ঢাকা ০২:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে জনগণের আস্থার শীর্ষে জামায়াত প্রার্থী এ.কে.এম ফখরুদ্দিন রাজী Logo মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ জন নিহত, বাসচালক গ্রেপ্তার Logo নবাগতদের আবাসন সংকট নিরসনে ঢাবি ছাত্রশিবিরের চার দফা দাবি Logo হরিণ শিকারের ফাঁদ বসাতে গিয়ে, নিজেই শিকার দুলাল Logo মব নয়, এটি সাংবাদিকতার ব্যর্থতারে ফল প্রেসার গ্রুপ: প্রেস সচিব Logo এনবিআরের রাজস্ব আদায় ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে Logo ইসরায়েলের ৩১ হাজারেরও বেশি ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইরান Logo ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কখনওই বন্ধ হবে না: ইরাভানি Logo পিআর ইস্যু নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকারীরা দেশের আদর্শে বিশ্বাসী নয়: মঈন খান Logo ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৫-২৬ অর্থবছরে জবির বাজেট ২৯৭ কোটি ৮২ লক্ষ

জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা

ছাত্রশিবির নেতৃবৃন্দ

সততা ও দক্ষতায় প্রজন্ম গড়ার প্রতিজ্ঞায় “জুলাই জাগরণ নব উদ্যমে বিনির্মাণ” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। আজ (সোমবার) বিকেল ৫:৪৫ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন— ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বিপ্লবীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত হয়েছিল জুলাই অভ্যুত্থান। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় রচিত হয়েছিল বিজয়ের ঐতিহাসিক এক উপাখ্যান। জুলাই ছিল ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ, জুলুম ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণের এক বিস্ময়কর জাগরণ।
আধিপত্যবাদী ভারতের প্রেসক্রিপশনে ২০০৯ সালে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ গণহত্যা, লুটপাট, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, অর্থপাচার, সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি ও নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করে দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে। ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে মেধা ও যোগ্যতার পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও প্রশাসনকে দলীয়করণ করে দেশে চূড়ান্তভাবে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করে।

মেধাবীদের উপেক্ষা করে দলীয় লোকবল নিয়োগের একটি কৌশলগত মাধ্যম ছিল বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা। এ দাবিতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের তীব্র ছাত্রআন্দোলনের মুখে সরকার অযৌক্তিক কোটাপ্রথা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ২৪-এর ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেই কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য নানা ধরনের টালবাহানা ও কূটকৌশলের আশ্রয় নেয় শেখ হাসিনা সরকার। এর প্রতিবাদেই শুরু হয় আন্দোলন, যার সাথে যুক্ত হয় বিগত ১৫ বছর ধরে নির্যাতনের শিকার প্রতিটি মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ফলশ্রুতিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, যা ছিল সময়ের অনিবার্য দাবি ও বাস্তবতা।

আন্দোলন প্রশমিত করতে তৎকালীন হাসিনা সরকার বেছে নিয়েছিল পেশিশক্তির মাধ্যমে দমনপীড়নের পথ। দলীয় ক্যাডার ও রাষ্ট্রীয় সকল বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে হাজার হাজার তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, নারী ও শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করে। বাসার ছাদে খেলায় মগ্ন শিশুদেরও হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দেশের রাজপথ, জনপদ এবং ক্যাম্পাস রঞ্জিত হয় ছাত্র-জনতার রক্তে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন রিপোর্ট অনুসারে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২-১৩% ছিল শিশু ।
শুধু মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; মৃতদেহের সঙ্গেও করা হয়েছে নিষ্ঠুরতা অমানবিক আচরণ। হত্যা করার পর লাশ গুম, মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা, লাশ ছুড়ে ফেলে দেওয়া, লাশের ওপর দিয়ে রায়টকার ও গাড়ি চালিয়ে দেওয়ার মতো বর্বরোচিত আচরণ বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করেছে। আহত ব্যক্তিদেরকে হাসপাতালে নিতে বাধা প্রদানের পাশাপাশি দলীয় ক্যাডারদের মাধ্যমে হাসপাতালগুলোকেও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।
সারা দেশে দুই সহস্রাধিক লাশ ও হাজারো মানুষের রক্তের পরও ফ্যাসিস্ট সরকার ভেবে ছিল আন্দোলন প্রত্যাহার করে স্বৈরাচারের বশ্যতা মেনে নিয়ে সবাই ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে ছাত্র-জনতা প্রমাণ করেছে গুলি করে, হত্যা করে বিপ্লবীদের দমন করা যায় না। জুলাই আন্দোলন কোনো একক দলের বা গোষ্ঠীর ছিল না। এটি ছিল ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে প্রতিটি জনপদের প্রত্যেক মানুষ এক কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিল—“দফা এক, দাবি এক, খুনি হাসিনার পদত্যাগ!”

