ঢাকা ১০:৪৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শাপলা প্রতীক বরাদ্দ দিলে সংবিধান লঙ্ঘন হতো-বিশেষজ্ঞগণ

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরপর বেশ কয়েক মাস ধরে জাতীয় প্রতীক শাপলাকে দলীয় প্রতীক করা নিয়ে চলছে বিতর্ক। দিন দিন এ বিতর্ক জোরালো হচ্ছে। যদিও আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, জাতীয় প্রতীক শাপলা শুধু রাষ্ট্রের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা যাবে, অন্য কেউ ব্যবহার করলে তা হবে আইন ও সংবিধানের লঙ্ঘন। ফলে দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা বরাদ্দ দেওয়া হলে তা হবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) শাপলাকে তাদের দলীয় প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ দাবি করে আসছে। ইসি তাদের সেই দাবিকে নাকচ করেছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর দলটি ফের ইসিতে আবেদন করেছে। এরপরও ইসি তাদের আগের অবস্থানই তুলে ধরেছে। এ অবস্থায় এনসিপির নেতারা শাপলাকে তাদের দলের দলীয় প্রতীক করা না হলে রাজপথে নামার হুমকি দিয়েছেন।

এনসিপির নেতাদের দাবি, কোনো একটি দলের প্রভাবে কমিশন তাদের শাপলা প্রতীক বরাদ্দ দিতে রাজি হচ্ছে না। এমনকি নির্বাচন কীভাবে হয়, সেটাও দেখে নেবেন বলে এনসিপির একজন নেতা বক্তব্য রেখেছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা প্রতীক নিয়ে রাজনীতিতে উত্তেজনা বিরাজ করছে। আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তারা আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শাপলা দেশের জাতীয় ফুল, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতীক। এটি কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতীক হতে পারে না। একটি রাষ্ট্রের সংবিধান স্বীকৃত জাতীয় প্রতীককে কোনো একটি দলের সম্পদ হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া যায় না। ইসি যদি নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিকে তাদের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে শাপলা বরাদ্দ দেয়, তাহলে যুক্তিসংগত কারণেই অভিযোগ উঠবে এনসিপিকে অন্যায়ভাবে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এর আগে আবেদন করলেও একটি রাজনৈতিক দলকে প্রতীকটি না দেওয়া নিয়েও উঠবে প্রশ্ন। সে কারণেই হয়তো ইসি এমন সিদ্ধন্ত নিয়েছে। ইসির সিদ্ধান্ত না মানাটাও অযৌক্তিক। এনসিপির মতো আরও বহু দল আছে, সবাই যদি ভিন্ন ভিন্ন দাবি তোলে, আর সেটা ইসি যদি না মানে এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে সেসব দলও যদি আন্দোলনে নামে, তাহলে নির্বাচন করাটাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এ প্রসঙ্গে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন বলেছেন, ‘এনসিপির প্রতীকের ব্যাপারে ইসি আইন মতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতীক সম্পর্কিত বিধি (রুলস) অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় প্রতীক শাপলা হলো রাষ্ট্রের প্রতীক, এটা কেন দলীয় প্রতীক হবে? ইসির সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়াটাও অযৌক্তিক।’ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দলগুলো দলীয় প্রতীক হিসেবে যে কোনো প্রতীকই চাইতে পারে। এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু সেই প্রতীক চাওয়াটা ইসির তালিকা থেকে হওয়া আবশ্যক। জাতীয় নাগরিক পার্টি শাপলা প্রতীক চেয়েছে, এটা তাদের ইচ্ছা। কিন্তু সেটি তো ইসির সংরক্ষিত তালিকার মধ্যে নেই। আর তালিকায় না থাকার যুক্তিও আছে কমিশনের কাছে। এ ছাড়া শাপলা প্রতীকটি এর আগে অন্য রাজনৈতিক দলও চেয়েছে; কিন্তু তাদের দেওয়া হয়নি একই কারণে। সুতরাং দলীয় সিদ্ধান্তে অটল না থেকে এনসিপিকে বিকল্প তালিকা থেকে ভাবা উচিত।

