথবা ‘আস-সিয়াম’ (الصيام) শব্দ দুটির আভিধানিক অর্থ :
‘আসসাওম’ (الصوم) অথবা ‘আস-সিয়াম’ (الصيام) শব্দ দু’টি আরবি। এ শব্দ দু’টি মূলত ক্রিয়ামূল। এ শব্দ দু’টির ধাতুমূল (ص+و+م)। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, সাধারণভাবে কোনো কিছু থেকে বিরত থাকা, কোনো কিছু থেকে সংযমি হওয়া প্রভৃতি। যেমন- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মারইয়ামকে শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে ইরশাদ করেন-
إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْمًا فَلَنْ أُكَلِمَ الْيَوْمَ إِنْسِيًّا
‘আমি পরম করুণাময়ের জন্য ‘সাওম’ এর মানত করেছি। অতএব আজ আমি কোনো মানুষের সাথে কিছুতেই কথা বলব না।’ অর্থাৎ আমি কথা বলা থেকে বিরত থাকার মানত করেছি। সুতরাং এ আয়াতের দৃষ্টিতে সাওমের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, বিরত থাকা। (সূরা মারইয়াম: ২৬)

‘আস সাওম’ (الصوم) অথবা ‘আস-সিয়াম’ ( الصيام) শব্দ দুটির পারিভাষিক অর্থ :
আল-কামুসুল ফিকহি গ্রন্থে বলা হয়েছে,
الصوم هو إمساك عن المفطرات، حقيقة، أو حكما، في وقت مخصوص، من شخص مخصوص، مع النية.
وقيل: الصوم هو إمساك المكلف بالنية من الليل من تناول المطعم.
“সাওম হলো, নির্দিষ্ট সময় সুনির্দিষ্ট কার্যাবলি থেকে নিয়তসহ সাওম ভঙ্গকারী হাকীকী ও হুকমী (খাওয়া, পান করা এবং যৌনসম্ভোগ) বিষয় থেকে বিরত থাকা।”(আল-কামুসুলফিকহি–৩৫০)
যুরযানী রহ. বলেন,
عبارة عن إمساك مخصوص وهو الإمساك عن الأكل والشرب والجماع من الصبح إلى المغرب مع النية.
“সুবহে সাদিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত খাদ্য গ্রহণ এবং যৌনাচার থেকে নিয়তের সাথে বিরত থকার নাম হলো সাওম।” (তারিফাত লিল জুরজানী- ১৭৮)
কারও কারও মতে ‘আস-সুবহুস সাদিক’ থেকে বালিগ (বয়োপ্রাপ্ত), বিবেকবান মুসলিম সূর্যান্ত পর্যন্ত নিয়্যাত সহকারে শারী’আতের দৃষ্টিতে সিয়াম পালনের প্রতিবন্ধকতা যেমন হায়িয ও নিফাস প্রভৃতি থেকে মুক্ত হয়ে সিয়াম ভঙ্গকারী কাজসমূহ থেকে বিরত থাকাকেই ‘সিয়াম’ বলে। সিয়াম একটি অন্যতম ইবাদাত। আলোচ্য সিয়ামের এ সংজ্ঞায় যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে- ব্যাপ্তিকাল: ‘আস-সুবহুস সাদিক’ হতে সূর্যান্ত পর্যন্ত।
অন্তরের অভিব্যক্তি : অবশ্যই অন্তরে সিয়াম পালনের নিয়্যাত থাকতে হবে।
সিয়ামের বিধান : সিয়াম আমাদের জন্য ফরজ ইবাদাত। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
یایها الذین امنوا کتب علیکم الصیام کما کتب علی الذین من قبلکم لعلکم تتقون
হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সূরা বাকারা : ১৮৩)

সিয়াম পালনকারীর বৈশিষ্ট্য :
১. বালিগ (বয়োপ্রাপ্ত) হওয়া।
২. বিবেকবান হওয়া।
৩. মুসলিম হওয়া।
৪. হায়িয ও নিফাস প্রভৃতি থেকে মুক্ত থাকা।
৫. সিয়াম ভঙ্গকারী কাজসমূহ থেকে বিরত থাকা।

সিয়াম ভঙ্গকারী কাজসমূহ :
১. যৌন অনুশীলন করা।
২. হায়িয ও নিফাসগ্রস্ত হওয়া।
৩. ইচ্ছাকৃত বমি করা।
৪. সিঙ্গা লাগানো।
৫. খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করা।

রমাদান
‘রমাদান’ একটি মাসের নাম। হিজরি দ্বিতীয় সনের শা’আবান মাসে পুরো রমাদান মাস ধরে মুসলিমদের ওপর সিয়াম সাধনাকে ফরজ বা অত্যাবশ্যকীয় করা হয়। ‘রমাদান’ আরবি শব্দ। এ শব্দটির ধাতুমূল হচ্ছে, (ر+م+ض)-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, প্রচণ্ড গরম বা পুড়িয়ে ছারখার করা। সাধারণত প্রচণ্ড গরমের মৌসুমে সিয়াম সাধনার সময়কাল হয়ে থাকত, কারো কারো মতে সেজন্য একে রমাদান মাস বলা হয়।

আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত সম্ভার ও আমাদের প্রস্তুতি
যে-কোনো কাজে সফল হওয়ার জন্য ভাল প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। রমাদান মাস যেন আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। এক্ষেত্রেও অতি অবশ্যই সেই মূলনীতির কোনো ব্যতিক্রম হবে না, যেখানে বলা হচ্ছে যে, “প্রস্তুতিই হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি।” প্রতি বছরই রমাদানকে ঘিরে নেওয়া হয় হরেক রকমের প্রস্তুতি। এর মধ্য থেকে তিনটার কথা বলা যায়।

রমাদানের প্রস্তুতি
• আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত সম্ভার (আল্লাহর প্রস্তুতি)
• দুনিয়াদারদের রমাদানকেন্দ্রিক প্রস্তুতি।
• মুমিনদের রমাদান প্রস্তুতি।

• আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত সম্ভার (আল্লাহর প্রস্তুতি)
পাঁচটি উপায়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের জন্য রমাদানকে প্রস্তুত করেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইসলামের এই মাসটাকে এত বেশি পুরস্কার আর সুযোগ দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন যে আর কোনো মাসকে তেমনটা রাখেননি।
১. স্বল্প সময়ে অসংখ্য পুরস্কার: আল্লাহ এটিকে করেছেন সামান্য কয়েক দিনের ব্যাপার। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
أَيَّامًا مَّعْدُودَاتٍ “সীামত কয়েকটা দিন মাত্র।” (সূরা বাকারাহ : ১৮৪)
এটা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার পক্ষ থেকে আমাদের উপর অসীম, অপার অনুগ্রহ যে মাত্র কয়েকটি ‘লিমিটেড’ দিনের মধ্যেই তিনি আমাদেরকে ‘আনলিমিটেড’, অফুরন্ত পুরস্কার দিতে চান।

২. শয়তানকে বন্দি রাখা: মানুষের সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু শয়তানকে এসময় রাখা হয় বন্দীদশায়। রামাদানে শয়তান শিকলবদ্ধ থাকে। রমাদানের একেবারে প্রথম দিন থেকে নিয়ে শেষ দিনটি পর্যন্ত চলে তার এই বন্দীত্ব; যাতে করে বছরের অন্য যেকোনা সময়ের চেয়ে এই সময়টাকে, ইবাদতের এই মৌসুমকে করে দেওয়া যায় ঈমানদারদের অন্তরের জন্য সহজতর আর হালকা।

রাসূলুল্লাহ বলেন- “যখন রমাদানের প্রথম রাতটি আসে, তখন শয়তান এবং বিদ্রোহী জ্বিনদেরকে শিকলবন্দী করে ফেলা হয়।” (তিরমিযি : ১৮২)

৩. জাহান্নামের দরজা বন্ধ, জান্নাতের দরজা খুলে রাখা: একই হাদিসে রাসূলুল্লাহ বলেন, “আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং একটা দরজাও খোলা থাকে না। ওদিকে জান্নাতের সবগুলো দরজা খুলে দেওয়া হয় আর একটা দরজাও বন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে না।” (তিরমিযি : ৬৮২)

৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তিদান: এই অসাধারণ মাসটির প্রত্যেক রাতে আল্লাহ জাল্লা জালালুহু মুক্ত করে দেন। এমন অসংখ্য বনী আদমকে, জাহান্নামকেই যাদের জন্য জন্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল ঠিকানা হিসেবে।
রাসূলুল্লাহ বলেন, “আল্লাহ এ মাসের প্রতি রাতে অনেক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।” (তিরমিযি, হাদিস: ১৮১)

৫. লাইলাতুল কদর: আল্লাহ এই মাসে এমন ভরপুর একটা রাত রেখেছেন যে রাত আল্লাহর দাসত্বে কাটিয়ে দেওয়াটা হাজার মাস আল্লাহর দাসত্ব করার চেয়েও বেশি। হাজার মাস মানে হল তিরাশি বছর চার মাস প্রায়। কিন্তু সেই রাতটায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে “হাজারটা মাসের চেয়েও বেশি” পুরস্কারের হাতছানি!