সম্মানিত সাংবাদিকবৃন্দ,
জুলাই অভ্যুত্থানে আন্দোলনের স্পিরিট ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে গণহত্যাকারীদের বিচার, শহীদ পরিবার ও আহতদের পুনর্বাসন, গঠনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রবর্তন, ক্যাম্পাসসমূহে ছাত্র সংসদ-ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কার ও বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশ গঠন। যেখানে নিশ্চিত হবে নাগরিকের ন্যায্য অধিকার, নির্মূল হবে জুলুমতন্ত্র আর প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায় ও ইনসাফের বাংলাদেশ।
আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে উল্লেখ করছি যে, ৫ আগস্ট অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সন্ধিক্ষণে কিছু ব্যক্তি ও দল জুলাইয়ের স্পিরিটকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। যেখানে ছোটখাটো বিভেদকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় ঐক্য অটুট রাখাই হচ্ছে প্রধান দায়িত্ব, সেখানে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, অপপ্রচার, দায় চাপানো, অহেতুক ও এখতিয়ারবহির্ভূত বক্তব্যের মাধ্যমে বিভাজন তৈরি করছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংস্কার। কিন্তু দেশের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোতে এখনও গণহত্যার সহযোগীরা স্বপদে বহাল রয়েছে। সচিবালয়সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতেও গণহত্যাকারী খুনি হাসিনার দোসরদের উসকানিতে অনাকাঙ্ক্ষিত বিভিন্ন আন্দোলন তৈরি করা হচ্ছে। বিচার কাজে দীর্ঘসূত্রিতা, মামলা বাণিজ্যের মাধ্যমে আসামিদের জামিনে মুক্তি দেওয়া এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী খুনিদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে।

শুধু তাই নয়, অবস্থাদৃষ্টে অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগছে, বাংলাদেশ কি আবার উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে? চাঁদাবাজি, দখলদারি, ছিনতাই, ধর্ষণ, অন্তঃকোন্দল, হত্যা, শিক্ষার্থী নির্যাতন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি ইত্যাদি পুরোনো কায়দায় আবারও শুরু হয়েছে ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম। অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার এসব অপকর্ম থামাতে অনেকাংশেই উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছে। জুলাইসহ বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী সন্ত্রাসের শিকার শহীদ পরিবার, আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের বিষয়ে আশানুরূপ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বিগত আওয়ামী রেজিমের সময় ছাত্রশিবিরের গুম হওয়া ৭ জন ভাইকে ফিরে পেতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।

জুলাইয়ের ১ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে, অথচ জুলাই সনদ ঘোষণা করতে পারেনি সরকার। আমরা মনে করি, সকল অপতৎপরতার ঊর্ধ্বে জুলাই অভ্যুত্থানকে বিজয় ও বিপ্লবে রূপান্তর করতে প্রয়োজন জুলাই ঘোষণাপত্র। যেখানে জুলাই আন্দোলনে শহীদ, আহত-পঙ্গুত্ববরণকারী ও অংশগ্রহণকারী সকল পক্ষের স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। ফ্যাসিবাদী আমলে সংঘটিত পল্টন ট্র্যাজেডি, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা গণহত্যা, গুম, অবৈধ নির্বাচনসহ সকল অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে হবে। দেশের সঠিক ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে।

