ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ও ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। রবিবার (১২ অক্টোবর) দিবাগত রাত ১টার দিকে ঢাবির স্যার এ এফ রহমান হলের এক্সটেনশন শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাসের সামনে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় এবং ৩টার দিকে তা শেষ হয়।
সংঘর্ষ চলাকালে ঘটনাস্থলে একাধিক ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এসময় উভয় পক্ষকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠি-সোটা নিয়ে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় অংশ নিতে দেখা যায়। সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ কয়েকজন শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
ঢাকা কলেজ সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রবিবার সন্ধ্যায় ঢাকা কলেজের ইংরেজী বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল কর্মী শাহিন মৃধা আর ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাগর খান ঢাবির শাহনেওয়াজ হলের মূল ফটক সংলগ্ন রাস্তায় একটি দোকান উঠিয়ে আখরস নামক ফুটকার্ট দোকান (ভ্রাম্যমান) বসান। এরপর রাতে শাহনেওয়াজ হলের একদল শিক্ষার্থী প্রতিবাদ জানান এবং এক পর্যায়ে কথা কাটাকাটি হয়। বিষয়টি শাহিন ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সদস্য সচিব মিল্লাদ হোসেন ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো: সাগর খানসহ কয়েকজন ছাত্রদল নেতাকে জানান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ছাত্রহলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাগর খানের নিউমার্কেট এরিয়াতে পার্টনারে আরও ৫-৬ টি আখরসের ভাসমান দোকান আছে যেগুলো ছাত্ররাজনীতির প্রভাব দেখিয়ে করে থাকেন। সেই জেরে গতকালও ঢাবির নেওয়াজ হলের সামনে শাহিনসহ কয়েকজনকে নিয়ে দোকান বসাতে যান। পরে সেখান থেকেই ঘটনার সূত্রপাত।
এছাড়া, রাত পৌনে ১টার দিকে ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাসে শাহিনসহ কয়েকজন প্রচার করেন, ঢাবির শাহনেওয়াজ হলের শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মারধর করে একজনকে আটক রেখেছে। এরপর রাত ১টার দিকে ঢাকা কলেজের ৬০ থেকে ৭০ জন শিক্ষার্থী শাহনেওয়াজ হলের দিকে গেলে দুই পক্ষের সংঘর্ষ শুরু হয়। এসময় সাংবাদিকসহ উভয় পক্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।
বিশেষ করে, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ঢাকা কলেজ শাখার মুখপাত্র আশরাফুল হাফিজের মাথায় ইট লেগে গুরুত্বর জখম হয়। পরে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ শুরু হলে তাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়।
সংঘর্ষ চলাকালে নিউমার্কেট এলাকায় দুই পক্ষের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান নেয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দু’পক্ষকে ধাওয়া দিয়ে সরিয়েও দেয় তারা। এছাড়া পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত আকার ধারণ করে তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি (ভিপি) সাদিক কায়েমসহ ছাত্রনেতারা এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যও যোগ দেন।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, সংঘর্ষের ঘটনার আগে শিক্ষার্থীদেরকে সংঘবদ্ধ করায় নেতৃত্ব দিয়েছেন কলেজ শাখা ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। তাদের নেতৃত্বেই শিক্ষার্থীরা শাহনেওয়াজ হলের দিকে যায়।
ঘটনার বিষয়ে জানিয়ে ইমরান মিয়া নামে এক ঢাবি শিক্ষার্থী বলেন, আমি যতটুকু শুনেছি- শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাসের সামনে ঢাকা কলেজের ছেলেপেলেরা দোকান বসাতে চেয়েছে। পরে শাহনেওয়াজের শিক্ষার্থীরা বাধা দেয়ায় তাদের একজনের গায়ে হাত তোলা হয়েছে। ছাত্রাবাসের ছেলেরাও প্রতিবাদ করায় ঢাকা কলেজ থেকে বিপুলসংখ্যক ছেলেপেলে এসে শাহনেওয়াজে ককটেল নিক্ষেপ করে এবং ইট-পাথর দিয়ে ঢিল নিক্ষেপ করে। তখন শাহনেওয়াজের স্টুডেন্টরা এখন এক প্রকার বন্দি হয়ে যায়।
এ বিষয়ে রাতে স্যার এএফ রহমান হলের জিএস হাবিবুল্লাহ হাবিব বলেন, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাহনেওয়াজ হল) শিক্ষার্থীদের ওপরে হামলা করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট ঠান্ডা ছিল। আমি ও ডাকসু নেতৃবৃন্দ যাওয়ার পর তাদেরকে শান্ত হতে বললে তারা থেমে যায় এবং হলের ভেতরে চলে যায়। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এবং পুলিশ তাদের সঙ্গে কথা বলতে যাবে এমন সময়ে তারা কাচের তৈরি বস্তু দিয়ে ঢিল ছুঁড়তে থাকে। এসময় আমাদের কয়েকজন আহত হয় এবং কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন।
স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী মিফতাদুল ইসলাম আদিল বলেন, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের একটা গ্রুপ শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাসের সামনে থাকা একটি দোকান তুলে দিয়ে আরেকটি দোকান বসাতে চাইলে ঝটলা তৈরি হয়। তখন ছাত্রাবাসের কয়েকজন শিক্ষার্থী গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, সেখান থেকে দোকান তুলে দেওয়ার বা বসানো দায়িত্ব তো ঢাকা কলেজের নয়, তারা কেন ঝামেলা করছে? এরপর কথা কাটাকাটি ও ঝামেলা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক মুসাদ্দিক আলী ইবনে মুহাম্মদ বলেন, আমি যতদূর শোনেছি, শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাসের সামনে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা দোকান বসালে, তা উঠিয়ে দেয় ছাত্রাবাসে থাকা চারুকলার শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা দলবল নিয়ে আসলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে ঢাকা কলেজ ছাত্রদল কর্মী শাহিন মৃধাকে মোবাইলে ফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। ঢাকা কলেজের সদস্য সচিব মিল্লাদ হোসেনকেও কল দিয়ে পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নিউমার্কেট জোনের এসি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর রবিবার রাতে গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাবির শাহনেওয়াজ হলের সামনে ফুটপাতে দোকান বসানোকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উভয়পক্ষকে সরিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হবে আসলে কী হয়েছে। যদি আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে তা নেওয়া হবে। তাৎক্ষণিকভাবে কোনও হতাহতের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে আহতদের কয়েকজনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।