রাসূলুল্লাহ বলেন, “রমাদানে এমন একটি রাত রয়েছে, যে রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এবং যে এই রাতের ফজিলত থেকে বঞ্চিত হল সে যেন সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হল।” (ইবনু মাজাহ, হাদিস: ১৯৪৪)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অসংখ্য প্রস্ততির মধ্যে এগুলো হল হাতেগোণা কয়েকটা মাত্র। কেন আল্লাহর এই বিরাট প্রস্তুতি? কারণ যারা চায় জান্নাতের উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে, যারা চায় এর সুবিশাল বাগানগুলোতে ঘুরে বেড়াতে, যারা চায় জান্নাতের সবচেয়ে মূল্যবান উপহারগুলো পেতে এবং যারা চায় তাঁদের রব আল্লাহর কাছে, একেবারে কাছে একটা ঘরের মালিক হতে, সেই তাদের জন্য আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা এই মাসকে বানাতে চান একটা এক শুভ সূচনা।
• দুনিয়াদারদের রমাদানকেন্দ্রিক প্রস্তুতি

আমাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে যারা ইহসানের বদলা ইহসান দিয়ে দিতে চায় না। এরাই হচ্ছে দুনিয়াদার লোকজন, যারা দুনিয়াতেই ঘরবাড়ি বানানোকে তাদের জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য বানিয়ে নিয়েছে। তারা কিভাবে রমাদানের জন্য প্রস্তুত হয়? এমন এক ভাবে তারা তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে, যার মাধ্যমে রমাদানের উপহারের পুরোটুকু না হলেও অধিকাংশই তারা স্রেফ হারিয়ে বসে।

• দুনিয়াদার লোকেরাও রমাদানের প্রস্তুতি নেয় পাঁচভাবে:

১. ভোজনের মাস: এদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে ফ্রিজের ভেতর খাবার স্তুপ করে রাখার মধ্যে। যেন তারা “মান্থ অব ফাস্টিং” “সাওমের মাস” পালনের পরিবর্তে “মান্থ অব ফিস্টিং” – “ভোজনের মাস” উদযাপন করতে যাচ্ছে। আমরা কাফিরদের বলে থাকি এই মাস আমাদের ডায়েট ঠিক রাখতে, পরিমিত খাবার দাবার গ্রহণ করতে আর আল্লাহ আমাদের যা দিয়েছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতেও সাহায্য করে। আর যখন এই কথাগুলো সত্য, তখন আমাদের খাবারের জন্য বেহিসাব প্রস্তুতি, যার ফল দাঁড়ায় ধারাবাহিক ওজন বৃদ্ধি আর খাবারের ভয়াবহ অপচয়, আমাদের কথার সাথে এগুলো পুরোপুরি সাংঘর্ষিক হয়ে যায়।

এছাড়াও আমাদের অতিরিক্ত চাহিদা আমাদের স্ত্রীদের সময়কে নষ্ট করে ফেলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা অন্তহীন সময় ধরে নানা পদের খাবার তৈরিতে তাদের সময় ব্যয় করেন, যখন কিনা তাদের উচিত ছিল প্রভুর ইবাদাতে বেশি সময় ব্যয় করা। খেয়াল করে দেখুন রামাদানে আপনি কিভাবে খানাপিনা করেন।

রাসূলুল্লাহ বলেন, “দুনিয়াতে যাদের পেটগুলো পরিপূর্ণ থাকবে কিয়ামতের দিনে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত থাকবে।”( আল জামিউস সাগির, হাদিস : ২২১১)
এই হাদীস শোনার পর এর বর্ণনাকারী আবু যুহাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ইন্তিকালের দিন পর্যন্ত আর কখনো পেট ভরে খাওয়া দাওয়া করেননি।

ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “পেট মোটা কোন মানুষের কি অন্তর নরম হতে পারে?” ইমাম আহমাদ জবাব দিয়েছিলেন, “আমি এটা বিশ্বাস করি না।”(আল মুজামুল আউসাত লিত তাবারানি : ৮/৩৭৮)

২. চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ: রমাদান যত ঘনিয়ে আসে দুনিয়াদারদের চেহারায় নাখুশি আর বিরক্তির চিহ্নগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাদের মুখের হাবভাব আর কথাবার্তা থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায়।

আল্লাহ আমাদের সবাইকেই খুব ভালো করে জানেন। রমাদানে এমন কিছু মানুষ সিয়াম পালন করে যাদের সিয়াম পালনের একমাত্র কারণ হল তাদের আশেপাশের লোকজনের সিয়াম পালন করা। তারা অধীর হয়ে অপেক্ষা করে যে কখন রমাদান মাস শেষ হবে। এ ধরনের লোকেরা এই ভয় করে না যে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে বলবেন: “তোমার উপবাস থাকার কোন দরকার আমার নেই! তুমি আমার ইবাদাতকে ঘৃণা করতে এবং তাই আজকের দিনে আমার সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই।”

এই যে রমাদানের প্রতি এই বিতৃষ্ণা অথবা ইসলামের যেকোন বিষয়ের প্রতিই ঘৃণা, এসব একজন মানুষের আখিরাতকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। আল্লাহ এই ধরনের লোকদের সম্পর্কে বলছেন;

ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ “এটা এজন্যে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তারা তা অপছন্দ করেছে। কাজেই তিনি তাদের আমলসমূহ নিষ্ফল করে দিয়েছেন।”(সূরা মুহাম্মাদ : ০৯)