শহীদদে নিয়ে যখন বিভিন্ন মহল দলীয়করণ ও ক্রেডিটের রাজনীতি করার চেষ্টা করছে, ঠিক তখন জুলাই স্পিরিটকে ধরে রাখতে ছাত্রশিবির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি ছাত্রশিবির ধারাবাহিকভাবে জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে নানাবিধ অর্থবহ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। গায়েবানা জানাজা, কবর জিয়ারত, শহীদ পরিবারের খোঁজখবর, সহযোগিতা, ঈদ ও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে শহীদ পরিবারের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ, “ফ্রেমবন্দি ৩৬ জুলাই” শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, গণহত্যার বিচারের দাবিতে সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন, জুলাই স্মৃতিলিখন প্রতিযোগিতাসহ ছাত্রশিবির ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।
এরই অংশ হিসেবে জুলাইয়ের স্মৃতিকে ধারণ, গণহত্যার বিচার নিশ্চিতকরণ, জাতীয় ঐক্য সুসংহত করতে সততা ও দক্ষতায় প্রজন্ম গড়ার প্রতিজ্ঞায় “জুলাই জাগরণ নব উদ্যমে বিনির্মাণ” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করছি।

কর্মসূচিসমূহ :
১. সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, রিসার্চ কনফারেন্স, আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন।
২. শহীদদের কবর জিয়ারত, শহীদ পরিবার ও আহতদের সাথে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়। শাখাভিত্তিক জুলাই গণহত্যার বিচারের দাবিতে “জুলাই দ্রোহ” শিরোনামে বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন।
৩. সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক প্লেসে “জুলাই জাগরণ নব উদ্যমে বিনির্মাণ” শীর্ষক আলোকচিত্র ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী এবং কালচারাল ফেস্ট আয়োজন।
৪. জুলাই গ্রাফিতি অঙ্কন।
৫. জুলাইয়ের গল্প ও স্মৃতি বলা, স্মৃতিলিখন, বক্তব্য, রচনা, বিতর্ক, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রভৃতি আয়োজন।
৬. শহীদদের নামে লাইব্রেরি/পাঠাগার প্রতিষ্ঠা।
৭. শহীদ পরিবার, আহত ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী গাজীদের নিয়ে “ত্যাগীদের চোখে আগামীর বাংলাদেশ” শীর্ষক সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও পডকাস্টের আয়োজন।
৮. জুলাইয়ের ওপর সাহিত্য সাময়িকী ও বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ।
৯. জুলাই স্মৃতি লিখন প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদান ও জুলাই প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন ও প্রদর্শনী।
১০. “Think Back to 36 July” শিরোনামে ৩৬ দিনব্যাপী অনলাইন ক্যাম্পেইন।

জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ কেবল স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়নি; তারা জাতির সামনে একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন তুলে ধরেছে। সেই নতুন কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গঠনে প্রয়োজন সৎ, দক্ষ এবং দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব, যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। ছাত্ররাজনীতি হলো প্রত্যাশিত জাতীয় নেতৃত্ব গঠনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ১৯৪৭ সালে থেকে শুরু করে আজ অবধি বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশজুড়ে আছে ছাত্ররাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
দেশ ও জাতি গঠনের জন্য সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থা ও ছাত্ররাজনীতির সংস্কার। ছাত্র সংসদভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির ধারা চালুর মাধ্যমেই কেবল সেই সংস্কার অর্থবহ হতে পারে। ছাত্র সংসদ হলো শিক্ষার্থীদের এক বৈধ প্লাটফর্ম, যেখানে তারা ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে ন্যায্য দাবি আদায় করে থাকে। নির্বাচিত প্রতিনিধিও শিক্ষার্থীদের নিকট দায়বদ্ধ থাকে। ফলে শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার ও লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির সংস্কৃতির অবসান ঘটে এবং মুক্তবাক, স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতৃত্ব ও ছাত্রবান্ধব ছাত্ররাজনীতির বিকাশ লাভ করে।
১৯৯০ সালের পর সর্বশেষ ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েমের দুরভিসন্ধি।
স্বৈরাচার পতনের পর একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখন সময়ের দাবি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে আগ্রহ দেখালেও একটি গোষ্ঠী নির্বাচনকে বানচাল করতে নানা রকম ষড়যন্ত্র করছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ককটেল বিস্ফোরণ, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও অদৃশ্য ইশারায় নির্বাচন দিতে গড়িমসি করছে, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ছাত্র সংসদ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা ফ্যাসিবাদী আচরণের বহিঃপ্রকাশ, যা দেশপ্রেমিক সচেতন ছাত্রসমাজ কখনোই মেনে নেবে না। আমরা অতিদ্রুতই সকল ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা ও তার আলোকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি।