শাপলা নিয়ে বিতর্কের ব্যাপারে ইসির সাবেক আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘এনসিপি ইসি’র সিদ্ধান্ত মানছে না। তাদের পথ অনুসরণ করে অন্য দলগুলোও যদি বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ইসিতে হাজির হয় এবং ইসি যে সিদ্ধান্ত দেয়, সেটা যদি না মানে, তাহলে নির্বাচনের কী হবে? নির্বাচন কমিশনের বহু সিদ্ধান্ত বহু দলের কাছে অপছন্দ হতে পারে, সবাই এনসিপির পথ অনুসরণ করলে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। এনসিপি যে প্রতীক চেয়েছে, সেটা ইসির বিধিতে যেসব চিহ্নিত প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে নেই। তাহলে রাজপথে নামার হুমকি তো অযৌক্তিক।’

এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরও বলেছেন, ‘আমাদের ফ্ল্যাগ অ্যান্ড এমব্লেম অর্ডার নামে একটি আইন আছে। সেখানে উল্লেখ আছে, জাতীয় প্রতীক শাপলা। যেহেতু জাতীয় প্রতীক আইন করে বলা হয়েছে শাপলা, এটা অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। এটা শুধু দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা যাবে। অন্য কেউ ব্যবহার করলে তা হবে আইনের লঙ্ঘন’—ইসির সাবেক আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক।

এদিকে জাতীয় প্রতীক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ৪ অনুচ্ছেদে জাতীয় সংগীত, পতাকা ও প্রতীকের ব্যাপারে বলা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদের ৩ উপঅনুচ্ছেদে বলা হয়েছে জাতীয় প্রতীকের ব্যাপারে। সংবিধানের ওই বিধানের আলোকে, ১৯৭২ সালে জাতীয় প্রতীক আদেশও জারি করা হয়। এই বিধিমালায় পতাকা ও প্রতীকের সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং এর অপব্যবহার বা লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। বাহাত্তরের ওই আদেশে জাতীয় প্রতীকের নকশার ব্যাপারে বলা হয়েছে, জাতীয় প্রতীকের কেন্দ্রে পানিতে ভাসমান শাপলা ফুল থাকবে, যা ধানের শীষ ও পাটগাছের পাতা দিয়ে বেষ্টিত থাকবে এবং ওপরে চারটি তারকা থাকবে। এই বিধিমালার বিধান লঙ্ঘন করলে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০০ টাকা জরিমানারও বিধান রয়েছে।

ইসির সাবেক আইন কর্মকর্তা ও আইনজীবী এবং সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. শাহজাহান সাজু বলেছেন, জাতীয় প্রতীক শাপলা পুরো জাতির সম্পদ। এটা সবার সম্পদ। এটা সংবিধান স্বীকৃত জাতীয় সম্পদ। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক হতে পারে না। এটাকে দলীয় প্রতীক করা হলে, জাতীয় ঐতিহ্য যেগুলো আছে, সেগুলো সবাই তাদের নিজেদের বলে দাবি করে বসবে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালায় যেখানে দলগুলোর নিবন্ধনের কথা বলা আছে, সেখানে দলীয় প্রতীকগুলোও উল্লেখ আছে। সব দলের একটা নিজস্ব প্রতীক আছে। যখন একজনকে একটা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়, তখন সেটা তাদের নিজস্ব প্রতীক হয়ে যায়। এটা আর কেউ নিতে পারে না। সেই প্রতীক নিয়ে সারা দেশে দলটি নির্বাচন করে। যে কারণে একটি জাতির প্রতীককে, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব প্রতীক হতে পারে না। কোনো দলকে এক্সট্রা ফেভার করাও ঠিক হবে না।