৩. কর্মঘন্টা নিয়ন্ত্রণ: রমাদানের জন্য প্রস্তুত হতে গিয়ে তারা অধীনস্তদের কর্মঘণ্টাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা এজন্য করে না যাতে করে তাদের অধীনস্তরা ইবাদাত আর কুরআন তিলাওয়াতের জন্য সময় পায়। এই কাজটা তারা করে সাওম পালনের সময় তাদের ঘুমানোর সুযোগকে সর্বোচ্চ পরিমাণে বাড়িয়ে তোলার জন্য।

৪. সময় অপচয়ের বিষয় বের করা: আগে থেকেই তারা ঠিক করে রাখে যে না খেয়ে থাকার সময়টুকু তারা কোন কোন টিভি সিরিজ দেখে কাটাবে। রমাদানের জন্য ব্যতিক্রম হিসেবে তারা নব্বই মিনিটের ফুটবল ম্যাচ পুরোটুকুই দেখে, শুধু হাইলাইটস দেখে সন্তুষ্ট থাকে না। তাদের কাছে সময় নষ্ট করাটাই সবচেয়ে জরুরি। এরচেয়েও খারাপ কাজ করে সেই মানুষগুলো যারা ইফতারের পরে এমন লোকদের সাথে মেশে বা এমন জায়গায় যায় যাদের সাথে থাকলে বা যেসব জায়গায় গেলে আল্লাহর অবাধ্যতা হয় আর এর মাধ্যমে সাওম পালনের মাধ্যমে যেটুকু সাওয়াব তারা অর্জন করেছিল, সেটুকুও একেবারে খুইয়ে বসে।

৫. তারাহুড়া করে তারাবীহ আদায়: দুনিয়াদার লোকেরা এমন সব মসজিদ খুঁজে নেয় যেগুলোতে সবচেয়ে সংক্ষিপ্তাকারে তারাবীহর সালাত আদায় করা হয়। তাদের এমন করার কারণ এজন্য না যে পরেরদিন তাদেরকে সকাল সকাল উঠে কাজে যেতে হবে, বরং সালাত তাদের কাছে বোঝার মত মনে হয়। এটা বিস্ময়কর কিছু নয়, কারণ স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই বলেছেন,

وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَيْشِعِينَ
“আর নিশ্চয় বিনয়ীরা ছাড়া তা অন্যদের উপর কঠিন।” (সূরা বাকারাহ, আয়াত-ক্রম: ৪৫)

এভাবেই দুনিয়াদাররা রমাদানের জন্য প্রস্তুতি নেয়। সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ কীভাবে তাদের সাথে আচরণ করেন আর তারা কীভাবে আল্লাহর সাথে আচরণ করে, এই দুইয়ের মধ্যে তুলনা করে দেখুন। আল্লাহ তাদের ডাকেন আর তারা সেই ডাক থেকে পালিয়ে যায়। আল্লাহ একটার পর একটা সুযোগের দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন আর তারা সেটাকে দড়াম করে বন্ধ করে দেয়। তারা তাদের রবের সাথে এমন আচরণ করে যেন আল্লাহর তাদেরকে দরকার আর তাদের আল্লাহকে কোন দরকার নেই। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক।

চলবে…

লেখক: মুবাইদুল ইসলাম
লেখক ও সম্পাদক

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

টানা চতুর্থবার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন ম্যানসিটি

রমাদান : নিয়ামতের সম্ভার ও মুমিনের প্রস্তুতি | প্রথম পর্ব

আপডেট সময় ০৪:৫৬:৪১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ মার্চ ২০২৪

প্রচণ্ড উত্তাপের পর অবশেষে যখন এক পশলা বৃষ্টি এসে নামে-সেটা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচার মতো। উত্তপ্ত আবহাওয়ার শাসনে রুক্ষ মাটিতে যখন বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাগুলো এসে পড়ে, এক অদ্ভুত সোঁদা মাটির গন্ধ নাকে এসে লাগে। এক হৃদয় শীতল করা বাতাস এসময় বয়ে যায়। প্রতিবার বৃষ্টি শেষে নিয়ম করে একবার বাইরে বের হই শুধু এই বাতাসটা গায়ে মাখার জন্য। মাঝে মাঝে রিকশা নিয়ে এমনিতেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই, যাতে এই বাতাসটা আরও বেশি করে গায়ে লাগে। এসময়টাতে মন মেজাজ ফুরফুরে হয়ে যায়, সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করে, খুব ভালো হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, সবাইকে ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করে।

আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাদানকেও এরকম মৃদু শীতল বাতাসের সাথে তুলনা করেছেন। যে বাতাস নিমিষেই আমাদের মন ভালো করে দেয়, আমাদের হৃদয়ের সমস্ত দুঃখকষ্ট দূর করে দেয়। যে একবার এই বাতাস গায়ে মাখে-সে আর কখনো দুঃখী হবে না। সুবহানআল্লাহ!

