গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে রোগীরা সরকারি হাসপাতালে গিয়ে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী রোগিরা বলছেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ আশপাশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগীর কাছে আসতে ভয় পান। ভর্তি হতে চাইলে চিকিৎসকরা রোগীকে স্পর্শ না করে বা সরাসরি পরীক্ষা না করে শুধু দূর থেকে দেখে, কথা বলে এবং বর্ণনা শুনে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বিদায় দিয়ে দেন। হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয় না কোনো ওষুধও। অন্য কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন। বাধ্য হয়ে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে বহু রোগী নিজ বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা।
এদিকে সুন্দরগঞ্জের অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগীরা চিকিৎসার খরচ জোগাতেও হিমশিম খাচ্ছেন। তারা সরকারি হাসপাতালে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বেসরকারি কোনো হাসপাতালের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করছেন। যাদের অনেকেই ধারদেনা করে ওষুধ কিনছেন। এমনকি কেউ কেউ চড়া সুদে ঋণ নিয়েও চিকিৎসা ব্যয়ের জোগান দিচ্ছেন।
উপজেলার বেলকা ইউনিয়নের কিশামত সদর গ্রামে গত ২৭ আগস্ট অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত একটি গরু জবাই করা হয়। যার মাংস কাটাকাটিতে অংশ নেয় ১১ জন। দুই দিন পর তাদের শরীরে ফোসকা পড়াসহ অ্যানথ্রাক্সের নানা উপসর্গ দেখা যায়। তাদের মধ্যে মোজাফফর আলী বা চোখে ১০ দিন ধরে দেখছেন না বলে জানান।
এই ঘটনার কয়েক দিন পর পাশের পশ্চিম বেলকা গ্রামের গৃহবধূ রোজিনা বেগম (৪৫) এর একটি ছাগল অসুস্থ হয়ে পড়লে ছাগলটি জবাই করে মাংস কাটাকাটি করেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুত্বর অবস্থায় ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এরপর নতুন করে আরও ছয়জনের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দেয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী এ নিয়ে উপজেলায় মোট ২২ জনের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ শনাক্ত হলেও ৫০ ছাড়িয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
তাদের মধ্যে মোজাফফর আলী চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিজের দুর্ভোগে পড়ার চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অসুস্থ হওয়ার পর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে ভর্তি হতে চাইলে চিকিৎসক ওষুধ লিখে বিদায় করে দেন। বাড়িতে ফিরে দুই দিন ওষুধ খেলেও ফোসকা ভালো হয়নি। পরে রংপুর থেকে গাইবান্ধার রাবেয়া ক্লিনিকে আসা এক চর্মরোেগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাই। তার দেওয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী এখন ওষুধ খাচ্ছি। কিন্তু ১০ দিন ধরে বা চোখে দেখতে পাচ্ছি না।
তিনি আরও বলেন, আমার চোখের জন্য উন্নত চিকিৎসা দরকার। কিন্তু সেই টাকা নেই, কী করে চিকিৎসা করব? এখন পর্যন্ত চিকিৎসার পেছনে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার টাকা ধার করা। চিকিৎসক দুই মাস ওষুধ খেতে বলেছেন। প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়, ওষুধের অনেক দাম।
অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গে আক্রান্ত মোজাহার আলী বলেন, দুই হাতের ফোসকা এখনো ভালো হয়নি। এ পর্যন্ত ৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে চড়া সুদে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। সেই টাকা পরিশোধ করব নাকি ওষুধ কিনব, তা নিয়ে চিন্তায় আছি। দেড় বিঘা জমি বর্গা চাষ করে কোনোমতে সংসার চলে। মাঝেমধ্যে অন্য জেলায় গিয়ে রিকশা চালাই। এখন অসুস্থ হয়ে সেটাও পারছি না। খুব বিপদে আছি।
খতিব মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, দিনমজুরের কাজ করে সংসার চলে। এ পর্যন্ত দেনা করে ৩ হাজার টাকা চিকিৎসার পেছনে খরচ করেছি। প্রতিদিন ওষুধ কিনতে হচ্ছে। একদিকে বাজার খরচ, আরেক দিকে ওষুধ কেনা-কোনটা আগে করব চিন্তা করে কোলায়ে উঠতে পারছি না।
বেলকা গ্রামের অসুস্থ গরু জবাইয়ে অংশ নেওয়া নুরুন্নবীর মা নূরননাহার বেগম (৫৬) জানান, তার ছেলের ডান হাতে ফোসকা পড়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে ভর্তি নেয়নি। দূর থেকে দেখে চিকিৎসক ওষুধ লিখে দিয়েছেন। পরে গাইবান্ধায় গিয়ে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সে অনুযায়ী চিকিৎসা চলছে। ছেলে এখন অনেকটাই সুস্থ।
অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত শফিউল ইসলাম বলেন, দুই হাতের ফোসকা এখনো ভালো হয়নি। এ পর্যন্ত সাড়ে আট হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে চড়া সুদে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। সেই টাকা পরিশোধ করব নাকি ওষুধ কিনব, তা নিয়ে চিন্তায় আছি। মাঝেমধ্যে অন্য জেলায় গিয়ে রিকশা চালাই। এখন অসুস্থ হয়ে সেটাও পারছি না।
সুন্দরগঞ্জের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দিবাকর বসাক বিস্তর এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে যারা হাসপাতালে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ গুরুতরভাবে আক্রান্ত ছিলেন না। সেজন্য ভর্তি রাখারও প্রয়োজন হয়নি।
তিনি আরো বলেন, অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। রোগীদের জন্য বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগ সবসময় সজাগ আছে। এ ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে মেডিকেল টিম কাজ করছে।