ঢাকা ০৮:১০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিএনপিতে আটকে যাচ্ছে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক

দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে বিএনপি-জামায়াত, এনসিপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। উচ্চকক্ষে এমপি হবেন ১০০ জন। জামায়াত-এনসিপি, এবিপার্টিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল চাচ্ছে নিম্নকক্ষে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হোক। কিন্তু বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি দল এতে রাজি নয়। বিএনপি বলছে, নিম্নকক্ষে নির্বাচিত এমপিদের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত হোক।গতকাল রোববার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সপ্তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে গতকালসহ মোট চার দিন সংসদের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্ব কিভাবে হবে-তা নিয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি কমিশন।

শুধু এটাই নয়, ঐকমত্য কমিশনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি নিয়ে। দুই দিন এই কমিটি নিয়ে আলোচনা হয় কমিশনের বৈঠকে। জামায়াত-এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, ডান-বাম রাজনৈতিক দল ও জোট চায় নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন- এই ছয় কমিশন নিয়োগ দেবে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি। জামায়াত-এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ ডান ও বামপন্থী অধিকাংশ রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবে একমত পোষণ করেছে। কিন্তু গত সপ্তাহ কমিশনের বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা শেষে বিএনপির বিরোধিতায় তা আটকে যায়। গতকালের বৈঠকেও দীর্ঘ আলোচনার ফল শূন্য। বিএনপি সরাসরি ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ গঠনের বিপক্ষে মত দিয়েছে। ফলে দিন শেষে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ছাড়াই গতকালের বৈঠক মুলতবি করা হয়। আগামী বুধবার ফের কমিশনের বৈঠক বসবে।

বিকেলে কমিশনের বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে, প্রাপ্ত ভোটের মাধ্যমে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট করার জন্য বেশির ভাগ দল মতামত দিয়েছে। কিছু কিছু দল এই বিষয়ে সুস্পষ্ট আপত্তি জানিয়েছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যেহেতু দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট গঠনে আগ্রহী আছে সেক্ষেত্রে ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একমত হতে পারব। যেসব দল এই বিষয়ে আপত্তি আছে তারা জানিয়েছে আবারো এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে।

তিনি বলেন, দ্বিতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল- জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করার জন্য। প্রস্তাবের পর অনেক রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবটি সমর্থন করছে না। তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি নামে নতুন কমিটি করার প্রস্তাব করেছিলাম। সেখানে এনসিসির যেসব দায়দায়িত্ব ছিল, তা সীমিত করে কাঠামোগত দিক পরিবর্তন করা হয়। যেসব রাজনৈতিক দল কমিটিকে স্বাগত জানিয়েছিল তারা এর বিস্তারিত জানতে চেয়েছিল আমরা তার পরিপ্রেক্ষিতে আজকে নতুন কাঠামোগত দিকের প্রস্তাব তুলে ধরেছি।

আলী রীয়াজ বলেন, আমরা বলেছি এই নিয়োগ কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে ছয় কমিশনের প্রধান ও সদস্য নিয়োগ ও এ ছাড়া আইনের দ্বারা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করবে। এগুলো হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মনে করে এই কমিশনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশে একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রগঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

তিনি বলেন, কাঠামোগত দিক থেকে চিন্তা করে বলেছি- যখন সংসদ বহাল থাকবে তখন কমিটি কিভাবে কাজ করবে সেটা বলেছিলাম। তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার যদি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়-উচ্চকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা ও অন্য বিরোধী দলগুলোর নির্বাচিত একজন প্রতিনিধি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, এনসিসিতে আমাদের প্রস্তাব ছিল- রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির অন্তর্ভুক্তি। সেটা যেহেতু অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। সেই জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেখান থেকে সরে এসে প্রস্তাব দিয়েছিলাম রাষ্ট্রপতির একজন প্রতিনিধি আমরা সুনির্দিষ্ট করেছি। আমরা বলেছি সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতাসম্পূর্ণ্য কোনো ব্যক্তি ও প্রজাতন্তের কর্মে লিপ্ত এমন ব্যক্তি নয় মনোনয়নের পূর্বে ১০ বছর কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয় বা কোনো সংগঠনের সদস্য নয় এমন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি পাঠাতে পারবেন। প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধির ক্ষেত্রে আমরা বলেছি তার মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, কাঠামোগত দিক থেকে এটাই আমরা প্রস্তাব করেছি। নিম্নকক্ষের স্পিকার সভায় সভাপতিত্ব করবেন।

