ঢাকা ০৬:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাঘাটা থানায় ‘হামলাকারী’র অপ মৃত্যু না পরিকল্পিত হত্যা?

গাইবান্ধার সাঘাটা থানায় পুলিশের ওপর ‘হামলা’ এবং পুকুর থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি এখন রহস্যে ঘেরা। পুলিশ বলছে, সে থানায় ঢুকে ছুরিকাঘাত করে পালানোর সময় পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে মারা যায়।
কিন্তু এলাকাবাসী, স্বজন ও সচেতন মহল বলছে—ঘটনার ভেতরে অন্য কিছুর গন্ধ আছে। প্রশ্ন উঠছে—এটি নিছক আত্মরক্ষার চেষ্টা, না কি পূর্বপরিকল্পিত একটি নাটক?

ঘটনাপ্রবাহ সংক্ষেপে:
১৮ জুলাই রাতে সাঘাটা থানায় প্রবেশ করে এক যুবক (পরিচয়: সাজু মিয়া) এএসআই মহসিনকে ছুরিকাঘাত করে এবং অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
ধাওয়া খেয়ে পাশের পুকুরে ঝাঁপ দেন তিনি।
রাতভর নিখোঁজ থাকার পর, সকালে ডুবুরিরা তার লাশ উদ্ধার করে।
পুলিশ বলছে, সে মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলো এবং সাতার জানতো না—তাই ডুবে যায়।

নিহত যুবক সাজু মিয়া (২২), গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি এলাকার বাসিন্দা ও একজন শিক্ষানবীশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক। জানা গেছে, তার কাছে একটি প্রভাবশালী দলের চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও অপরাধমূলক ভিডিও ডকুমেন্ট ছিল, যেগুলো সে প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছিল।
একটি কথোপকথনের রেকর্ডে পাওয়া যায়—সাজু লিখে গিয়েছিলেন,

“আমার সাঘাটা ফুলছড়িতে মৃত্যু হলে দায়ী থাকবে,

পুলিশ বলছে—
সাজু রাতে থানায় মোবাইল ফোন হারানোর জিডি করতে এসেছিল। কিন্তু ৪০ মিনিট পর সে হঠাৎ ছুরি নিয়ে থানার ভিতরে ঢুকে এএসআই মহসিনকে আঘাত করে এবং অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ধাওয়া খেয়ে পাশের পুকুরে ঝাঁপ দেয় এবং সাঁতার না জানার কারণে মারা যায়।

জানা গেছে, সিজু একা নয়, তার সঙ্গে আরেকজন বন্ধু ছিলো, যিনি সিজুর মৃত্যুর পরের দিন সকালে তার বোনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছেন।

সজুর বোন জানান,“আজ সকালে সিজুর বন্ধু ফোন দিয়ে বললো, ‘আপু, সিজু কি বাড়িতে গেছে?’ আমি বললাম, ‘আমি তো শ্বশুরবাড়িতে আছি, বাড়ি গিয়ে দেখি।’ তখন সে আবার বললো, ‘তোদের তো বাড়িতে আসার কথা ছিলো, আমি সিজুকে গাইবান্ধায় নামিয়ে দিয়েছি। আমার গাড়ি নষ্ট, আমি আর যেতে পারবো না।’”

অন্যদিকে সিজুর খালা দাবি করছেন,“গত রাতে সেই বন্ধুই আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে, ‘আমি সিজুকে সাঘাটা রেখে আসছি।’”

দুটি বয়ান—দুটি বিপরীত তথ্য:
এখানে দুটি সময় ও বক্তব্য মিলছে না:

সকালে সে বলছে “গাইবান্ধায় নামিয়ে দিয়েছে”;
আর রাতে বলছে “সাঘাটায় রেখে এসেছে”।
এই দুই বক্তব্যের মাঝে যে স্পষ্ট গরমিল—তাতেই তৈরি হচ্ছে গভীর সন্দেহ ও প্রশ্ন।

কিন্তু এতসব প্রশ্ন কি নিছক কাকতালীয়?
১. ৪০-৫০ কিমি দূর থেকে মোবাইল হারানোর জিডি করতে অন্য থানায় কেন?
সাধারণত মানুষ নিজ থানায় যায় জিডি করতে। সাজু সদর থানার বাসিন্দা, তার বাসা ফুলছড়ি নয়। তাহলে সে সাঘাটা থানায় কেন গিয়েছিল?