তবে এটা এমন এক বাতাস যার স্থায়িত্ব হয় খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খুব অল্প কিছু সৌভাগ্যবান বান্দাই কেবল এই বাতাসে রোমাঞ্চিত হওয়ার সুযোগ পায়। প্রতিবছর আমাদের সামনে রমাদান এসে হাজির হয়। সারা মুসলিম বিশ্বে এক উৎসব উৎসব রব শুরু হয়। সেহরি, ইফতার, তারাবীহ, শবে কদর, ঈদের খুশি-এই সবকিছুর ভিড়ে রমাদানটা কেমন জানি নির্দিষ্ট কিছু আচার-অনুষ্ঠানে ঘুরপাক খেতে থাকে। চোখের পলকেই সেই রমাদান আবার চলেও যায়। কিন্তু কয়জন রমাদান নামের সেই শীতল বাতাসে নিজেদের প্রশান্ত করতে পারে? কয়জন আছে যারা নিজেদের গুনাহগুলোকে মাফ করিয়ে নিতে পারে? নিজেদের পাপের বোঝা হালকা করে, এক বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে জাহান্নামের আগুন থেকে অনন্ত সুখের জান্নাতে নিজের নামটা লিখিয়ে নিতে পারে কয়জন! এই লেখাটি সেই সৌভাগ্যবানদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার এক অসাধারণ ম্যানুয়াল।

আস-সিয়াম ও রমাদান পরিচিতি
আল কুরআনুল কারীম, রমাদান ও সিয়াম সাধনা একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আল কুরআনুল কারীমের সম্মানের কারণেই রমাদান মাস সম্মানিত হয়েছে। আর রমাদান মাসের মূল কর্মকাণ্ডই হচ্ছে, সিয়াম সাধনা। সে পরিপ্রেক্ষিতে সর্বপ্রথমে সিয়াম ও রমাদান সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা প্রয়োজন।

‘আসসাওম’ (الصوم) অথবা ‘আস-সিয়াম’ (الصيام) শব্দ দুটির আভিধানিক অর্থ :
‘আসসাওম’ (الصوم) অথবা ‘আস-সিয়াম’ (الصيام) শব্দ দু’টি আরবি। এ শব্দ দু’টি মূলত ক্রিয়ামূল। এ শব্দ দু’টির ধাতুমূল (ص+و+م)। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, সাধারণভাবে কোনো কিছু থেকে বিরত থাকা, কোনো কিছু থেকে সংযমি হওয়া প্রভৃতি। যেমন- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মারইয়ামকে শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে ইরশাদ করেন-
إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْمًا فَلَنْ أُكَلِمَ الْيَوْمَ إِنْسِيًّا
‘আমি পরম করুণাময়ের জন্য ‘সাওম’ এর মানত করেছি। অতএব আজ আমি কোনো মানুষের সাথে কিছুতেই কথা বলব না।’ অর্থাৎ আমি কথা বলা থেকে বিরত থাকার মানত করেছি। সুতরাং এ আয়াতের দৃষ্টিতে সাওমের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, বিরত থাকা। (সূরা মারইয়াম: ২৬)

‘আস সাওম’ (الصوم) অথবা ‘আস-সিয়াম’ ( الصيام) শব্দ দুটির পারিভাষিক অর্থ :
আল-কামুসুল ফিকহি গ্রন্থে বলা হয়েছে,
الصوم هو إمساك عن المفطرات، حقيقة، أو حكما، في وقت مخصوص، من شخص مخصوص، مع النية.
وقيل: الصوم هو إمساك المكلف بالنية من الليل من تناول المطعم.
“সাওম হলো, নির্দিষ্ট সময় সুনির্দিষ্ট কার্যাবলি থেকে নিয়তসহ সাওম ভঙ্গকারী হাকীকী ও হুকমী (খাওয়া, পান করা এবং যৌনসম্ভোগ) বিষয় থেকে বিরত থাকা।”(আল-কামুসুলফিকহি–৩৫০)
যুরযানী রহ. বলেন,
عبارة عن إمساك مخصوص وهو الإمساك عن الأكل والشرب والجماع من الصبح إلى المغرب مع النية.
“সুবহে সাদিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত খাদ্য গ্রহণ এবং যৌনাচার থেকে নিয়তের সাথে বিরত থকার নাম হলো সাওম।” (তারিফাত লিল জুরজানী- ১৭৮)
কারও কারও মতে ‘আস-সুবহুস সাদিক’ থেকে বালিগ (বয়োপ্রাপ্ত), বিবেকবান মুসলিম সূর্যান্ত পর্যন্ত নিয়্যাত সহকারে শারী’আতের দৃষ্টিতে সিয়াম পালনের প্রতিবন্ধকতা যেমন হায়িয ও নিফাস প্রভৃতি থেকে মুক্ত হয়ে সিয়াম ভঙ্গকারী কাজসমূহ থেকে বিরত থাকাকেই ‘সিয়াম’ বলে। সিয়াম একটি অন্যতম ইবাদাত। আলোচ্য সিয়ামের এ সংজ্ঞায় যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে- ব্যাপ্তিকাল: ‘আস-সুবহুস সাদিক’ হতে সূর্যান্ত পর্যন্ত।
অন্তরের অভিব্যক্তি : অবশ্যই অন্তরে সিয়াম পালনের নিয়্যাত থাকতে হবে।
সিয়ামের বিধান : সিয়াম আমাদের জন্য ফরজ ইবাদাত। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
یایها الذین امنوا کتب علیکم الصیام کما کتب علی الذین من قبلکم لعلکم تتقون
হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সূরা বাকারা : ১৮৩)

