বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন বলেন, আজ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মানবাধিকার কোথায়। আমরা সংবিধানের অনেক অধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অনেক আপত্তি আছে। আইন তৈরি হয় মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করার জন্য কিন্তু আজ দেখা যায় আইন দিয়ে মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়। আমরা পাচঁ বছর পর পর নির্বাচন করি আর এমনভাবে ঠ্যাংগায় (পিটায়) যেন কেউ ভোট কেন্দ্রের আশে পাশে আসতে না পারে। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়ার দরকার। নির্বাচন করলেই গণতন্ত্র ও মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা হয় না। কারণ এই নির্বাচনে মানুষ তার মৌলিক নাগরিক
অধিকার ভোট প্রদান করতে পারে না। কারণ আমরা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তা’ দেখেছি।
আজ ১৫ ডিসেম্বর শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের আ.সালাম মিলনায়তনে সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস এন্ড লিগ্যাল রিসার্চের উদ্যোগে আয়োজিত “মানবাধিকারের ধারণা ও বাস্তবতা : বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট” শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এবং সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস এন্ড লিগ্যাল রিসার্চের প্রধান এডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে ও এডভোকেট মো: আসাদ উদ্দিন ও এডভোকেট মীর নুরুন্নবী উজ্জলের যৌথ সঞ্চালনায় এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন, আলোচনা রাখেন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অব:) এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট মো: মাসদার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ প্রমুখ। সেমিনারে কী-নোট উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট একেএম বদরুদ্দোজা।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন বলেন, অনুষ্ঠানের আয়োজকরা যে সাহস করে এই দুর্দিনে মানবাধিকার নিয়ে সেমিনার করছে, তাদের ধন্যবাদ জানাই। আজ প্রশ্ন আসে বিচার ব্যবস্থা কি স্বাধীন। অথচ বিচার বিভাগ স্বাধীন হাওয়ার কথা ছিল। প্রত্যেক মানুষের সম্মানজনক মৃত্যু অধিকার আছে। প্রাকৃতিকভাবেই আল্লাহ প্রদত্ত অনেক অধিকার আছে মানুষের। রাসুল সা. বিদায় হজের ভাষণের সময় মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান পবিত্র ঘোষণা করেন। এটা মানুষের মৌলিক মানবাধিকারে সর্বোত্তম কথা। ১৯৪৮ সালে মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার আজ ৭৫ বছর পরও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নেই। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক মানবাধিকার অধিকারের কথা বলা আছে এবং মানুষের অধিকার রক্ষা করার কথা বলা আছে।
সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অব:) এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট মো. মাসদার হোসেন বলেন, দেশের জনগণ সবচেয়ে নিগৃহীত, নিপীড়িত আজ। আমরা মুক্ত অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করলেও পদে পদে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হচ্ছে। দেশে আজ বাক-স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, সুশাসন, ন্যায় বিচার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংসদের এমপিরা নির্বাচনের সময় রাস্তা ঘাট করার কথা বলে, কিন্তু ভালো আইন প্রনয়নের করা বলে না। এতো গুম-খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট থেকে সুয়োমটো রুল হয় না। বিচারকরা ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে কাজ করার কথা। এখন মাঝে মাঝে ভাবি, বিচার বিভাগ স্বাধীন করা মনে হয় ভুল হয়েছে। বর্তমান বিচার বিভাগের অবস্থাদৃষ্টে এ কথা বললাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো মানবাধিকার রক্ষা করা। কিন্তু রাষ্ট্র আজ মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, অথচ তাদের দায়িত্ব হলো মানুষের অধিকার জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়া। কারণ জনগণের ট্যাক্স এর টাকায় তাদের বেতন হয়।
তিনি বলেন, রাসুল সা. কর্তৃক প্রণীত মদীনা সনদে নিশ্চিত করা হয়, সবার নাগরিক অধিকার সমান, কারো প্রতি কোন বৈষম্য করা হবে না ধর্ম ও বর্ণের কারণে বা সাদা ও কালো হওয়ার কারণে। বিদায় হজের ভাষণেও রাসুল সা. বলেন আজ থেকে সবার রক্ত পবিত্র, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যাবে না, কারো সম্পদ ও সম্মান লুট করা যাবে না। জাতিসংঘের ঘোষণায় আছে সার্বজনীন মানবাধিকার রক্ষা করার কথা। কিন্তু আজ বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, মানুষ ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। রাষ্ট্রের দায়িত্বে যারা আছে তাদের মানবাধিকার জ্ঞানের ঘাটতি আছে। দেশের পুলিশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। মানুষ নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়ে পুলিশের সহায়তা চাইলেও পাচ্ছে না। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করা হচ্ছে। আজ রাষ্ট্রই সন্ত্রাসী হয়ে গেছে। মানবাধিকার হলো মানুষের ভোট দেওয়ার মৌলিক নাগরিক অধিকার। আজ মানুষ ভোট দিতে পারছে না এবং তাদের নির্বাচন করারও অধিকার নাই। যে কারণে মানুষ আজ ভোট দিতে যায় না।
সেমিনারে কী-নোট উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট একেএম বদরুদ্দোজা। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গুম-খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে দাবি করার পর এখন সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে, যা একটি কালো আইন। সাংবাদিক, সচেতন নাগরিকদের বাক স্বাধীনতা নাই। লাখ লাখ মিথ্যা রাজনৈতিক হয়রানি মূলক মামলা দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের উপরে দমন নিপীড়ন চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এবং সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস এন্ড লিগাল রিসার্চের প্রধান এডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমান সভাপতির বক্তব্যে ফিলিস্তিনে মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পেশ করেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বন্ধে এবং সংঘটিত অপরাধসমূহের প্রতিকার হিসাবে দশ দফা প্রস্তাব পেশ করেন।