বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল- যে সংগঠনটি একসময় ত্যাগ, আদর্শিক লড়াই ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত ছিল, আজ ঢাকায় এসে সেই সংগঠন ভয়াবহ নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদল ও এর অধীনস্থ থানা ইউনিটগুলো যেন বিএনপি-বিরোধী অপশক্তির এক ছায়া-সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় চলছে।
অনুসন্ধান বলছে, এসব কমিটি এখন আর ছাত্রদের দ্বারা নয়, বরং অর্থ, প্রভাব ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। “ছাত্রদল” নামটি ব্যবহার করে একটি আদর্শিক পতনের আয়োজন চলছে- যেখানে ত্যাগী নেতারা কোণঠাসা, আর রাজপথে অনুপস্থিত সুবিধাভোগীরা নেতৃত্বের আসনে।
রবিন-আকরাম সিন্ডিকেট: শুরু এখান থেকেই-
ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদলের বর্তমান আহ্বায়ক রবিন খান এবং সদস্য সচিব আকরাম হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তারা কমিটি গঠনে কোটি টাকার বাণিজ্য, অনুপ্রবেশকারী পুনর্বাসন এবং গ্যাং ও মাদক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নেতৃত্বে বসাচ্ছেন।
একাধিক সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই দু’জন একটি সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি করেছেন, যারা ছাত্রদলের আদর্শবিরোধী লোকদের অর্থের বিনিময়ে পদ দিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে- যারা এই দুর্নীতির প্রতিবাদ করছেন, তারা নানা হুমকি ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন।
আদাবর থানা: ছাত্রলীগের ঘাঁটি থেকে ছাত্রদলের নেতৃত্বে-
বিশ্লেষকদের মতে, সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত কমিটি হচ্ছে আদাবর থানা ছাত্রদলের। এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে নয়ন হোসেনকে- যিনি এক সময় চিহ্নিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডার ছিলেন। নয়নের ছাত্রত্ব শেষ ২০১১ সালে, তিনি বিবাহিত এবং রাজনৈতিক জীবনে জাতীয়তাবাদী আদর্শের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, নয়ন হোসেন এক “ঘাতক অনুপ্রবেশকারী”। তার ফেসবুকে, বিভিন্ন জনসমাবেশে এবং সামাজিক ছবি ও ভিডিওতে তাকে ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে দেখা গেছে। এমনকি তার পরিবারের একজনকে বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণে যুবদল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করাও হয়েছে (এ বিষয়ে সামনে আরও অনুসন্ধানী রিপোর্ট আসছে)।
এই কমিটির সদস্য সচিব মনিরুজ্জামান জসিম সম্পর্কে অভিযোগ আরও ভয়াবহ। স্থানীয়রা বলেন, “এই লোক মাদক ব্যবসার গডফাদার, এলাকায় তার নামে মানুষ আঁতকে ওঠে।” তিনি চোরাকারবার ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করা হচ্ছে।
শুধু তাই নয়। জানা যায় আদাবর থানা ছাত্রদলের সদ্য ঘোষিত কমিটির আহ্বায়ক নয়ন হোসেন ছাত্রলীগ থেকে আড়াই বছর আগে ছাত্রদলের রাজনীতিতে এলেও এলাকার ছাত্রলীগ-যুবলীগের সাথে সখ্যতা রাখত, আর আদাবরের বাহিরের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিত। আর এই নয়ন হোসেনের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে।
হাসিনা বিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনে ঢাকার প্রতিটা ইউনিটের বিএনপি-ছাত্রদলের কর্মীর নামে মামলা হলেও গোটা হাসিনার স্বৈরাচারী আমলে একটা মামলাও হয়নি এইমনিরুজ্জামান জসিমের নামে, এমনকি একবারের জন্যও গ্রেপ্তার হয়নি সে। তথাপি আদাবর থানা ছাত্রদলে নয়ন-জসীম গ্যাংরাই গুরুত্বপূর্ণ পদে আসায় স্থানীয়দের মাঝে বইছে ব্যাপক কানাঘুষা।
একেকটি থানা, একেকটি বিতর্কের গল্প-
মোহাম্মদপুর থানা কমিটিতে আওয়ামীপন্থী লোকদের প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। আহ্বায়ক বশির উল্লাহ বশির বিবাহিত, রাজনৈতিক মামলা নেই। সদস্য সচিব সাকিবুল হাসান দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নেই, বরং আওয়ামী ঘরানার সুবিধাভোগী বলেই পরিচিত। আদাবরের কমিটি গঠনের একই চিত্রনাট্য যেন মোহাম্মদপুর থানায়ও। এই থানার ছাত্রদলের সদস্য সচিব সাকিবুল হাসান বাবু দীর্ঘ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে ছিলেন দাবি করলেও রাজনৈতিকভাবে গ্রেপ্তার হওয়া কিংবা তার বিরুদ্ধে নেই একটিও রাজনৈতিক মামলা। অথচ মোহাম্মদপুর থানার অনেক ত্যাগী কর্মীরা বলছেন; তারা আজ কোণঠাঁসা।