সিয়াম পালনকারীর বৈশিষ্ট্য :
১. বালিগ (বয়োপ্রাপ্ত) হওয়া।
২. বিবেকবান হওয়া।
৩. মুসলিম হওয়া।
৪. হায়িয ও নিফাস প্রভৃতি থেকে মুক্ত থাকা।
৫. সিয়াম ভঙ্গকারী কাজসমূহ থেকে বিরত থাকা।

সিয়াম ভঙ্গকারী কাজসমূহ :
১. যৌন অনুশীলন করা।
২. হায়িয ও নিফাসগ্রস্ত হওয়া।
৩. ইচ্ছাকৃত বমি করা।
৪. সিঙ্গা লাগানো।
৫. খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করা।

রমাদান
‘রমাদান’ একটি মাসের নাম। হিজরি দ্বিতীয় সনের শা’আবান মাসে পুরো রমাদান মাস ধরে মুসলিমদের ওপর সিয়াম সাধনাকে ফরজ বা অত্যাবশ্যকীয় করা হয়। ‘রমাদান’ আরবি শব্দ। এ শব্দটির ধাতুমূল হচ্ছে, (ر+م+ض)-এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, প্রচণ্ড গরম বা পুড়িয়ে ছারখার করা। সাধারণত প্রচণ্ড গরমের মৌসুমে সিয়াম সাধনার সময়কাল হয়ে থাকত, কারো কারো মতে সেজন্য একে রমাদান মাস বলা হয়।

আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত সম্ভার ও আমাদের প্রস্তুতি
যে-কোনো কাজে সফল হওয়ার জন্য ভাল প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। রমাদান মাস যেন আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। এক্ষেত্রেও অতি অবশ্যই সেই মূলনীতির কোনো ব্যতিক্রম হবে না, যেখানে বলা হচ্ছে যে, “প্রস্তুতিই হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি।” প্রতি বছরই রমাদানকে ঘিরে নেওয়া হয় হরেক রকমের প্রস্তুতি। এর মধ্য থেকে তিনটার কথা বলা যায়।

রমাদানের প্রস্তুতি
• আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত সম্ভার (আল্লাহর প্রস্তুতি)
• দুনিয়াদারদের রমাদানকেন্দ্রিক প্রস্তুতি।
• মুমিনদের রমাদান প্রস্তুতি।

• আল্লাহ তায়ালার নিয়ামত সম্ভার (আল্লাহর প্রস্তুতি)
পাঁচটি উপায়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের জন্য রমাদানকে প্রস্তুত করেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইসলামের এই মাসটাকে এত বেশি পুরস্কার আর সুযোগ দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন যে আর কোনো মাসকে তেমনটা রাখেননি।
১. স্বল্প সময়ে অসংখ্য পুরস্কার: আল্লাহ এটিকে করেছেন সামান্য কয়েক দিনের ব্যাপার। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,
أَيَّامًا مَّعْدُودَاتٍ “সীামত কয়েকটা দিন মাত্র।” (সূরা বাকারাহ : ১৮৪)
এটা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার পক্ষ থেকে আমাদের উপর অসীম, অপার অনুগ্রহ যে মাত্র কয়েকটি ‘লিমিটেড’ দিনের মধ্যেই তিনি আমাদেরকে ‘আনলিমিটেড’, অফুরন্ত পুরস্কার দিতে চান।

২. শয়তানকে বন্দি রাখা: মানুষের সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু শয়তানকে এসময় রাখা হয় বন্দীদশায়। রামাদানে শয়তান শিকলবদ্ধ থাকে। রমাদানের একেবারে প্রথম দিন থেকে নিয়ে শেষ দিনটি পর্যন্ত চলে তার এই বন্দীত্ব; যাতে করে বছরের অন্য যেকোনা সময়ের চেয়ে এই সময়টাকে, ইবাদতের এই মৌসুমকে করে দেওয়া যায় ঈমানদারদের অন্তরের জন্য সহজতর আর হালকা।

রাসূলুল্লাহ বলেন- “যখন রমাদানের প্রথম রাতটি আসে, তখন শয়তান এবং বিদ্রোহী জ্বিনদেরকে শিকলবন্দী করে ফেলা হয়।” (তিরমিযি : ১৮২)

৩. জাহান্নামের দরজা বন্ধ, জান্নাতের দরজা খুলে রাখা: একই হাদিসে রাসূলুল্লাহ বলেন, “আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং একটা দরজাও খোলা থাকে না। ওদিকে জান্নাতের সবগুলো দরজা খুলে দেওয়া হয় আর একটা দরজাও বন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে না।” (তিরমিযি : ৬৮২)

৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তিদান: এই অসাধারণ মাসটির প্রত্যেক রাতে আল্লাহ জাল্লা জালালুহু মুক্ত করে দেন। এমন অসংখ্য বনী আদমকে, জাহান্নামকেই যাদের জন্য জন্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল ঠিকানা হিসেবে।
রাসূলুল্লাহ বলেন, “আল্লাহ এ মাসের প্রতি রাতে অনেক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।” (তিরমিযি, হাদিস: ১৮১)

৫. লাইলাতুল কদর: আল্লাহ এই মাসে এমন ভরপুর একটা রাত রেখেছেন যে রাত আল্লাহর দাসত্বে কাটিয়ে দেওয়াটা হাজার মাস আল্লাহর দাসত্ব করার চেয়েও বেশি। হাজার মাস মানে হল তিরাশি বছর চার মাস প্রায়। কিন্তু সেই রাতটায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে “হাজারটা মাসের চেয়েও বেশি” পুরস্কারের হাতছানি!

রাসূলুল্লাহ বলেন, “রমাদানে এমন একটি রাত রয়েছে, যে রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এবং যে এই রাতের ফজিলত থেকে বঞ্চিত হল সে যেন সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হল।” (ইবনু মাজাহ, হাদিস: ১৯৪৪)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অসংখ্য প্রস্ততির মধ্যে এগুলো হল হাতেগোণা কয়েকটা মাত্র। কেন আল্লাহর এই বিরাট প্রস্তুতি? কারণ যারা চায় জান্নাতের উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে, যারা চায় এর সুবিশাল বাগানগুলোতে ঘুরে বেড়াতে, যারা চায় জান্নাতের সবচেয়ে মূল্যবান উপহারগুলো পেতে এবং যারা চায় তাঁদের রব আল্লাহর কাছে, একেবারে কাছে একটা ঘরের মালিক হতে, সেই তাদের জন্য আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা এই মাসকে বানাতে চান একটা এক শুভ সূচনা।
• দুনিয়াদারদের রমাদানকেন্দ্রিক প্রস্তুতি

আমাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে যারা ইহসানের বদলা ইহসান দিয়ে দিতে চায় না। এরাই হচ্ছে দুনিয়াদার লোকজন, যারা দুনিয়াতেই ঘরবাড়ি বানানোকে তাদের জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য বানিয়ে নিয়েছে। তারা কিভাবে রমাদানের জন্য প্রস্তুত হয়? এমন এক ভাবে তারা তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে, যার মাধ্যমে রমাদানের উপহারের পুরোটুকু না হলেও অধিকাংশই তারা স্রেফ হারিয়ে বসে।

• দুনিয়াদার লোকেরাও রমাদানের প্রস্তুতি নেয় পাঁচভাবে:

১. ভোজনের মাস: এদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে ফ্রিজের ভেতর খাবার স্তুপ করে রাখার মধ্যে। যেন তারা “মান্থ অব ফাস্টিং” “সাওমের মাস” পালনের পরিবর্তে “মান্থ অব ফিস্টিং” – “ভোজনের মাস” উদযাপন করতে যাচ্ছে। আমরা কাফিরদের বলে থাকি এই মাস আমাদের ডায়েট ঠিক রাখতে, পরিমিত খাবার দাবার গ্রহণ করতে আর আল্লাহ আমাদের যা দিয়েছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতেও সাহায্য করে। আর যখন এই কথাগুলো সত্য, তখন আমাদের খাবারের জন্য বেহিসাব প্রস্তুতি, যার ফল দাঁড়ায় ধারাবাহিক ওজন বৃদ্ধি আর খাবারের ভয়াবহ অপচয়, আমাদের কথার সাথে এগুলো পুরোপুরি সাংঘর্ষিক হয়ে যায়।

এছাড়াও আমাদের অতিরিক্ত চাহিদা আমাদের স্ত্রীদের সময়কে নষ্ট করে ফেলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা অন্তহীন সময় ধরে নানা পদের খাবার তৈরিতে তাদের সময় ব্যয় করেন, যখন কিনা তাদের উচিত ছিল প্রভুর ইবাদাতে বেশি সময় ব্যয় করা। খেয়াল করে দেখুন রামাদানে আপনি কিভাবে খানাপিনা করেন।

রাসূলুল্লাহ বলেন, “দুনিয়াতে যাদের পেটগুলো পরিপূর্ণ থাকবে কিয়ামতের দিনে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত থাকবে।”( আল জামিউস সাগির, হাদিস : ২২১১)
এই হাদীস শোনার পর এর বর্ণনাকারী আবু যুহাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ইন্তিকালের দিন পর্যন্ত আর কখনো পেট ভরে খাওয়া দাওয়া করেননি।

ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “পেট মোটা কোন মানুষের কি অন্তর নরম হতে পারে?” ইমাম আহমাদ জবাব দিয়েছিলেন, “আমি এটা বিশ্বাস করি না।”(আল মুজামুল আউসাত লিত তাবারানি : ৮/৩৭৮)

২. চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ: রমাদান যত ঘনিয়ে আসে দুনিয়াদারদের চেহারায় নাখুশি আর বিরক্তির চিহ্নগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাদের মুখের হাবভাব আর কথাবার্তা থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায়।

আল্লাহ আমাদের সবাইকেই খুব ভালো করে জানেন। রমাদানে এমন কিছু মানুষ সিয়াম পালন করে যাদের সিয়াম পালনের একমাত্র কারণ হল তাদের আশেপাশের লোকজনের সিয়াম পালন করা। তারা অধীর হয়ে অপেক্ষা করে যে কখন রমাদান মাস শেষ হবে। এ ধরনের লোকেরা এই ভয় করে না যে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে বলবেন: “তোমার উপবাস থাকার কোন দরকার আমার নেই! তুমি আমার ইবাদাতকে ঘৃণা করতে এবং তাই আজকের দিনে আমার সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই।”

এই যে রমাদানের প্রতি এই বিতৃষ্ণা অথবা ইসলামের যেকোন বিষয়ের প্রতিই ঘৃণা, এসব একজন মানুষের আখিরাতকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। আল্লাহ এই ধরনের লোকদের সম্পর্কে বলছেন;

ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ “এটা এজন্যে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তারা তা অপছন্দ করেছে। কাজেই তিনি তাদের আমলসমূহ নিষ্ফল করে দিয়েছেন।”(সূরা মুহাম্মাদ : ০৯)

৩. কর্মঘন্টা নিয়ন্ত্রণ: রমাদানের জন্য প্রস্তুত হতে গিয়ে তারা অধীনস্তদের কর্মঘণ্টাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা এজন্য করে না যাতে করে তাদের অধীনস্তরা ইবাদাত আর কুরআন তিলাওয়াতের জন্য সময় পায়। এই কাজটা তারা করে সাওম পালনের সময় তাদের ঘুমানোর সুযোগকে সর্বোচ্চ পরিমাণে বাড়িয়ে তোলার জন্য।

৪. সময় অপচয়ের বিষয় বের করা: আগে থেকেই তারা ঠিক করে রাখে যে না খেয়ে থাকার সময়টুকু তারা কোন কোন টিভি সিরিজ দেখে কাটাবে। রমাদানের জন্য ব্যতিক্রম হিসেবে তারা নব্বই মিনিটের ফুটবল ম্যাচ পুরোটুকুই দেখে, শুধু হাইলাইটস দেখে সন্তুষ্ট থাকে না। তাদের কাছে সময় নষ্ট করাটাই সবচেয়ে জরুরি। এরচেয়েও খারাপ কাজ করে সেই মানুষগুলো যারা ইফতারের পরে এমন লোকদের সাথে মেশে বা এমন জায়গায় যায় যাদের সাথে থাকলে বা যেসব জায়গায় গেলে আল্লাহর অবাধ্যতা হয় আর এর মাধ্যমে সাওম পালনের মাধ্যমে যেটুকু সাওয়াব তারা অর্জন করেছিল, সেটুকুও একেবারে খুইয়ে বসে।

৫. তারাহুড়া করে তারাবীহ আদায়: দুনিয়াদার লোকেরা এমন সব মসজিদ খুঁজে নেয় যেগুলোতে সবচেয়ে সংক্ষিপ্তাকারে তারাবীহর সালাত আদায় করা হয়। তাদের এমন করার কারণ এজন্য না যে পরেরদিন তাদেরকে সকাল সকাল উঠে কাজে যেতে হবে, বরং সালাত তাদের কাছে বোঝার মত মনে হয়। এটা বিস্ময়কর কিছু নয়, কারণ স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই বলেছেন,

وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَيْشِعِينَ
“আর নিশ্চয় বিনয়ীরা ছাড়া তা অন্যদের উপর কঠিন।” (সূরা বাকারাহ, আয়াত-ক্রম: ৪৫)

এভাবেই দুনিয়াদাররা রমাদানের জন্য প্রস্তুতি নেয়। সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ কীভাবে তাদের সাথে আচরণ করেন আর তারা কীভাবে আল্লাহর সাথে আচরণ করে, এই দুইয়ের মধ্যে তুলনা করে দেখুন। আল্লাহ তাদের ডাকেন আর তারা সেই ডাক থেকে পালিয়ে যায়। আল্লাহ একটার পর একটা সুযোগের দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন আর তারা সেটাকে দড়াম করে বন্ধ করে দেয়। তারা তাদের রবের সাথে এমন আচরণ করে যেন আল্লাহর তাদেরকে দরকার আর তাদের আল্লাহকে কোন দরকার নেই। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক।

চলবে…

লেখক: মুবাইদুল ইসলাম
লেখক ও সম্পাদক