জানা যায়, এনসিপি গত ২২ জুন দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্যে ইসিতে আবেদন করে এবং একই সঙ্গে তাদের পছন্দের প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’ সংরক্ষণের অনুরোধ জানায়। গত ৯ জুলাই ইসি ‘শাপলা’ প্রতীককে নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে তালিকাভুক্ত না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘শাপলা’ যেহেতু বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক; তাই এটি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক হতে পারে না। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এনসিপি গত ১৩ জুলাই নির্বাচন কমিশনে একটি লিখিত আবেদন জমা দেয়। আবেদনে তারা যুক্তি দেয় যে, ইসির এই ব্যাখ্যা আইনিভাবে সঠিক নয়। দলটি ইসিকে দেখায়, জাতীয় প্রতীক হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট নকশা, যা শাপলা ফুল, ধানের শীষ, পাট পাতা এবং তারকা সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে ‘ধানের শীষ’ এবং ‘তারা’ প্রতীক দুটি এরই মধ্যে যথাক্রমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলকে (জেএসডি) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় ফল ‘কাঁঠাল’ ও ‘সোনালি আঁশ’ (যা পাটকে নির্দেশ করে) যথাক্রমে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি এবং তৃণমূল বিএনপিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যদি জাতীয় প্রতীকের উপাদানগুলো পৃথকভাবে বরাদ্দ দেওয়া যায়, তাহলে ‘শাপলা’ বরাদ্দ দিতেও কোনো আইনি বাধা নেই।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও দলটির আইন শাখার সদস্য মো. মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন বলেছেন, জাতীয় প্রতীক এককভাবে শাপলা না। শাপলার সঙ্গে ধানের শীষ, তারকা, পাটপাতা রয়েছে। একক না হওয়ায় এটা প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ দিতে বাধা নেই। জাতীয় ফল, জাতীয় পশু—এগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তিনি সংবিধানের ৪ অনুচ্ছেদের ৩ উপঅনুচ্ছেদ তুলে ধরে বলেন, এ বিধান অনুযায়ী ধানের শীষ প্রতীক হতে পারলে শাপলাও দলীয় প্রতীক হতে পারে। আমরা মনে করি, বিশেষ কারও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ইসি এনসিপিকে দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা বরাদ্দ দিতে রাজি হচ্ছে না।

বিএনপির ‘ধানের শীষ’ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির প্রতীক ‘তারকা’ হচ্ছে জাতীয় প্রতীকের অংশ, তাহলে শাপলা কেন এনসিপিকে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না—এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ শাহজাহান সাজু বলেছেন, ছোটকাল থেকেই জাতীয় প্রতীক কোনটি—এই প্রশ্নের জবাবে সবাই কিন্তু শেখে ও বলে, জাতীয় প্রতীক শাপলা। কেউ কিন্তু ধানের শীষ, পাটপাতা বা তারকার কথা বলে না। মূলত শাপলাই হলো জাতীয় প্রতীক, আর অন্যগুলো হলো শাপলার অংশ। অন্যগুলোর সমন্বয় করে জাতীয় প্রতীক করা হয়েছে শাপলাকে। শাপলাকে জাতীয় প্রতীক করতে গিয়ে ধানের শীষ, তারা, পাটপাতা এগুলো আনা হয়েছে, যাতে এগুলো জাতীয় প্রতীককে আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলে। বাহাত্তরের প্রথম লিখিত সংবিধানের প্রস্তাবনায়ও এ শাপলা প্রতীক ছিল। যার কারণে শাপলাকে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা দলের প্রতীক করা যাবে না।

এদিকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘যেহেতু কোনো আইনগত বাধা নেই; তাই এনসিপির মার্কা শাপলাই হতে হবে। অন্য কোনো অপশন নেই। না হলে নির্বাচন কীভাবে হয়, আর কে কীভাবে ক্ষমতায় গিয়ে মধু খাওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেটা আমরাও দেখে নেব।’ এরপর গত ২৫ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেন, ‘এর আগে নাগরিক ঐক্য শাপলা চেয়েছিল। দুইটা চিঠি দিয়েছে। আমার সঙ্গে দেখাও করেছে। কিন্তু আমরা দিইনি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এটা দেওয়া যাবে না, আমরা এ জবাব দিয়ে দিয়েছি। পরে এনসিপি আবেদন করেছে। তারপর বাকি এনসিপিরটা তো আপনারা জানেনই, এটা নিয়ে আমি ব্যাখ্যা করতে চাই না।’ গত ২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে হবিগঞ্জ পৌর টাউন হলে আয়োজিত দলের সমন্বয় সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে সারজিস আলম বলেন, ‘যদি শাপলা প্রতীক না দেওয়া হয়, তবে আমাদের সমাধান হবে রাজপথে।’ দলটি ২০০৮ সালের নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে তাদের পছন্দের প্রতীক—শাপলা, সাদা শাপলা অথবা লাল শাপলা—এর যে কোনো একটি বরাদ্দের দাবি অব্যাহত রেখেছে। দলীয় সিদ্ধান্তে অটল না থেকে এনসিপিকে বিকল্প তালিকা থেকে ভাবা উচিত বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।

ট্যাগস :

চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন সাবেক শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ

শাপলা প্রতীক বরাদ্দ দিলে সংবিধান লঙ্ঘন হতো-বিশেষজ্ঞগণ

আপডেট সময় ০৯:২২:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরপর বেশ কয়েক মাস ধরে জাতীয় প্রতীক শাপলাকে দলীয় প্রতীক করা নিয়ে চলছে বিতর্ক। দিন দিন এ বিতর্ক জোরালো হচ্ছে। যদিও আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, জাতীয় প্রতীক শাপলা শুধু রাষ্ট্রের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা যাবে, অন্য কেউ ব্যবহার করলে তা হবে আইন ও সংবিধানের লঙ্ঘন। ফলে দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা বরাদ্দ দেওয়া হলে তা হবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) শাপলাকে তাদের দলীয় প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ দাবি করে আসছে। ইসি তাদের সেই দাবিকে নাকচ করেছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর দলটি ফের ইসিতে আবেদন করেছে। এরপরও ইসি তাদের আগের অবস্থানই তুলে ধরেছে। এ অবস্থায় এনসিপির নেতারা শাপলাকে তাদের দলের দলীয় প্রতীক করা না হলে রাজপথে নামার হুমকি দিয়েছেন।

এনসিপির নেতাদের দাবি, কোনো একটি দলের প্রভাবে কমিশন তাদের শাপলা প্রতীক বরাদ্দ দিতে রাজি হচ্ছে না। এমনকি নির্বাচন কীভাবে হয়, সেটাও দেখে নেবেন বলে এনসিপির একজন নেতা বক্তব্য রেখেছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা প্রতীক নিয়ে রাজনীতিতে উত্তেজনা বিরাজ করছে। আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তারা আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শাপলা দেশের জাতীয় ফুল, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতীক। এটি কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতীক হতে পারে না। একটি রাষ্ট্রের সংবিধান স্বীকৃত জাতীয় প্রতীককে কোনো একটি দলের সম্পদ হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া যায় না। ইসি যদি নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিকে তাদের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে শাপলা বরাদ্দ দেয়, তাহলে যুক্তিসংগত কারণেই অভিযোগ উঠবে এনসিপিকে অন্যায়ভাবে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এর আগে আবেদন করলেও একটি রাজনৈতিক দলকে প্রতীকটি না দেওয়া নিয়েও উঠবে প্রশ্ন। সে কারণেই হয়তো ইসি এমন সিদ্ধন্ত নিয়েছে। ইসির সিদ্ধান্ত না মানাটাও অযৌক্তিক। এনসিপির মতো আরও বহু দল আছে, সবাই যদি ভিন্ন ভিন্ন দাবি তোলে, আর সেটা ইসি যদি না মানে এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে সেসব দলও যদি আন্দোলনে নামে, তাহলে নির্বাচন করাটাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এ প্রসঙ্গে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ মতিন বলেছেন, ‘এনসিপির প্রতীকের ব্যাপারে ইসি আইন মতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতীক সম্পর্কিত বিধি (রুলস) অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় প্রতীক শাপলা হলো রাষ্ট্রের প্রতীক, এটা কেন দলীয় প্রতীক হবে? ইসির সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়াটাও অযৌক্তিক।’ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দলগুলো দলীয় প্রতীক হিসেবে যে কোনো প্রতীকই চাইতে পারে। এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু সেই প্রতীক চাওয়াটা ইসির তালিকা থেকে হওয়া আবশ্যক। জাতীয় নাগরিক পার্টি শাপলা প্রতীক চেয়েছে, এটা তাদের ইচ্ছা। কিন্তু সেটি তো ইসির সংরক্ষিত তালিকার মধ্যে নেই। আর তালিকায় না থাকার যুক্তিও আছে কমিশনের কাছে। এ ছাড়া শাপলা প্রতীকটি এর আগে অন্য রাজনৈতিক দলও চেয়েছে; কিন্তু তাদের দেওয়া হয়নি একই কারণে। সুতরাং দলীয় সিদ্ধান্তে অটল না থেকে এনসিপিকে বিকল্প তালিকা থেকে ভাবা উচিত।