২. সাতার না জানার দাবি মিথ্যা
সাজুর বাড়ি নদীর পাড়ে। তিনি নদীতে মাছ ধরতেন, এলাকাবাসীর মতে—সে খুব ভালো সাতার জানতো। তাহলে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েই কিভাবে সঙ্গে সঙ্গে ডুবে গেল?

৩. এত রাতে থানার ভেতরে এত পুলিশ থাকার কথা, কেউ ঠেকাতে পারল না?
পুলিশ বলছে, সে একাই ছুরি নিয়ে থানায় ঢুকে হামলা করেছে। সিসিটিভিতে দেখা যাচ্ছে—ভিতরে ও বাইরে পুলিশসহ লোকজন দাঁড়িয়ে ছিল।
প্রশ্ন: একজন যুবক ছুরি নিয়ে এতগুলো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশের সামনে কিভাবে আক্রমণ করে পালায়?

নাকি সাজানো নাটক? প্রশ্নের ঝড় জনমনে
এলাকাবাসী বলছে, সাজু কিছুদিন ধরে প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছিল।
প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, মোবাইল ক্রয় এবং ঘুষ সংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তার টানাপোড়েন ছিল।
তার নামে থানায় এর আগেও ডেকে আনা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন স্বজনরা।
তাহলে কি হয়েছিল সেদিন রাতে?

স্থানীয় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে—

❝ হয়তো অতিউৎসাহে গুলি করে বা অন্য কোনোভাবে তার মৃত্যু হয়, তারপর লাশ পুকুরে ফেলে সাজানো হয় ‘ঝাঁপ দেওয়ার’ গল্প। ❞
❝ এলাকাবাসীকে বলা হয়, সে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছে। আর সবাই সারা রাত ‘লাশ ভাসার’ অপেক্ষায় পুকুর পাহারা দেয়। ❞
❝ অথচ মরদেহ তলিয়ে থাকে! অথচ, সাধারণ নিয়মে মৃতদেহ কিছুক্ষণের মধ্যে ভেসে ওঠে।

আরো কিছু প্রশ্ন জেগে উঠেছে গাইবান্ধাবাসীর হৃদয়জুড়ে:
১. সে সদরের ছেলে হয়ে সাঘাটার থানায় কেন?
সাজু মিয়ার বাড়ি সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নে। তিনি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ছাত্র। প্রশ্ন হলো—তিনি কেন হঠাৎ অন্য উপজেলার থানায় যাবেন? তার সাঘাটার কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল?

২. নদীর পাড়ের ছেলে সাতার জানে না?
স্থানীয়দের বক্তব্য—“সাজুর বাড়ি নদীর ধারে, সে নিয়মিত মাছ ধরতো। সাতার জানে না—এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
একজন জেলে পরিবারের সন্তান পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে যাবে, এবং লাশ ১০ ঘণ্টা পানির তলায় থাকবে—এটি স্বাভাবিক নয়। অনেকেই বলছেন, পুকুরে ‘ঝাঁপ দেওয়া’ ঘটনাটি সাজানো হতে পারে।

৩. থানার ভিতরে একা ঢুকে পুলিশকে আক্রমণ?
একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্র, যার বিরুদ্ধে কোনো সন্ত্রাসী ইতিহাস নেই, সে একা থানায় ঢুকে পুলিশ আঘাত করবে—এতটা সাহস কোথা থেকে এলো? কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল কি না, অথবা সে নিজে এসেছিল, এসব বিষয়ে এখনো নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি।

অন্যান্য অমিল ও রহস্য:
সারারাত উদ্ধার হলো না কেন?
পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার পর দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা রাতভর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুকুরে সিসিটিভি নেই, ফায়ার সার্ভিস রাতেই আনা হলো না কেন? পুলিশ পুকুর পাহারা দিলেও কেন তাৎক্ষণিক উদ্ধার তৎপরতা চালানো হয়নি?

