বর্ষা শেষ হলেও ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এখনো কমছে না। বসন্তের বাতাস বইলেও মশাবাহিত এ রোগটি উল্টো অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। সাধারণত সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু কমতে শুরু করে; কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার ডেঙ্গু রোগী। এ সময় সরকারি হিসাবে মারা গেছেন ২২ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৩ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র উঠে এসেছে।
এখানেই শেষ নয়—শুধু সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৯ দিনেই ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৪৫ জন, যা মৌসুমের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে জুলাই মাসে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যা এতদিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ হিসেবে ধরা হয়েছিল।
জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী দুই মাস অক্টোবর ও নভেম্বর—ডেঙ্গুর প্রকোপ চলবে। এর পেছনে মৌসুমি বায়ু, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং জনসাধারণের অসচেতনতা দায়ী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এখন ডেঙ্গুর প্রভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। যদি এখনই সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি করে কাজ শুরু না করা হয়, তাহলে আগামী কয়েক দশক ধরে এ রোগ গ্রামবাংলায় বড় ধরনের ভোগান্তি তৈরি করতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেছেন, ডেঙ্গু কম না হওয়ার পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, এখনো নিয়মিত বৃষ্টিপাত হচ্ছে, যার ফলে জমে থাকা পানিতে এডিস মশার লার্ভা জন্ম নিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলেও প্লাস্টিকের ব্যবহার ও অপরিকল্পিত বাসস্থান তৈরির ফলে পানি জমে মশা জন্ম নিচ্ছে। তৃতীয়ত, সিটি করপোরেশনের বাইরের পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যকর মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নেই। ফলে গ্রামে এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ১৩ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২২ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কয়েকশ রোগী। ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যান ২ জন, ভর্তি ২৭৯ জন। ১৪ সেপ্টেম্বর মারা যান ৩, ভর্তি হন ৬৮৫। এরপর প্রতিদিনই গড়ে ৫ থেকে ৬ জন মারা গেছেন এবং ৬০০-এর বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন।
চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪০ হাজার ৭০৯ জন। তাদের মধ্যে ৬০ দশমিক ৩ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ নারী। এদের মধ্যে ৩৮ হাজার ৫২৭ জন এরই মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৬৭ জন।
বিভাগভিত্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়, যেখানে ৮৩ জন মারা যান। চট্টগ্রাম ও বরিশালে ২২ জন করে, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৯, রাজশাহীতে ১০, খুলনায় ৫, ময়মনসিংহে ৪ জন এবং ঢাকার সিটি এলাকার বাইরে ২ জন মারা গেছেন।
চলতি বছরের মাসভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হন ১০ হাজার ৬৮৪ জন। আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন, আর সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৮ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯ হাজার ২৩৩ জন। এর বাইরে জানুয়ারিতে ভর্তি হন ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ এবং জুনে ৫৯৫১ জন।
অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেছেন, ‘পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে নভেম্বরে ডেঙ্গু থাকবে। তাই প্রতিটি নাগরিককে সচেতন হতে হবে। ঘর ও আঙিনা পরিষ্কার রাখা, মশা ধ্বংসে ব্যবস্থা নেওয়া, জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং পরীক্ষায় নেগেটিভ এলেও ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখলে চিকিৎসা নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু চিকিৎসার মাধ্যমে ডেঙ্গু রোধ সম্ভব নয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব ইউনিটকে মশক নিধনে দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি এখনই একটি জাতীয় পর্যায়ের ডেঙ্গু গাইডলাইন তৈরি ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ‘যেভাবে গ্রামে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, তা যদি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে আগামী ৩০ থেকে ৪০ বছর এ রোগ গ্রামীণ জনপদে দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগ তৈরি করতে পারে।’
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৯ সেপ্টেম্বর (গতকাল) দেশে ডেঙ্গুতে কারও মৃত্যু হয়নি। তবে একই দিনে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৪৮ জন। এদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৪৩ জন, চট্টগ্রামে ৫৩, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫২, ঢাকা উত্তর সিটিতে ৩১, দক্ষিণ সিটিতে ৫৬, খুলনায় ৩৭ এবং ময়মনসিংহে ১৩ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে ডেঙ্গু নিয়ে মৃত্যু ও রোগীর তথ্য সংরক্ষণ করা হয় ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে ২০২৩ সাল ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ, যখন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন আক্রান্ত হয় এবং মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন।