ঢাকাভয়েস ডেক্স: ইরানের একের পর এক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রে বেকায়দায় পড়েছে আগ্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল। সর্বশেষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় গোটা ইসরাইলে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি দেখা দেয়। এমনকি তারা প্রাথমিকভাবে আঘাত হানা ক্ষেপণাস্ত্রের পরিচয়ও শনাক্ত করতে পারেনি। দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ বলেছেন, এ হামলা হয়েছে ‘ইসরাইলের হৃদয়ে’। তিনি মনে করেন, ইসরাইল পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছিল বলে যে ধারণা ছিল, ইরান তা একদম উড়িয়ে দিয়েছে। ইসরাইলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যমের বরাতে আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ইরান যেসব জায়গায় হামলা চালিয়েছে সেখান থেকে ১৩৭ জনকে চিকিৎসাকেন্দ্রে নেয়া হয়েছে।

এ দিকে বিবিসির খবর অনুসারে, ইসরাইলের জরুরি পরিষেবা সংস্থা মেগান ডেভিড অ্যাডম বলেছে, ইরানের হামলায় গতকাল বৃহস্পতিবার ইসরাইলে ৮৯ জন আহত হয়েছেন। তেলআবিব ও ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলায় তারা আহত হন। গতকাল সকালে নতুন করে ইসরাইলে ভয়াবহ হামলা চালায় ইরান, এতে দেশটির অন্তত চারটি জায়গায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর মধ্যে দেশটির সোরোকা হাসপাতালও রয়েছে। এ হামলাকে দু’পক্ষের সংঘাত শুরুর পর ইরান থেকে সবচেয়ে বড় হামলা বলে দাবি করা হচ্ছে।

এ দিকে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ বলেছে, বৃহস্পতিবার সকালে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের ‘মূল লক্ষ্য’ ছিল ইসরাইলের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা দফতরের একটি প্রধান কেন্দ্র। আইআরএনএ আরো বলেছে, এ ঘাঁটি বিরসভা শহরের সোরোকা হাসপাতালের কাছে অবস্থিত। তাই ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরণের ধাক্কায় সোরোকা হাসপাতালে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সামাজিকমাধ্যম টেলিগ্রামে দেয়া এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, ‘এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কমান্ড ও গোয়েন্দা সদর দফতর (আইডিএফ সিআই) এবং গাভ-ইয়াম প্রযুক্তি পার্কে অবস্থিত সামরিক গোয়েন্দা ঘাঁটি।’ বিবৃতিতে বলা হয়, সামরিক অবকাঠামো ছিল এ হামলার অত্যন্ত নির্ভুল ও সরাসরি লক্ষ্যবস্তু।

এর আগে তেলআবিব থেকে আলজাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ওরি বলেন, ‘পুরো ইসরাইলজুড়েই ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। তবে সরকার এখন দক্ষিণাঞ্চলের সোরাকা হাসপাতালকে ঘিরেই সবচেয়ে বেশি প্রচার চালাচ্ছে। মূলত হাসপাতালকে লক্ষ্য করেই ইরান হামলা চালিয়েছে – এমন বার্তা দিতেই এই কৌশল অবলম্বন করছে নেতানিয়াহু সরকার।’ তিনি বলেন, ‘অবশ্যই, ইসরাইলিরাও হাসপাতালগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। এটা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে হাসপাতালের খুব কাছেই খুব সংবেদনশীল স্থাপনা এবং সদর দফতর রয়েছে। কারণ ইসরাইল বেসামরিক এলাকা এবং শহরের মাঝখানে তার সামরিক সদর দফতর স্থাপন করে।’

খামেনিকে হত্যার হুমকি : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে ‘আর বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়া যায় না’ বলে মন্তব্য করেছেন ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দেশটির সোরোকা হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর তিনি এই হুমকি দিলেন। এএফপির খবরে বলা হয়, তেলআবিবের কাছে হোলন শহরে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ হুমকি দেন। তিনি বলেন, ‘খামেনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, তিনি ইসরাইলকে ধ্বংস করতে চান। হাসপাতালের ওপর হামলার নির্দেশও তিনিই ব্যক্তিগতভাবে দিয়েছেন।’ কাৎজ আরো বলেন, ‘ইসরাইল রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা তার (খামেনি) লক্ষ্য… এমন একজন মানুষকে আর বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়া যায় না।’

এর আগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইরানকে চড়া মূল্য দিতে হবে। এক্স পোস্টে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী লিখেন, ‘আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে, ইরানের স্বৈরশাসকেরা বিরসেভা শহরের সরোকা হাসপাতালে ও দেশের মধ্যাঞ্চলে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে।’ তিনি আরো লেখেন, ‘আমরা তেহরানের শাসকদের চড়া মূল্য দিতে বাধ্য করব’।

নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা : ইসরাইলি বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বুধবার রাতে ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রের একটি স্থাপনায় বিমান হামলা চালানো হয়েছে। তাদের দাবি, ওই কেন্দ্রটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আইডিএফ বলেছে, ‘সেখানে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ব্যবহৃত উপাদান ও সরঞ্জাম রয়েছে। সেখানে এমন সব প্রকল্প বানানো হচ্ছে, যা পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে ত্বরান্বিত করতে সক্ষম।’