তিনি বলেন, এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্য একটি বিষয় আসছে- যখন সংসদ বহাল থাকবে না তার মানে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে তখন কী হবে। আমাদের দিক থেকে প্রস্তাব ছিল এটা অব্যাহত রাখার। এই কমিটি অন্য পরিবর্তন করে বিরোধী দলের যেসব সদস্য ছিল তাদের পরিবর্তে উপদেষ্টা পরিষদের একজন করে প্রতিনিধি দেয়া। আরো আলোচনায় যেটা স্পষ্ট হয়েছে, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যারা এই কমিটিকে সমর্থন করে তারা মনে করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে এই কমিটি বহাল রাখার প্রয়োজন নেই। প্রশ্ন ওঠে ওই সময় নির্বাচন কমিশনে কিভাবে নিয়োগ হবে- আলোচনা করে অনেকে প্রস্তাব করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে সীমিতভাবে দেয়া যায়। অন্য কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়কের হাতে ক্ষমতা থাকবে না।

তিনি বলেন, এই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে বুঝা যায়, এ ধরনের একটি কাঠামোর ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমর্থন আছে। কাঠামোগত ক্ষেত্রে আরেকটু আলোচনা ও সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। যেসব দল এখনো এই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে তাদেরকে অনুরোধ করেছি- পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ আছে কি না। আশা করছি যেসব দল এখন পর্যন্ত একমত হতে পারছেন না তারা এগুলো পুনর্বিবেচনা করবে।

দেশের স্বার্থে সংস্কার আলোচনার অগ্রগতি প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি কমিশনের সহসভাপতি বলেন, আমরা কেউ পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে চাই না। তাই দেশের স্বার্থে আপনারা বিষয়টি বিবেচনা করুন। যে অঙ্গীকার নিয়ে আমরা গত জুলাইয়ে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, তার কতটা অর্জিত হয়েছে? আমরা কি শুধু নিজের ও দলের স্বার্থ চাইব, নাকি দেশের স্বার্থও দেখব? আমরা আশা করি বেশির ভাগ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে নিয়ে আসতে পারব। কমিশন হতে আগামী বুধবার পরবর্তী আলোচনার দিন ধার্য করা হয়েছে।

জুলাই সনদ স্বাক্ষরে বিএনপি সবচেয়ে বেশি আন্তরিকতা দেখিয়েছে : সালাহউদ্দিন

কমিশনের সাথে বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটির বিষয়ে আমাদের বক্তব্য আগের মতোই। আমরা সাংবিধানিক বিভিন্ন সংস্থা কমিশন ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা কয়েকটি নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের মতামত আগে যেভাবে ছিল এখনো তেমনই আছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের বিদ্যমান আইনে অনেক সংস্কার প্রয়োজন। আমরা প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের নিজস্ব, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চয়তা বিধান করতে চাই। একইসাথে একটি শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের এই কথাগুলো আমরা বলেছি। আমাদের দলীয় প্রস্তাব যেটা আমাদের ৩১ দফা ছিল সেই প্রস্তাবই আমরা আবার দিয়েছি।

এক প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দীন আহমেদ বলেন, এখন পর্যন্ত জুলাই সনদ বলি বা জাতীয় সনদ বলি। এ বিষয়ে স্বাক্ষরিত হওয়ার জন্য সবচাইতে বেশি আন্তরিকতা আমরা প্রদর্শন করেছি।

তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য পোষণ হলে যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হবে, সেই বিষয়গুলো একত্রিত করে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। তো এখন এখানে যদি আমাদের বাধ্য করা হয় যে এই সমস্ত বিষয়ে একমত হতেই হবে, সেটা তো সঠিক হলো না।