দারুস সালাম থানায় যেন অপরাধীদের অভয়ারণ্য। আহ্বায়ক ইকবাল হোসেন দিপু বিবাহিত, ছাত্রত্ব নেই। যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদের বিরুদ্ধে রয়েছে তিনটি হত্যা মামলা। সদস্য সচিব অমর নাঈম ছাত্রলীগ থেকে আসা এবং সর্বশেষ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে স্লোগান দিয়েছেন।
মিরপুর থানা ছাত্রদলের কমিটিকে স্থানীয়রা বলছেন “ক্যাশ কমিটি”। আহ্বায়ক অনিক রহমান বিবাহিত। যুগ্ম আহ্বায়ক আতিক, আশিক, তৌহিদ, রাব্বি ও অভি- যাদের সবাই ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ। অর্থের বিনিময়ে পদ কেনার স্পষ্ট প্রমাণও রয়েছে বলে জানায় স্থানীয় একাধিক সূত্র।
রূপনগর থানা ছাত্রদলে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে কমিটি বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আরিফ বিদেশ ফেরত, সদস্য সচিব মেহেদী হাসান ছিলেন যুবলীগের সক্রিয় সদস্য।
পল্লবী থানায় নতুনদের আধিক্য ও বিবাহিতদের আধিপত্য স্পষ্ট।
মিরপুর কলেজ ছাত্রদল কমিটিতে বহিষ্কৃতদের পুনর্বাসনের অভিযোগ উঠেছে। আহ্বায়ক মওদুদ আহমেদ ও যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ রানা- দুজনই চাকরিজীবী। সদস্য সচিব সুমন এক শিক্ষকের ওপর হামলার অভিযোগে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তবে অর্থের বিনিময়ে ফিরে এসেছেন বলে দাবি।
শাহ আলী থানা কমিটিতে কিশোর গ্যাং ও নকল সার্টিফিকেটধারীদের আধিপত্য। আহ্বায়ক সজিব কিশোর গ্যাং লিডার এবং আওয়ামী নেত্রী নাবিলা আহমেদের সহযোগী। সদস্য সচিব তানজিব যুবলীগ সংশ্লিষ্ট এবং ছাত্রত্বহীন।
শেরে বাংলা থানায় একাধিক বিবাহিত ও সরকারঘেঁষা নেতাদের স্থান দেওয়া হয়েছে। আহ্বায়ক রাজা আহমেদ মিন্টুর একাধিক স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। আন্দোলনের কোনো ইতিহাস নেই।
কাফরুল থানা ছাত্রদলে ছাত্রত্ববিহীন, আওয়ামী সংশ্লিষ্ট ও নৈতিকভাবে অযোগ্যদের স্থান দেওয়া হয়েছে। আহ্বায়ক বাপ্পি, সদস্য সচিব যুবরাজ- কারো ছাত্রত্ব নেই, রাজনৈতিক পরিচিতিও বিতর্কিত।
ভবিষ্যতের প্রশ্ন: ছাত্রদল কার, আদর্শ কার হাতে?
বিএনপির ভেতরের একাধিক সিনিয়র নেতা এবং ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন- “এই সিন্ডিকেট এখনই প্রতিহত না করলে ছাত্রদল আর আদর্শিক সংগঠন থাকবে না। এটি সুবিধাবাদী, ভাড়াটে এবং সরকারপন্থী পুনর্বাসনের প্ল্যাটফর্ম হয়ে যাবে।”
তাদের দাবি, অবিলম্বে এসব বিতর্কিত কমিটি বাতিল করে ত্যাগী, পরীক্ষিত, ছাত্রত্বসম্পন্ন নেতাকর্মীদের নিয়ে একটি নতুন ঢাকার ছাত্রদল গঠন করতে হবে। আর এই দায়িত্ব নিতে হবে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটিকে- যারা সাংগঠনিক জীবনবৃত্তান্ত যাচাই করে নতুন করে থানা ও ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি দেবে।
ঢাকা মহানগর পশ্চিম ছাত্রদলের এই অবস্থা বিএনপির আদর্শিক ভিত্তির জন্য এক ভয়াবহ সতর্ক সংকেত। ছাত্রদলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এখন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ওপর। ছাত্রদল কি আদর্শিক পথে ফিরবে, নাকি বিক্রি হয়ে যাওয়া সুবিধাভোগীদের পকেট সংগঠন হয়ে থাকবে- এই প্রশ্নে আজ উত্তাল ঢাকার প্রতিটি থানা, প্রতিটি ছাত্রনেতা, প্রতিটি ত্যাগী কর্মী। যারা দলীয় হাই-কমান্ডের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই সিন্ডিকেট ও নেতৃত্বের অধঃপতন যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে শুধু ছাত্রদলের ভিতরেই নয় বরং তার প্রতিফলন ঘটবে জাতীয় রাজনীতিতেও। বিশেষ করে ঢাকা-১৩ আসনে যেখানে আদাবর, মোহাম্মদপুর, দারুস সালাম ও শেরেবাংলা নগর থানার ছাত্রদলের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেই এলাকাগুলো আজ বিরোধী ঘরানার নেতৃত্বের হাতে চলে যাচ্ছে, যাদের অতীত ও বর্তমান ছাত্রদলের মুলনীতি ও চেতনাবিরোধী।