মরদেহ ভেসে উঠলো না কেন?
সাধারণত মৃতদেহ কিছুক্ষণের মধ্যে পানিতে ভেসে ওঠে। কিন্তু সাজুর মরদেহ পাওয়া গেল পরদিন সকালে তলার নিচে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই—তাকে পুকুরেই মারা হয়েছে না কি পরে ফেলে রাখা হয়েছে?

পুলিশ কেন আগেই বলল সে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’?
ওসি বাদশা আলম বলেন, “সে মানসিক সমস্যায় ভুগছিল।”
প্রশ্ন হলো—ওসি কীভাবে আগে থেকেই জানলেন সাজুর মানসিক অবস্থা? যদি তিনি পূর্ব পরিচিত হন, তাহলে তা তদন্তের বিষয়।

এই প্রশ্নগুলো আমরা ভুলে যেতে পারি না:
একটি থানার ভিতরে কিভাবে এমন ঘটনা ঘটে?
সাজু কি সত্যিই হামলাকারী, না কি ভিন্ন কিছু?
ময়নাতদন্তে যদি শ্বাসরোধ বা মাথায় আঘাত পাওয়া যায়, তাহলে কী দাঁড়াবে?
সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশের দাবি: থানার ভিতর সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। কিন্তু এখনো ভিডিও প্রকাশ হয়নি। এটি প্রকাশ করলেই বোঝা যাবে সাজু নিজেই হামলা করেছিল না কি ভিন্ন কোনো ঘটনা ঘটেছে।
পূর্ব ইতিহাস: স্থানীয়রা বলছে, “সাজুকে আগে থেকেই পুলিশ ডেকে নিয়েছিল।” এমনকি একটি মোবাইল লেনদেনকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়েছিল বলেও সূত্র বলছে।
প্রাথমিক ধারণা: সাজু নিরীহ ছিল। এএসআই বা থানার কারো সঙ্গে কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা আর্থিক চাপের কারণে তাকে থানায় ডেকে এনে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। পরে সেটিকে নাটক হিসেবে সাজিয়ে ‘পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু’ বলা হচ্ছে।
স্থানীয়দের মতামত ও স্বজনদের বক্তব্য:
তার ভাই বলেন,

“সাজু সুস্থ স্বাভাবিক ছেলে ছিল। কয়েকদিন আগেই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে—খুব অমায়িক ব্যবহার। মানসিক সমস্যায় ভোগা তো দূরের কথা, ও কোনোদিনও কারো সঙ্গে তর্ক করে না।”

গাইবান্ধা শোকাহত, সাঘাটাবাসীর একটাই দাবি:
সুষ্ঠু তদন্ত হোক
সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ হোক
ময়নাতদন্তের পূর্ণ রিপোর্ট দেওয়া হোক
পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্ত বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠিত হোক

এই ঘটনার সত্য প্রকাশ হওয়া প্রয়োজন—কারণ স্বচ্ছতা ছাড়া ন্যায়বিচার হয় না।
যে স্বচ্ছতার জন্য জুলাইয়ের তরুণেরা জীবন দিয়েছিল, সেই ন্যায়ের দাবিতে আজও জনগণ সোচ্চার।

প্রতিবেদক: মো: শাহিন মিয়া, ইনভেস্টিগেটিভ ডেস্ক, গাইবান্ধা

(এই রিপোর্টটি বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী, সংবাদসূত্র, স্বজনদের বক্তব্য ও তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি)

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

নওগাঁর চৌদ্দমাইলে ট্রাক সংঘর্ষে নিহত -১

সাঘাটা থানায় ‘হামলাকারী’র অপ মৃত্যু না পরিকল্পিত হত্যা?