শতভাগ একমত হওয়া প্রায় অসম্ভব : ডা: তাহের

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান সংলাপ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘সবাইকে নিয়ে শতভাগ একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রায় অসম্ভব। তবু আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে ঐকমত্যের পথে এগোনো যায়।’ গতকাল সংলাপ নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেন, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার নিয়োগ কমিটি নিয়ে বিএনপির আপত্তি রয়েছে। বিএনপি এখনো এই কাঠামোর সাথে একমত নয়। তবে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য এই প্রস্তাবে একমত হয়েছে। তাই আলোচনায় অগ্রগতি আছে। ডা: তাহের বলেন, এ ধরনের সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের দিকে যাওয়া হলে সেটা দেশকে আবার দুর্বৃত্তায়নের পথে নিয়ে যাবে। আমরা চাই না আবার সেই অস্বচ্ছ ও দলনির্ভর নির্বাচন ফিরে আসুক।

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদে সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, জামায়াত দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের ধারণাকে সমর্থন করে। আপার হাউজ শুধু সংসদ সদস্য দিয়ে গঠিত না হয়ে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী ও জনগণের প্রতিনিধি দিয়েও গঠিত হওয়া উচিত। যাতে জনগণের প্রকৃত প্রতিফলন থাকে।

বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বাধায় মৌলিক সংস্কার আটকে আছে : আখতার

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন জাতীয় ঐকমত্য নিয়ে মৌলিক সংস্কারের বাস্তবতা থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে। সংস্কার ও ঐকমত্য নিয়ে বিএনপি ও দুয়েকটি দল দর কষাকষি করছে। অধিকাংশ দল একমত হলেও বিএনপির বিরোধিতার কারণে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চ কক্ষ বিষয়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দল ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধি করার বিষয়ে একমত হলেও বিএনপির কারণে হাউজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে মৌলিক সংস্কারের বিষয়টি বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বাধার কারণে আটকে আছে।

উচ্চকক্ষ যেন নিম্নক্ষের প্রতিচ্ছবি না হয় : মান্না

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, উচ্চকক্ষ যেন নিম্নকক্ষের প্রতিফলন না হয়, সে জন্যই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠনের পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত হবে। সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক (ভোটের হার) হারে চায় সিপিবি ও বাসদ। একইভাবে তারা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগ কমিটির পক্ষে মত দেন।

ট্যাগস :

বিএনপিতে আটকে যাচ্ছে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত

আপডেট সময় ০১:০৪:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে বিএনপি-জামায়াত, এনসিপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। উচ্চকক্ষে এমপি হবেন ১০০ জন। জামায়াত-এনসিপি, এবিপার্টিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল চাচ্ছে নিম্নকক্ষে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হোক। কিন্তু বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি দল এতে রাজি নয়। বিএনপি বলছে, নিম্নকক্ষে নির্বাচিত এমপিদের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত হোক।গতকাল রোববার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সপ্তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে গতকালসহ মোট চার দিন সংসদের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্ব কিভাবে হবে-তা নিয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি কমিশন।

শুধু এটাই নয়, ঐকমত্য কমিশনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি নিয়ে। দুই দিন এই কমিটি নিয়ে আলোচনা হয় কমিশনের বৈঠকে। জামায়াত-এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, ডান-বাম রাজনৈতিক দল ও জোট চায় নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন- এই ছয় কমিশন নিয়োগ দেবে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি। জামায়াত-এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ ডান ও বামপন্থী অধিকাংশ রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবে একমত পোষণ করেছে। কিন্তু গত সপ্তাহ কমিশনের বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা শেষে বিএনপির বিরোধিতায় তা আটকে যায়। গতকালের বৈঠকেও দীর্ঘ আলোচনার ফল শূন্য। বিএনপি সরাসরি ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ গঠনের বিপক্ষে মত দিয়েছে। ফলে দিন শেষে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ছাড়াই গতকালের বৈঠক মুলতবি করা হয়। আগামী বুধবার ফের কমিশনের বৈঠক বসবে।

বিকেলে কমিশনের বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে, প্রাপ্ত ভোটের মাধ্যমে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট করার জন্য বেশির ভাগ দল মতামত দিয়েছে। কিছু কিছু দল এই বিষয়ে সুস্পষ্ট আপত্তি জানিয়েছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যেহেতু দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট গঠনে আগ্রহী আছে সেক্ষেত্রে ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একমত হতে পারব। যেসব দল এই বিষয়ে আপত্তি আছে তারা জানিয়েছে আবারো এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে।

তিনি বলেন, দ্বিতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল- জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করার জন্য। প্রস্তাবের পর অনেক রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবটি সমর্থন করছে না। তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি নামে নতুন কমিটি করার প্রস্তাব করেছিলাম। সেখানে এনসিসির যেসব দায়দায়িত্ব ছিল, তা সীমিত করে কাঠামোগত দিক পরিবর্তন করা হয়। যেসব রাজনৈতিক দল কমিটিকে স্বাগত জানিয়েছিল তারা এর বিস্তারিত জানতে চেয়েছিল আমরা তার পরিপ্রেক্ষিতে আজকে নতুন কাঠামোগত দিকের প্রস্তাব তুলে ধরেছি।

আলী রীয়াজ বলেন, আমরা বলেছি এই নিয়োগ কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে ছয় কমিশনের প্রধান ও সদস্য নিয়োগ ও এ ছাড়া আইনের দ্বারা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করবে। এগুলো হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মনে করে এই কমিশনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দেশে একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রগঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

তিনি বলেন, কাঠামোগত দিক থেকে চিন্তা করে বলেছি- যখন সংসদ বহাল থাকবে তখন কমিটি কিভাবে কাজ করবে সেটা বলেছিলাম। তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার যদি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়-উচ্চকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা ও অন্য বিরোধী দলগুলোর নির্বাচিত একজন প্রতিনিধি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, এনসিসিতে আমাদের প্রস্তাব ছিল- রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির অন্তর্ভুক্তি। সেটা যেহেতু অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। সেই জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেখান থেকে সরে এসে প্রস্তাব দিয়েছিলাম রাষ্ট্রপতির একজন প্রতিনিধি আমরা সুনির্দিষ্ট করেছি। আমরা বলেছি সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতাসম্পূর্ণ্য কোনো ব্যক্তি ও প্রজাতন্তের কর্মে লিপ্ত এমন ব্যক্তি নয় মনোনয়নের পূর্বে ১০ বছর কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয় বা কোনো সংগঠনের সদস্য নয় এমন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি পাঠাতে পারবেন। প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধির ক্ষেত্রে আমরা বলেছি তার মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, কাঠামোগত দিক থেকে এটাই আমরা প্রস্তাব করেছি। নিম্নকক্ষের স্পিকার সভায় সভাপতিত্ব করবেন।

তিনি বলেন, এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্য একটি বিষয় আসছে- যখন সংসদ বহাল থাকবে না তার মানে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে তখন কী হবে। আমাদের দিক থেকে প্রস্তাব ছিল এটা অব্যাহত রাখার। এই কমিটি অন্য পরিবর্তন করে বিরোধী দলের যেসব সদস্য ছিল তাদের পরিবর্তে উপদেষ্টা পরিষদের একজন করে প্রতিনিধি দেয়া। আরো আলোচনায় যেটা স্পষ্ট হয়েছে, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যারা এই কমিটিকে সমর্থন করে তারা মনে করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে এই কমিটি বহাল রাখার প্রয়োজন নেই। প্রশ্ন ওঠে ওই সময় নির্বাচন কমিশনে কিভাবে নিয়োগ হবে- আলোচনা করে অনেকে প্রস্তাব করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে সীমিতভাবে দেয়া যায়। অন্য কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়কের হাতে ক্ষমতা থাকবে না।

তিনি বলেন, এই কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে বুঝা যায়, এ ধরনের একটি কাঠামোর ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সমর্থন আছে। কাঠামোগত ক্ষেত্রে আরেকটু আলোচনা ও সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। যেসব দল এখনো এই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে তাদেরকে অনুরোধ করেছি- পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ আছে কি না। আশা করছি যেসব দল এখন পর্যন্ত একমত হতে পারছেন না তারা এগুলো পুনর্বিবেচনা করবে।

দেশের স্বার্থে সংস্কার আলোচনার অগ্রগতি প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি কমিশনের সহসভাপতি বলেন, আমরা কেউ পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে চাই না। তাই দেশের স্বার্থে আপনারা বিষয়টি বিবেচনা করুন। যে অঙ্গীকার নিয়ে আমরা গত জুলাইয়ে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, তার কতটা অর্জিত হয়েছে? আমরা কি শুধু নিজের ও দলের স্বার্থ চাইব, নাকি দেশের স্বার্থও দেখব? আমরা আশা করি বেশির ভাগ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে নিয়ে আসতে পারব। কমিশন হতে আগামী বুধবার পরবর্তী আলোচনার দিন ধার্য করা হয়েছে।

জুলাই সনদ স্বাক্ষরে বিএনপি সবচেয়ে বেশি আন্তরিকতা দেখিয়েছে : সালাহউদ্দিন

কমিশনের সাথে বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটির বিষয়ে আমাদের বক্তব্য আগের মতোই। আমরা সাংবিধানিক বিভিন্ন সংস্থা কমিশন ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা কয়েকটি নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের মতামত আগে যেভাবে ছিল এখনো তেমনই আছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের বিদ্যমান আইনে অনেক সংস্কার প্রয়োজন। আমরা প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের নিজস্ব, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চয়তা বিধান করতে চাই। একইসাথে একটি শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের এই কথাগুলো আমরা বলেছি। আমাদের দলীয় প্রস্তাব যেটা আমাদের ৩১ দফা ছিল সেই প্রস্তাবই আমরা আবার দিয়েছি।

এক প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দীন আহমেদ বলেন, এখন পর্যন্ত জুলাই সনদ বলি বা জাতীয় সনদ বলি। এ বিষয়ে স্বাক্ষরিত হওয়ার জন্য সবচাইতে বেশি আন্তরিকতা আমরা প্রদর্শন করেছি।

তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য পোষণ হলে যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হবে, সেই বিষয়গুলো একত্রিত করে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। তো এখন এখানে যদি আমাদের বাধ্য করা হয় যে এই সমস্ত বিষয়ে একমত হতেই হবে, সেটা তো সঠিক হলো না।

শতভাগ একমত হওয়া প্রায় অসম্ভব : ডা: তাহের

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান সংলাপ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘সবাইকে নিয়ে শতভাগ একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রায় অসম্ভব। তবু আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে ঐকমত্যের পথে এগোনো যায়।’ গতকাল সংলাপ নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেন, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার নিয়োগ কমিটি নিয়ে বিএনপির আপত্তি রয়েছে। বিএনপি এখনো এই কাঠামোর সাথে একমত নয়। তবে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য এই প্রস্তাবে একমত হয়েছে। তাই আলোচনায় অগ্রগতি আছে। ডা: তাহের বলেন, এ ধরনের সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের দিকে যাওয়া হলে সেটা দেশকে আবার দুর্বৃত্তায়নের পথে নিয়ে যাবে। আমরা চাই না আবার সেই অস্বচ্ছ ও দলনির্ভর নির্বাচন ফিরে আসুক।

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদে সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, জামায়াত দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের ধারণাকে সমর্থন করে। আপার হাউজ শুধু সংসদ সদস্য দিয়ে গঠিত না হয়ে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী ও জনগণের প্রতিনিধি দিয়েও গঠিত হওয়া উচিত। যাতে জনগণের প্রকৃত প্রতিফলন থাকে।

বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বাধায় মৌলিক সংস্কার আটকে আছে : আখতার

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন জাতীয় ঐকমত্য নিয়ে মৌলিক সংস্কারের বাস্তবতা থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে। সংস্কার ও ঐকমত্য নিয়ে বিএনপি ও দুয়েকটি দল দর কষাকষি করছে। অধিকাংশ দল একমত হলেও বিএনপির বিরোধিতার কারণে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চ কক্ষ বিষয়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দল ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধি করার বিষয়ে একমত হলেও বিএনপির কারণে হাউজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে মৌলিক সংস্কারের বিষয়টি বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বাধার কারণে আটকে আছে।

উচ্চকক্ষ যেন নিম্নক্ষের প্রতিচ্ছবি না হয় : মান্না

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, উচ্চকক্ষ যেন নিম্নকক্ষের প্রতিফলন না হয়, সে জন্যই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠনের পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত হবে। সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক (ভোটের হার) হারে চায় সিপিবি ও বাসদ। একইভাবে তারা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ নিয়োগ কমিটির পক্ষে মত দেন।