এবারই প্রথম নাতাঞ্জে হামলার খবর জানা গেল, তা নয়। এর আগে চলতি সপ্তাহের শুরুতে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান বিবিসিকে জানান, গত শুক্রবার নাতাঞ্জে একদফা হামলা চালিয়েছিল ইসরাইল। হামলায় নাতাঞ্জে ইরানের ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের সেন্ট্রিফিউজগুলো ‘পুরোপুরি ধ্বংস না হলেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচি যে শান্তিপূর্ণ, সেই বিষয়ে গত রোববার ইরানের পক্ষ থেকে আগের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। ৩৫ সদস্যের আইএইএর পর্ষদকে ইসরাইলি হামলার জোরালো প্রতিবাদ জানাতে আহ্বান জানিয়েছে তেহরান। ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নাতাঞ্জ ইরানের মূল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এটি গভীরভাবে সুরক্ষিত (বাংকারযুক্ত) একটি স্থাপনা। কেন্দ্রটির অস্তিত্ব প্রথম সামনে আসে ২০০২ সালে। এ স্থাপনার দু’টি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে প্রায় ৭০টি সেন্ট্রিফিউজের সারি আছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনায় একদফা হামলা হয়েছিল।

আরাকে পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা : ইরানের আরাক শহরে ভারী পানির (ডিউটেরিয়াম অক্সাইডমিশ্রিত) পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে। এর আগে ইসরাইলি বাহিনীর পক্ষ থেকে ইরানের ওই চুল্লির আশপাশের এলাকায় বসবাস করা মানুষদের অবিলম্বে অন্যত্র সরে যাওয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল। এপির খবর বলছে, ডিউটেরিয়াম অক্সাইডমিশ্রিত এ ভারী পানি পারমাণবিক চুল্লি শীতল করার কাজে ব্যবহার হয়। তবে উপজাত পণ্য হিসেবে ওই পানি থেকে প্লুটোনিয়াম পাওয়া যায়। এ উপাদান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে কাজে লাগে। বিবিসি জানিয়েছে, আরাকে ভারী পানির পারমাণবিক চুল্লিতে হামলার খবর নিশ্চিত করেছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর দাবি, এ চুল্লিতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের নকশা রয়েছে। এসব প্লুটোনিয়াম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

পুতিন ও শি চিনপিংয়ের ফোনালাপ : রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের মধ্যে ফোনালাপ হয়েছে। চলমান ইরান-ইসরাইল সংঘাত নিয়ে কথা হয়েছে এ দুই বিশ্বনেতার মধ্যে। সিএনএনের খবরে বলা হয়, চীনের প্রেসিডেন্ট এ সংঘাত নিরসনে ‘বড় শক্তিগুলোর’ প্রতি উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন, যা ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি পরোক্ষ বার্তা বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফোনালাপে ইসরাইলের ইরানবিরোধী পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন দুই বিশ্ব নেতা। চলমান সংঘাতে পুতিন আবারো মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন।

কঠিন সময় পেরোনোর বার্তা ইরানি প্রেসিডেন্টের : ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সরকার ও প্রশাসনের সব বিভাগকে জনগণের পাশে থাকতে বলেছেন। সামাজিক মাধ্যমে দেয়া এক পোস্টে তিনি এ আহ্বান জানান। ওই পোস্টে মাসুদ পেজেশকিয়ান লেখেন, ‘সব মন্ত্রণালয় ও সরকারি সংস্থাকে দেশের সেবা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের ধৈর্যের সাথে জনগণকে সেবা দিয়ে যেতে হবে।’ পেজেশকিয়ান আরো লেখেন, ‘একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও ঐক্যের মাধ্যমে আমরা এ কঠিন সময় পার হতে পারব।’

নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক : ইরান ও ইসরাইলের মধ্যকার সংঘাত নিয়ে আজ শুক্রবার জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ। ইরান, রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান ও আলজেরিয়ার অনুরোধে এ বৈঠক হবে। চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হওয়ার কথা জানিয়েছে বিবিসির মার্কিন অংশীদার সিবিএস নিউজ। নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ইসরাইল অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন।

ইরানের দু’টি গ্রাম খালির নির্দেশ : ইরানের দু’টি গ্রামে অবস্থিত ‘সামরিক অবকাঠামো’ লক্ষ্য করে হামলা চালানোর আগেই বাসিন্দাদের সরে যেতে পরামর্শ দিয়েছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে আরবি ও ফারসি ভাষায় এক টেলিগ্রাম বার্তায় এ পরামর্শ দেয়া হয় বলে খবর এএফপির। জরুরি সতর্কবার্তায় বলা হয়, ইরানি শাসকগোষ্ঠীর সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) হামলা চালানোর আগেই ইরানের দু’টি গ্রাম-আরাক ও খন্দাবের বাসিন্দা, শ্রমিকসহ সেখানে অবস্থানরত সবাই যেন অবিলম্বে সরে যান।

লিথুয়ানিয়ার দূতাবাসের কাছে বিস্ফোরণ : তেলআবিবের রামাত গান এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তাদের দূতাবাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রদূত নিশ্চিত করেছেন যে, দূতাবাসে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে সেখানে যেসব ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে, তা দূতাবাস থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে।’ স্থানীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরাইলের তথ্য, রামাত গান এলাকায় গতকালের ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ২০ জন ‘সামান্য আহত’ হয়েছেন।

ইরানে এ পর্যন্ত নিহত ৬৩৯ : ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস বলেছে, ইসরাইলের হামলায় ইরানে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৩৯ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে এক হাজার ৩২০ জনের বেশি বলে জানিয়েছে আলজাজিরা। হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস আরো বলেছে, নিহতদের মধ্যে ২৬৩ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ১৫৪ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। বাকিদের পরিচয় দেয়নি সংস্থাটি। ২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে হতাহতের তথ্য জানিয়েছিল হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস। সংস্থাটি বলেছে, হতাহতের তথ্য তারা ইরানের স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরের সাথে মিলিয়ে দেখেছে। ইরানে গড়ে তোলা নিজেদের নেটওয়ার্কের সহায়তায় তথ্য যাচাই করা হয়েছে।

ঢাকাভয়েস২৪/সাদিক