শাপলা নিয়ে বিতর্কের ব্যাপারে ইসির সাবেক আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘এনসিপি ইসি’র সিদ্ধান্ত মানছে না। তাদের পথ অনুসরণ করে অন্য দলগুলোও যদি বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ইসিতে হাজির হয় এবং ইসি যে সিদ্ধান্ত দেয়, সেটা যদি না মানে, তাহলে নির্বাচনের কী হবে? নির্বাচন কমিশনের বহু সিদ্ধান্ত বহু দলের কাছে অপছন্দ হতে পারে, সবাই এনসিপির পথ অনুসরণ করলে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। এনসিপি যে প্রতীক চেয়েছে, সেটা ইসির বিধিতে যেসব চিহ্নিত প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে নেই। তাহলে রাজপথে নামার হুমকি তো অযৌক্তিক।’

এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ আরও বলেছেন, ‘আমাদের ফ্ল্যাগ অ্যান্ড এমব্লেম অর্ডার নামে একটি আইন আছে। সেখানে উল্লেখ আছে, জাতীয় প্রতীক শাপলা। যেহেতু জাতীয় প্রতীক আইন করে বলা হয়েছে শাপলা, এটা অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। এটা শুধু দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা যাবে। অন্য কেউ ব্যবহার করলে তা হবে আইনের লঙ্ঘন’—ইসির সাবেক আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক।

এদিকে জাতীয় প্রতীক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ৪ অনুচ্ছেদে জাতীয় সংগীত, পতাকা ও প্রতীকের ব্যাপারে বলা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদের ৩ উপঅনুচ্ছেদে বলা হয়েছে জাতীয় প্রতীকের ব্যাপারে। সংবিধানের ওই বিধানের আলোকে, ১৯৭২ সালে জাতীয় প্রতীক আদেশও জারি করা হয়। এই বিধিমালায় পতাকা ও প্রতীকের সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং এর অপব্যবহার বা লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। বাহাত্তরের ওই আদেশে জাতীয় প্রতীকের নকশার ব্যাপারে বলা হয়েছে, জাতীয় প্রতীকের কেন্দ্রে পানিতে ভাসমান শাপলা ফুল থাকবে, যা ধানের শীষ ও পাটগাছের পাতা দিয়ে বেষ্টিত থাকবে এবং ওপরে চারটি তারকা থাকবে। এই বিধিমালার বিধান লঙ্ঘন করলে এক বছরের কারাদণ্ড ও ৫০০ টাকা জরিমানারও বিধান রয়েছে।

ইসির সাবেক আইন কর্মকর্তা ও আইনজীবী এবং সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. শাহজাহান সাজু বলেছেন, জাতীয় প্রতীক শাপলা পুরো জাতির সম্পদ। এটা সবার সম্পদ। এটা সংবিধান স্বীকৃত জাতীয় সম্পদ। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক হতে পারে না। এটাকে দলীয় প্রতীক করা হলে, জাতীয় ঐতিহ্য যেগুলো আছে, সেগুলো সবাই তাদের নিজেদের বলে দাবি করে বসবে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালায় যেখানে দলগুলোর নিবন্ধনের কথা বলা আছে, সেখানে দলীয় প্রতীকগুলোও উল্লেখ আছে। সব দলের একটা নিজস্ব প্রতীক আছে। যখন একজনকে একটা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়, তখন সেটা তাদের নিজস্ব প্রতীক হয়ে যায়। এটা আর কেউ নিতে পারে না। সেই প্রতীক নিয়ে সারা দেশে দলটি নির্বাচন করে। যে কারণে একটি জাতির প্রতীককে, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব প্রতীক হতে পারে না। কোনো দলকে এক্সট্রা ফেভার করাও ঠিক হবে না।