সম্প্রতি আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি যে, ধর্ষণের মতো ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ৮ বছরের শিশু আছিয়া, গণঅভ্যুত্থানের শহীদ জসিম উদ্দিনের মেয়ে লামিয়া ও গতকাল এক হিন্দু যুবতি ছাড়াও সারা দেশে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী, গৃহবধূ, গৃহকর্মীসহ অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। যার অধিকাংশ ঘটছে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়। পাশাপাশি ৫ আগস্ট পরবর্তী বিভিন্ন ক্যাম্পাসে পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরির অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, আধিপত্য বিস্তার এবং লাশের রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে নানা রকম স্লোগান দিয়ে ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করছে কিছু গোষ্ঠী। আমরা অবিলম্বে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ক্যাম্পাস প্রশাসনের নিকট অনুরোধ জানাচ্ছি।

আমরা বিশ্বাস করি, একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রয়োজন সততা, দক্ষতা ও দেশপ্রেম, প্রয়োজন এমন একটি প্রজন্ম, যারা হবে যোগ্য নেতৃত্বের ধারক ও বাহক; যাদের প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিফলিত হবে মেধা ও নৈতিকতার স্বাক্ষর, থাকবে জবাবদিহিতার অনুভূতি। যারা জুলাইয়ের স্পিরিটকে বুকে ধারণ করে অসীম সাহসিকতার সাথে শত বাধা অতিক্রম করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নব উদ্যমে এগিয়ে যাবে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে থাকবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, থাকবে রাজনৈতিক সহনশীলতা। যেখানে থাকবে না ভেদাভেদ ও বৈষম্য। শাসনব্যবস্থা হবে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল।

আমরা শহীদদের স্বপ্নের আলোকে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা,ফ্যাসিবাদের বিলোপ, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সকল নাগরিকের জন্য নিরাপদ,মর্যাদাপূর্ণ ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সবাইকে আবারও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। আগামীর বাংলাদেশ হবে বৈষম্যহীন, সম্প্রীতির ‘সবার বাংলাদেশ’। ৩৬ দিনব্যাপী এই কর্মসূচি পালনে ছাত্রশিবিরের জনশক্তি, শুভাকাঙ্ক্ষী ছাত্রসমাজসহ দেশবাসীকে সহযোগিতা করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম, কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ, প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদ, আন্তর্জাতিক সম্পাদক মু. মু’তাসিম বিল্লাহ শাহেদী, প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাইদুল ইসলাম, ছাত্র অধিকার সম্পাদক আমিরুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মহানগরীর নেতৃবৃন্দ এতে উপস্থিত ছিলেন।

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে জনগণের আস্থার শীর্ষে জামায়াত প্রার্থী এ.কে.এম ফখরুদ্দিন রাজী

জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা

আপডেট সময় ০৮:১৭:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫

সততা ও দক্ষতায় প্রজন্ম গড়ার প্রতিজ্ঞায় “জুলাই জাগরণ নব উদ্যমে বিনির্মাণ” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। আজ (সোমবার) বিকেল ৫:৪৫ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন— ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বিপ্লবীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত হয়েছিল জুলাই অভ্যুত্থান। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় রচিত হয়েছিল বিজয়ের ঐতিহাসিক এক উপাখ্যান। জুলাই ছিল ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ, জুলুম ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণের এক বিস্ময়কর জাগরণ।
আধিপত্যবাদী ভারতের প্রেসক্রিপশনে ২০০৯ সালে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ গণহত্যা, লুটপাট, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, অর্থপাচার, সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি ও নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করে দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে। ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে মেধা ও যোগ্যতার পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও প্রশাসনকে দলীয়করণ করে দেশে চূড়ান্তভাবে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করে।

মেধাবীদের উপেক্ষা করে দলীয় লোকবল নিয়োগের একটি কৌশলগত মাধ্যম ছিল বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা। এ দাবিতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের তীব্র ছাত্রআন্দোলনের মুখে সরকার অযৌক্তিক কোটাপ্রথা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ২৪-এর ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেই কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য নানা ধরনের টালবাহানা ও কূটকৌশলের আশ্রয় নেয় শেখ হাসিনা সরকার। এর প্রতিবাদেই শুরু হয় আন্দোলন, যার সাথে যুক্ত হয় বিগত ১৫ বছর ধরে নির্যাতনের শিকার প্রতিটি মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ফলশ্রুতিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, যা ছিল সময়ের অনিবার্য দাবি ও বাস্তবতা।

