কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসন সবসময়ই জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এ আসন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘদিনের আধিপত্য বিস্তারকারী বিএনপির বাইরে এবার চমক হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
স্বাধীনতার পর থেকে আসনটিতে মাত্র দুইবার জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এরপর দীর্ঘদিন এ আসনে বিএনপি আধিপত্য বজায় রাখে। বিএনপির ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পরবর্তীতে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী কাজী শাহ্ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ মুরাদনগরের রাজনীতিতে এক প্রভাবশালী অবস্থান তৈরি করেন।
দীর্ঘ সময় নিষিদ্ধ থাকার পরও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। আগেভাগেই দলটি প্রার্থী ঘোষণা করেছে সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ইউসুফ হাকিম সোহেলকে। আগাম প্রার্থী ঘোষণায় জনগণের কাছে পরিষ্কার বার্তা পৌঁছে গেছে যে জামায়াত এবার গুরুত্ব দিয়ে আসনটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে।
গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় তাদের কর্মীরা ইতোমধ্যেই জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছেন। নির্বাচনী প্রচারণার পাশাপাশি তারা কর্মী ও এজেন্টদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে। এতে তাদের সাংগঠনিক কাঠামো আরও সুসংহত হয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে সাংগঠনিক সমস্যায় ভুগছে। কায়কোবাদ বিদেশে অবস্থান করায় নেতৃত্বের অভাব দেখা দিয়েছিল। এ অবস্থায় মাঠপর্যায়ে বিএনপি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্তমানে তারা পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে, তবে আগের মতো শক্ত অবস্থান ফিরে পাওয়া সহজ নয় বলে মনে করছেন অনেকে।
বিএনপির উপজেলা সভাপতি মহিউদ্দিন অঞ্জন বলেন, “আমাদের নির্বাচনী মাঠ শক্ত অবস্থানে আছে। সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদের নেতৃত্ব দল শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। তিনি পাঁচবার জনগণের রায়ে সংসদে গিয়েছেন এবারও যাবে ইনশাআল্লাহ।”
এর পাশাপাশি নতুন করে আলোচনায় এসেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অভিযোগ উঠেছে, দলটি পতিত ও বিতর্কিত আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসন করছে। এর ফলে বিএনপি ও এনসিপি কর্মীদের মাঝে প্রায়শই সংঘর্ষ হচ্ছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেক নেতা এলাকায় কিশোর গ্যাং তৈরি করে অরাজকতা সৃষ্টি করায় সাধারণ মানুষও অস্থির।
মুরাদনগরের বড় একটি অংশে এখনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। গ্রামীণ সড়ক, চিকিৎসা ব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কৃষি সহায়তায় পিছিয়ে পড়া এলাকা গুলোতে মানুষের ক্ষোভ দিন দিন বাড়ছে। স্থানীয়রা মনে করছেন, দীর্ঘ সময় ধরে একই মুখ সংসদে আসলেও তাদের প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি।
এই উন্নয়নবঞ্চিত জনপদগুলোতে ভোটাররা পরিবর্তনের পক্ষে ঝুঁকতে পারেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আর এ জায়গাটিকেই টার্গেট করছে জামায়াতের প্রার্থী ইউসুফ হাকিম সোহেল। জনগণের দৈনন্দিন সমস্যাগুলোকে সামনে এনে প্রচারণা চালানোয় তিনি অনেক ভোটারকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হচ্ছেন।
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ইউসুফ হাকিম সোহেল বলেন, “আমাদের লক্ষ্য জনতার ভোটাধিকার নিশ্চিত করা৷ জনগন তাদের পছন্দে প্রার্থী বেছে নেবে। আমি জনতার নেতা হতে আসিনি, তাদের খেদমত করতে চাই।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কুমিল্লা-৩ মুরাদনগরের এ আসন শুধু স্থানীয় নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখে। বিএনপি ও জামায়াতের এই দ্বিমুখী লড়াইয়ে শেষ হাসি কার মুখে ফুটবে — তা নির্ভর করছে উন্নয়নবঞ্চিত মানুষের ভোট, শেষ মুহূর্তের কৌশল এবং জনগণের আস্থার উপর।