বছর ঘুরে আবারও জুলাই এসেছে। কিন্তু আসে না আমার সেই ভাইটি, যার চোখটি হারিয়ে গেছে প্রতিবাদের মাঠে। ফিরে আসে না সেই প্রতিবাদী হাত কিংবা গুলি খেয়ে নিথর হয়ে যাওয়া শরীরটি। শহীদেরা আসেন না। কিন্তু তারা রেখে গেছেন এমন এক স্মৃতি ও দায়, যা কোনো বিবেকবান মানুষ এড়িয়ে যেতে পারে না।
জুলাই মাস মানেই স্মরণ করিয়ে দেয় রক্তস্নাত রাজপথ, চোখের সামনে জেগে ওঠা মর্গের দৃশ্য। ষাটোর্ধ এক দিনমজুর, যিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও প্রতিবাদের মিছিলে জুড়ে গিয়েছিলেন, তাকেও গুলি করে নিথর করা হয়। একটি ফেলে দেওয়া পানির বোতলের খোঁজ করতে গিয়ে হয়তো তিনি নিজের প্রাণটাই দিয়ে ফেলেছিলেন। এই কী তবে রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের দায় পরিশোধের মূল্য?
দেখি পতাকা বাঁধা এক তরুণীর মুখ, গ্যাসে ঝলসে গেছে তার চোখ-মুখ। দেখছি আহাজারি করা বাবা-মা, ভাই-বোন, যারা এখনো অপেক্ষায় প্রিয়জনের খোঁজে। দেখি সেই নিথর, নীরব দেহগুলো—যারা আর কখনো ‘ভবিষ্যত’ বলে কিছু কল্পনা করতে পারবে না।
এই বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে আমরা কী পেয়েছি?
শুধু কিছু স্লোগান? কিছু প্রেস ব্রিফিং? কিছু টকশো?
না, এটি যে স্বপ্ন ছিলো, আন্দোলন ছিলো, একটি জাতির নবজাগরণের সূত্রপাত ছিলো—তা আজকে কোনো দলিল বা প্রামাণ্য ঘোষণায় রূপ পায়নি। এখনও পর্যন্ত ‘জুলাই বিপ্লব’ কীভাবে শুরু হলো, কেন হলো, কারা নেতৃত্ব দিলো, কী অর্জন করলো এবং কী লক্ষ্য পূরণ বাকি রইলো—তা নিয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা জাতীয় স্বীকৃতি আসেনি।
আর তাই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ আজ সময়ের সবচেয়ে জরুরি দাবি। এমন একটি দিন, যেটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইতিহাসে অনন্য এক অধ্যায় হয়ে থাকবে, তার প্রাতিষ্ঠানিক দলিল নেই—এটা কেবল বিস্ময়ের নয়, জাতির ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ। ঘোষণা না থাকলে ইতিহাস বিকৃত হয়, আন্দোলনের লক্ষ্য হারিয়ে যায়, নেতৃত্ব বিতর্কিত হয় এবং ত্যাগের মর্যাদা অপমানিত হয়।
জুলাই বিপ্লবের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাই এ মুহূর্তে সর্বাধিক জরুরি দাবি হলো—ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে আমাদের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভবিষ্যতের রূপরেখা। এই ঘোষণাপত্র হবে শহীদদের প্রতি আমাদের সম্মিলিত শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতার প্রতীক।
যারা এই বিপ্লবকে রক্তাক্ত করেছে—আওয়ামী রেজিমের ১৭ বছরের হত্যাযজ্ঞ, গুম, কারা নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড—তার প্রতিটি ঘটনার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে। একই সঙ্গে শিক্ষা, প্রশাসন, অর্থনীতি ও আমলাতন্ত্রকে সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
জুলাই বিপ্লব কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, এটি একটি মৌলিক রাষ্ট্রান্তরের সূচনা। এ বিপ্লব আমাদের রাষ্ট্রের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে—নতুন এক বাংলাদেশ গড়ে তোলার ভিত্তি নির্মাণ করেছে।
এই বাংলাদেশ কারো একার নয়—এটি সেই শ্রমজীবী মা, গার্মেন্টস কর্মী বোন, প্রতিবাদী তরুণ, নিখোঁজের বাবা, এবং গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ছাত্রের বাংলাদেশ। এদের রক্তের ঋণ শুধরাতে হলে এখনই প্রয়োজন স্পষ্ট রূপরেখা—একটি ঘোষণাপত্র, যা বলবে, কেন এই বিপ্লব, কারা এর চালক, এবং কী আমাদের লক্ষ্য।
এবারের জুলাই শুধু শোকের স্মরণ নয়—এটি হোক দাবি আদায়ের শপথ।