আপডেট সময় ০৭:১৪:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

গাইবান্ধার সাঘাটা থানায় পুলিশের ওপর ‘হামলা’ এবং পুকুর থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি এখন রহস্যে ঘেরা। পুলিশ বলছে, সে থানায় ঢুকে ছুরিকাঘাত করে পালানোর সময় পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে মারা যায়।
কিন্তু এলাকাবাসী, স্বজন ও সচেতন মহল বলছে—ঘটনার ভেতরে অন্য কিছুর গন্ধ আছে। প্রশ্ন উঠছে—এটি নিছক আত্মরক্ষার চেষ্টা, না কি পূর্বপরিকল্পিত একটি নাটক?

ঘটনাপ্রবাহ সংক্ষেপে:
১৮ জুলাই রাতে সাঘাটা থানায় প্রবেশ করে এক যুবক (পরিচয়: সাজু মিয়া) এএসআই মহসিনকে ছুরিকাঘাত করে এবং অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
ধাওয়া খেয়ে পাশের পুকুরে ঝাঁপ দেন তিনি।
রাতভর নিখোঁজ থাকার পর, সকালে ডুবুরিরা তার লাশ উদ্ধার করে।
পুলিশ বলছে, সে মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলো এবং সাতার জানতো না—তাই ডুবে যায়।

নিহত যুবক সাজু মিয়া (২২), গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি এলাকার বাসিন্দা ও একজন শিক্ষানবীশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক। জানা গেছে, তার কাছে একটি প্রভাবশালী দলের চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও অপরাধমূলক ভিডিও ডকুমেন্ট ছিল, যেগুলো সে প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছিল।
একটি কথোপকথনের রেকর্ডে পাওয়া যায়—সাজু লিখে গিয়েছিলেন,

“আমার সাঘাটা ফুলছড়িতে মৃত্যু হলে দায়ী থাকবে,

পুলিশ বলছে—
সাজু রাতে থানায় মোবাইল ফোন হারানোর জিডি করতে এসেছিল। কিন্তু ৪০ মিনিট পর সে হঠাৎ ছুরি নিয়ে থানার ভিতরে ঢুকে এএসআই মহসিনকে আঘাত করে এবং অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ধাওয়া খেয়ে পাশের পুকুরে ঝাঁপ দেয় এবং সাঁতার না জানার কারণে মারা যায়।

জানা গেছে, সিজু একা নয়, তার সঙ্গে আরেকজন বন্ধু ছিলো, যিনি সিজুর মৃত্যুর পরের দিন সকালে তার বোনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছেন।

সজুর বোন জানান,“আজ সকালে সিজুর বন্ধু ফোন দিয়ে বললো, ‘আপু, সিজু কি বাড়িতে গেছে?’ আমি বললাম, ‘আমি তো শ্বশুরবাড়িতে আছি, বাড়ি গিয়ে দেখি।’ তখন সে আবার বললো, ‘তোদের তো বাড়িতে আসার কথা ছিলো, আমি সিজুকে গাইবান্ধায় নামিয়ে দিয়েছি। আমার গাড়ি নষ্ট, আমি আর যেতে পারবো না।’”

অন্যদিকে সিজুর খালা দাবি করছেন,“গত রাতে সেই বন্ধুই আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে, ‘আমি সিজুকে সাঘাটা রেখে আসছি।’”

দুটি বয়ান—দুটি বিপরীত তথ্য:
এখানে দুটি সময় ও বক্তব্য মিলছে না:

সকালে সে বলছে “গাইবান্ধায় নামিয়ে দিয়েছে”;
আর রাতে বলছে “সাঘাটায় রেখে এসেছে”।
এই দুই বক্তব্যের মাঝে যে স্পষ্ট গরমিল—তাতেই তৈরি হচ্ছে গভীর সন্দেহ ও প্রশ্ন।

কিন্তু এতসব প্রশ্ন কি নিছক কাকতালীয়?
১. ৪০-৫০ কিমি দূর থেকে মোবাইল হারানোর জিডি করতে অন্য থানায় কেন?
সাধারণত মানুষ নিজ থানায় যায় জিডি করতে। সাজু সদর থানার বাসিন্দা, তার বাসা ফুলছড়ি নয়। তাহলে সে সাঘাটা থানায় কেন গিয়েছিল?