আন্দোলন প্রশমিত করতে তৎকালীন হাসিনা সরকার বেছে নিয়েছিল পেশিশক্তির মাধ্যমে দমনপীড়নের পথ। দলীয় ক্যাডার ও রাষ্ট্রীয় সকল বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে হাজার হাজার তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, নারী ও শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করে। বাসার ছাদে খেলায় মগ্ন শিশুদেরও হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দেশের রাজপথ, জনপদ এবং ক্যাম্পাস রঞ্জিত হয় ছাত্র-জনতার রক্তে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন রিপোর্ট অনুসারে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২-১৩% ছিল শিশু ।
শুধু মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; মৃতদেহের সঙ্গেও করা হয়েছে নিষ্ঠুরতা অমানবিক আচরণ। হত্যা করার পর লাশ গুম, মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা, লাশ ছুড়ে ফেলে দেওয়া, লাশের ওপর দিয়ে রায়টকার ও গাড়ি চালিয়ে দেওয়ার মতো বর্বরোচিত আচরণ বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করেছে। আহত ব্যক্তিদেরকে হাসপাতালে নিতে বাধা প্রদানের পাশাপাশি দলীয় ক্যাডারদের মাধ্যমে হাসপাতালগুলোকেও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।
সারা দেশে দুই সহস্রাধিক লাশ ও হাজারো মানুষের রক্তের পরও ফ্যাসিস্ট সরকার ভেবে ছিল আন্দোলন প্রত্যাহার করে স্বৈরাচারের বশ্যতা মেনে নিয়ে সবাই ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে ছাত্র-জনতা প্রমাণ করেছে গুলি করে, হত্যা করে বিপ্লবীদের দমন করা যায় না। জুলাই আন্দোলন কোনো একক দলের বা গোষ্ঠীর ছিল না। এটি ছিল ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে প্রতিটি জনপদের প্রত্যেক মানুষ এক কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিল—“দফা এক, দাবি এক, খুনি হাসিনার পদত্যাগ!”

সম্মানিত সাংবাদিকবৃন্দ,
জুলাই অভ্যুত্থানে আন্দোলনের স্পিরিট ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে গণহত্যাকারীদের বিচার, শহীদ পরিবার ও আহতদের পুনর্বাসন, গঠনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রবর্তন, ক্যাম্পাসসমূহে ছাত্র সংসদ-ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কার ও বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশ গঠন। যেখানে নিশ্চিত হবে নাগরিকের ন্যায্য অধিকার, নির্মূল হবে জুলুমতন্ত্র আর প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায় ও ইনসাফের বাংলাদেশ।
আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে উল্লেখ করছি যে, ৫ আগস্ট অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সন্ধিক্ষণে কিছু ব্যক্তি ও দল জুলাইয়ের স্পিরিটকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। যেখানে ছোটখাটো বিভেদকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় ঐক্য অটুট রাখাই হচ্ছে প্রধান দায়িত্ব, সেখানে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, অপপ্রচার, দায় চাপানো, অহেতুক ও এখতিয়ারবহির্ভূত বক্তব্যের মাধ্যমে বিভাজন তৈরি করছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সংস্কার। কিন্তু দেশের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোতে এখনও গণহত্যার সহযোগীরা স্বপদে বহাল রয়েছে। সচিবালয়সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতেও গণহত্যাকারী খুনি হাসিনার দোসরদের উসকানিতে অনাকাঙ্ক্ষিত বিভিন্ন আন্দোলন তৈরি করা হচ্ছে। বিচার কাজে দীর্ঘসূত্রিতা, মামলা বাণিজ্যের মাধ্যমে আসামিদের জামিনে মুক্তি দেওয়া এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী খুনিদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে।