জানা যায়, এনসিপি গত ২২ জুন দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্যে ইসিতে আবেদন করে এবং একই সঙ্গে তাদের পছন্দের প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’ সংরক্ষণের অনুরোধ জানায়। গত ৯ জুলাই ইসি ‘শাপলা’ প্রতীককে নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে তালিকাভুক্ত না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘শাপলা’ যেহেতু বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক; তাই এটি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক হতে পারে না। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এনসিপি গত ১৩ জুলাই নির্বাচন কমিশনে একটি লিখিত আবেদন জমা দেয়। আবেদনে তারা যুক্তি দেয় যে, ইসির এই ব্যাখ্যা আইনিভাবে সঠিক নয়। দলটি ইসিকে দেখায়, জাতীয় প্রতীক হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট নকশা, যা শাপলা ফুল, ধানের শীষ, পাট পাতা এবং তারকা সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে ‘ধানের শীষ’ এবং ‘তারা’ প্রতীক দুটি এরই মধ্যে যথাক্রমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলকে (জেএসডি) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় ফল ‘কাঁঠাল’ ও ‘সোনালি আঁশ’ (যা পাটকে নির্দেশ করে) যথাক্রমে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি এবং তৃণমূল বিএনপিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যদি জাতীয় প্রতীকের উপাদানগুলো পৃথকভাবে বরাদ্দ দেওয়া যায়, তাহলে ‘শাপলা’ বরাদ্দ দিতেও কোনো আইনি বাধা নেই।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও দলটির আইন শাখার সদস্য মো. মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন বলেছেন, জাতীয় প্রতীক এককভাবে শাপলা না। শাপলার সঙ্গে ধানের শীষ, তারকা, পাটপাতা রয়েছে। একক না হওয়ায় এটা প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ দিতে বাধা নেই। জাতীয় ফল, জাতীয় পশু—এগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তিনি সংবিধানের ৪ অনুচ্ছেদের ৩ উপঅনুচ্ছেদ তুলে ধরে বলেন, এ বিধান অনুযায়ী ধানের শীষ প্রতীক হতে পারলে শাপলাও দলীয় প্রতীক হতে পারে। আমরা মনে করি, বিশেষ কারও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ইসি এনসিপিকে দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা বরাদ্দ দিতে রাজি হচ্ছে না।

বিএনপির ‘ধানের শীষ’ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির প্রতীক ‘তারকা’ হচ্ছে জাতীয় প্রতীকের অংশ, তাহলে শাপলা কেন এনসিপিকে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না—এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ শাহজাহান সাজু বলেছেন, ছোটকাল থেকেই জাতীয় প্রতীক কোনটি—এই প্রশ্নের জবাবে সবাই কিন্তু শেখে ও বলে, জাতীয় প্রতীক শাপলা। কেউ কিন্তু ধানের শীষ, পাটপাতা বা তারকার কথা বলে না। মূলত শাপলাই হলো জাতীয় প্রতীক, আর অন্যগুলো হলো শাপলার অংশ। অন্যগুলোর সমন্বয় করে জাতীয় প্রতীক করা হয়েছে শাপলাকে। শাপলাকে জাতীয় প্রতীক করতে গিয়ে ধানের শীষ, তারা, পাটপাতা এগুলো আনা হয়েছে, যাতে এগুলো জাতীয় প্রতীককে আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলে। বাহাত্তরের প্রথম লিখিত সংবিধানের প্রস্তাবনায়ও এ শাপলা প্রতীক ছিল। যার কারণে শাপলাকে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা দলের প্রতীক করা যাবে না।

এদিকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘যেহেতু কোনো আইনগত বাধা নেই; তাই এনসিপির মার্কা শাপলাই হতে হবে। অন্য কোনো অপশন নেই। না হলে নির্বাচন কীভাবে হয়, আর কে কীভাবে ক্ষমতায় গিয়ে মধু খাওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেটা আমরাও দেখে নেব।’ এরপর গত ২৫ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেন, ‘এর আগে নাগরিক ঐক্য শাপলা চেয়েছিল। দুইটা চিঠি দিয়েছে। আমার সঙ্গে দেখাও করেছে। কিন্তু আমরা দিইনি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এটা দেওয়া যাবে না, আমরা এ জবাব দিয়ে দিয়েছি। পরে এনসিপি আবেদন করেছে। তারপর বাকি এনসিপিরটা তো আপনারা জানেনই, এটা নিয়ে আমি ব্যাখ্যা করতে চাই না।’ গত ২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে হবিগঞ্জ পৌর টাউন হলে আয়োজিত দলের সমন্বয় সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে সারজিস আলম বলেন, ‘যদি শাপলা প্রতীক না দেওয়া হয়, তবে আমাদের সমাধান হবে রাজপথে।’ দলটি ২০০৮ সালের নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে তাদের পছন্দের প্রতীক—শাপলা, সাদা শাপলা অথবা লাল শাপলা—এর যে কোনো একটি বরাদ্দের দাবি অব্যাহত রেখেছে। দলীয় সিদ্ধান্তে অটল না থেকে এনসিপিকে বিকল্প তালিকা থেকে ভাবা উচিত বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।