২. সাতার না জানার দাবি মিথ্যা
সাজুর বাড়ি নদীর পাড়ে। তিনি নদীতে মাছ ধরতেন, এলাকাবাসীর মতে—সে খুব ভালো সাতার জানতো। তাহলে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েই কিভাবে সঙ্গে সঙ্গে ডুবে গেল?

৩. এত রাতে থানার ভেতরে এত পুলিশ থাকার কথা, কেউ ঠেকাতে পারল না?
পুলিশ বলছে, সে একাই ছুরি নিয়ে থানায় ঢুকে হামলা করেছে। সিসিটিভিতে দেখা যাচ্ছে—ভিতরে ও বাইরে পুলিশসহ লোকজন দাঁড়িয়ে ছিল।
প্রশ্ন: একজন যুবক ছুরি নিয়ে এতগুলো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশের সামনে কিভাবে আক্রমণ করে পালায়?

নাকি সাজানো নাটক? প্রশ্নের ঝড় জনমনে
এলাকাবাসী বলছে, সাজু কিছুদিন ধরে প্রভাবশালী মহলের দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছিল।
প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, মোবাইল ক্রয় এবং ঘুষ সংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তার টানাপোড়েন ছিল।
তার নামে থানায় এর আগেও ডেকে আনা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন স্বজনরা।
তাহলে কি হয়েছিল সেদিন রাতে?

স্থানীয় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে—

❝ হয়তো অতিউৎসাহে গুলি করে বা অন্য কোনোভাবে তার মৃত্যু হয়, তারপর লাশ পুকুরে ফেলে সাজানো হয় ‘ঝাঁপ দেওয়ার’ গল্প। ❞
❝ এলাকাবাসীকে বলা হয়, সে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছে। আর সবাই সারা রাত ‘লাশ ভাসার’ অপেক্ষায় পুকুর পাহারা দেয়। ❞
❝ অথচ মরদেহ তলিয়ে থাকে! অথচ, সাধারণ নিয়মে মৃতদেহ কিছুক্ষণের মধ্যে ভেসে ওঠে।

আরো কিছু প্রশ্ন জেগে উঠেছে গাইবান্ধাবাসীর হৃদয়জুড়ে:
১. সে সদরের ছেলে হয়ে সাঘাটার থানায় কেন?
সাজু মিয়ার বাড়ি সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নে। তিনি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ছাত্র। প্রশ্ন হলো—তিনি কেন হঠাৎ অন্য উপজেলার থানায় যাবেন? তার সাঘাটার কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল?

২. নদীর পাড়ের ছেলে সাতার জানে না?
স্থানীয়দের বক্তব্য—“সাজুর বাড়ি নদীর ধারে, সে নিয়মিত মাছ ধরতো। সাতার জানে না—এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
একজন জেলে পরিবারের সন্তান পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে যাবে, এবং লাশ ১০ ঘণ্টা পানির তলায় থাকবে—এটি স্বাভাবিক নয়। অনেকেই বলছেন, পুকুরে ‘ঝাঁপ দেওয়া’ ঘটনাটি সাজানো হতে পারে।

৩. থানার ভিতরে একা ঢুকে পুলিশকে আক্রমণ?
একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্র, যার বিরুদ্ধে কোনো সন্ত্রাসী ইতিহাস নেই, সে একা থানায় ঢুকে পুলিশ আঘাত করবে—এতটা সাহস কোথা থেকে এলো? কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল কি না, অথবা সে নিজে এসেছিল, এসব বিষয়ে এখনো নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি।

অন্যান্য অমিল ও রহস্য:
সারারাত উদ্ধার হলো না কেন?
পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার পর দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা রাতভর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুকুরে সিসিটিভি নেই, ফায়ার সার্ভিস রাতেই আনা হলো না কেন? পুলিশ পুকুর পাহারা দিলেও কেন তাৎক্ষণিক উদ্ধার তৎপরতা চালানো হয়নি?