শুধু তাই নয়, অবস্থাদৃষ্টে অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগছে, বাংলাদেশ কি আবার উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে? চাঁদাবাজি, দখলদারি, ছিনতাই, ধর্ষণ, অন্তঃকোন্দল, হত্যা, শিক্ষার্থী নির্যাতন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি ইত্যাদি পুরোনো কায়দায় আবারও শুরু হয়েছে ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম। অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার এসব অপকর্ম থামাতে অনেকাংশেই উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছে। জুলাইসহ বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী সন্ত্রাসের শিকার শহীদ পরিবার, আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের বিষয়ে আশানুরূপ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বিগত আওয়ামী রেজিমের সময় ছাত্রশিবিরের গুম হওয়া ৭ জন ভাইকে ফিরে পেতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।

জুলাইয়ের ১ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে, অথচ জুলাই সনদ ঘোষণা করতে পারেনি সরকার। আমরা মনে করি, সকল অপতৎপরতার ঊর্ধ্বে জুলাই অভ্যুত্থানকে বিজয় ও বিপ্লবে রূপান্তর করতে প্রয়োজন জুলাই ঘোষণাপত্র। যেখানে জুলাই আন্দোলনে শহীদ, আহত-পঙ্গুত্ববরণকারী ও অংশগ্রহণকারী সকল পক্ষের স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। ফ্যাসিবাদী আমলে সংঘটিত পল্টন ট্র্যাজেডি, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা গণহত্যা, গুম, অবৈধ নির্বাচনসহ সকল অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে হবে। দেশের সঠিক ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে।

শহীদদে নিয়ে যখন বিভিন্ন মহল দলীয়করণ ও ক্রেডিটের রাজনীতি করার চেষ্টা করছে, ঠিক তখন জুলাই স্পিরিটকে ধরে রাখতে ছাত্রশিবির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি ছাত্রশিবির ধারাবাহিকভাবে জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে নানাবিধ অর্থবহ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। গায়েবানা জানাজা, কবর জিয়ারত, শহীদ পরিবারের খোঁজখবর, সহযোগিতা, ঈদ ও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে শহীদ পরিবারের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ, “ফ্রেমবন্দি ৩৬ জুলাই” শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, গণহত্যার বিচারের দাবিতে সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন, জুলাই স্মৃতিলিখন প্রতিযোগিতাসহ ছাত্রশিবির ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে।
এরই অংশ হিসেবে জুলাইয়ের স্মৃতিকে ধারণ, গণহত্যার বিচার নিশ্চিতকরণ, জাতীয় ঐক্য সুসংহত করতে সততা ও দক্ষতায় প্রজন্ম গড়ার প্রতিজ্ঞায় “জুলাই জাগরণ নব উদ্যমে বিনির্মাণ” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করছি।

কর্মসূচিসমূহ :
১. সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, রিসার্চ কনফারেন্স, আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন।
২. শহীদদের কবর জিয়ারত, শহীদ পরিবার ও আহতদের সাথে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়। শাখাভিত্তিক জুলাই গণহত্যার বিচারের দাবিতে “জুলাই দ্রোহ” শিরোনামে বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন।
৩. সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক প্লেসে “জুলাই জাগরণ নব উদ্যমে বিনির্মাণ” শীর্ষক আলোকচিত্র ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী এবং কালচারাল ফেস্ট আয়োজন।
৪. জুলাই গ্রাফিতি অঙ্কন।
৫. জুলাইয়ের গল্প ও স্মৃতি বলা, স্মৃতিলিখন, বক্তব্য, রচনা, বিতর্ক, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রভৃতি আয়োজন।
৬. শহীদদের নামে লাইব্রেরি/পাঠাগার প্রতিষ্ঠা।
৭. শহীদ পরিবার, আহত ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী গাজীদের নিয়ে “ত্যাগীদের চোখে আগামীর বাংলাদেশ” শীর্ষক সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও পডকাস্টের আয়োজন।
৮. জুলাইয়ের ওপর সাহিত্য সাময়িকী ও বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ।
৯. জুলাই স্মৃতি লিখন প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদান ও জুলাই প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন ও প্রদর্শনী।
১০. “Think Back to 36 July” শিরোনামে ৩৬ দিনব্যাপী অনলাইন ক্যাম্পেইন।

জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ কেবল স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়নি; তারা জাতির সামনে একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন তুলে ধরেছে। সেই নতুন কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গঠনে প্রয়োজন সৎ, দক্ষ এবং দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব, যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। ছাত্ররাজনীতি হলো প্রত্যাশিত জাতীয় নেতৃত্ব গঠনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ১৯৪৭ সালে থেকে শুরু করে আজ অবধি বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশজুড়ে আছে ছাত্ররাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
দেশ ও জাতি গঠনের জন্য সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থা ও ছাত্ররাজনীতির সংস্কার। ছাত্র সংসদভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির ধারা চালুর মাধ্যমেই কেবল সেই সংস্কার অর্থবহ হতে পারে। ছাত্র সংসদ হলো শিক্ষার্থীদের এক বৈধ প্লাটফর্ম, যেখানে তারা ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে ন্যায্য দাবি আদায় করে থাকে। নির্বাচিত প্রতিনিধিও শিক্ষার্থীদের নিকট দায়বদ্ধ থাকে। ফলে শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার ও লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির সংস্কৃতির অবসান ঘটে এবং মুক্তবাক, স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতৃত্ব ও ছাত্রবান্ধব ছাত্ররাজনীতির বিকাশ লাভ করে।
১৯৯০ সালের পর সর্বশেষ ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েমের দুরভিসন্ধি।
স্বৈরাচার পতনের পর একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখন সময়ের দাবি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে আগ্রহ দেখালেও একটি গোষ্ঠী নির্বাচনকে বানচাল করতে নানা রকম ষড়যন্ত্র করছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ককটেল বিস্ফোরণ, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও অদৃশ্য ইশারায় নির্বাচন দিতে গড়িমসি করছে, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ছাত্র সংসদ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা ফ্যাসিবাদী আচরণের বহিঃপ্রকাশ, যা দেশপ্রেমিক সচেতন ছাত্রসমাজ কখনোই মেনে নেবে না। আমরা অতিদ্রুতই সকল ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা ও তার আলোকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি।

সম্প্রতি আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি যে, ধর্ষণের মতো ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ৮ বছরের শিশু আছিয়া, গণঅভ্যুত্থানের শহীদ জসিম উদ্দিনের মেয়ে লামিয়া ও গতকাল এক হিন্দু যুবতি ছাড়াও সারা দেশে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী, গৃহবধূ, গৃহকর্মীসহ অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। যার অধিকাংশ ঘটছে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়। পাশাপাশি ৫ আগস্ট পরবর্তী বিভিন্ন ক্যাম্পাসে পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরির অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, আধিপত্য বিস্তার এবং লাশের রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে নানা রকম স্লোগান দিয়ে ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করছে কিছু গোষ্ঠী। আমরা অবিলম্বে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ক্যাম্পাস প্রশাসনের নিকট অনুরোধ জানাচ্ছি।

আমরা বিশ্বাস করি, একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রয়োজন সততা, দক্ষতা ও দেশপ্রেম, প্রয়োজন এমন একটি প্রজন্ম, যারা হবে যোগ্য নেতৃত্বের ধারক ও বাহক; যাদের প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিফলিত হবে মেধা ও নৈতিকতার স্বাক্ষর, থাকবে জবাবদিহিতার অনুভূতি। যারা জুলাইয়ের স্পিরিটকে বুকে ধারণ করে অসীম সাহসিকতার সাথে শত বাধা অতিক্রম করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নব উদ্যমে এগিয়ে যাবে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে থাকবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, থাকবে রাজনৈতিক সহনশীলতা। যেখানে থাকবে না ভেদাভেদ ও বৈষম্য। শাসনব্যবস্থা হবে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল।

আমরা শহীদদের স্বপ্নের আলোকে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা,ফ্যাসিবাদের বিলোপ, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সকল নাগরিকের জন্য নিরাপদ,মর্যাদাপূর্ণ ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সবাইকে আবারও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। আগামীর বাংলাদেশ হবে বৈষম্যহীন, সম্প্রীতির ‘সবার বাংলাদেশ’। ৩৬ দিনব্যাপী এই কর্মসূচি পালনে ছাত্রশিবিরের জনশক্তি, শুভাকাঙ্ক্ষী ছাত্রসমাজসহ দেশবাসীকে সহযোগিতা করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম, কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ, প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান আজাদ, আন্তর্জাতিক সম্পাদক মু. মু’তাসিম বিল্লাহ শাহেদী, প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাইদুল ইসলাম, ছাত্র অধিকার সম্পাদক আমিরুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মহানগরীর নেতৃবৃন্দ এতে উপস্থিত ছিলেন।