মরদেহ ভেসে উঠলো না কেন?
সাধারণত মৃতদেহ কিছুক্ষণের মধ্যে পানিতে ভেসে ওঠে। কিন্তু সাজুর মরদেহ পাওয়া গেল পরদিন সকালে তলার নিচে। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই—তাকে পুকুরেই মারা হয়েছে না কি পরে ফেলে রাখা হয়েছে?

পুলিশ কেন আগেই বলল সে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’?
ওসি বাদশা আলম বলেন, “সে মানসিক সমস্যায় ভুগছিল।”
প্রশ্ন হলো—ওসি কীভাবে আগে থেকেই জানলেন সাজুর মানসিক অবস্থা? যদি তিনি পূর্ব পরিচিত হন, তাহলে তা তদন্তের বিষয়।

এই প্রশ্নগুলো আমরা ভুলে যেতে পারি না:
একটি থানার ভিতরে কিভাবে এমন ঘটনা ঘটে?
সাজু কি সত্যিই হামলাকারী, না কি ভিন্ন কিছু?
ময়নাতদন্তে যদি শ্বাসরোধ বা মাথায় আঘাত পাওয়া যায়, তাহলে কী দাঁড়াবে?
সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশের দাবি: থানার ভিতর সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। কিন্তু এখনো ভিডিও প্রকাশ হয়নি। এটি প্রকাশ করলেই বোঝা যাবে সাজু নিজেই হামলা করেছিল না কি ভিন্ন কোনো ঘটনা ঘটেছে।
পূর্ব ইতিহাস: স্থানীয়রা বলছে, “সাজুকে আগে থেকেই পুলিশ ডেকে নিয়েছিল।” এমনকি একটি মোবাইল লেনদেনকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়েছিল বলেও সূত্র বলছে।
প্রাথমিক ধারণা: সাজু নিরীহ ছিল। এএসআই বা থানার কারো সঙ্গে কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা আর্থিক চাপের কারণে তাকে থানায় ডেকে এনে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। পরে সেটিকে নাটক হিসেবে সাজিয়ে ‘পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু’ বলা হচ্ছে।
স্থানীয়দের মতামত ও স্বজনদের বক্তব্য:
তার ভাই বলেন,

“সাজু সুস্থ স্বাভাবিক ছেলে ছিল। কয়েকদিন আগেই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে—খুব অমায়িক ব্যবহার। মানসিক সমস্যায় ভোগা তো দূরের কথা, ও কোনোদিনও কারো সঙ্গে তর্ক করে না।”

গাইবান্ধা শোকাহত, সাঘাটাবাসীর একটাই দাবি:
সুষ্ঠু তদন্ত হোক
সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ হোক
ময়নাতদন্তের পূর্ণ রিপোর্ট দেওয়া হোক
পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্ত বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠিত হোক

এই ঘটনার সত্য প্রকাশ হওয়া প্রয়োজন—কারণ স্বচ্ছতা ছাড়া ন্যায়বিচার হয় না।
যে স্বচ্ছতার জন্য জুলাইয়ের তরুণেরা জীবন দিয়েছিল, সেই ন্যায়ের দাবিতে আজও জনগণ সোচ্চার।

প্রতিবেদক: মো: শাহিন মিয়া, ইনভেস্টিগেটিভ ডেস্ক, গাইবান্ধা

(এই রিপোর্টটি বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী, সংবাদসূত্র, স্বজনদের বক্তব্য ও তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তৈরি)