‘হয় ডাকসু, নয় পুরো প্রশাসনের পদত্যাগ’—এমন দাবি সামনে নিয়ে আসন্ন ঈদুল আজহার পরপরই একযোগে মাঠে নামছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্রিয়াশীল অধিকাংশ ছাত্রসংগঠনগুলো।
প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন কমিশন গঠন, তফসিল ঘোষণাসহ বিভিন্ন প্রাথমিক দাবি-দাওয়া নিয়ে এগিয়ে যাবে এই আন্দোলন। দাবি মেনে না নিলে বা গড়িমসি করলে গণঅনশনে যাওয়ারও সিদ্ধান্ত আসতে পার তাদের কাছ থেকে।
অনিবার্য কারণে ঈদের আগে ডাকসু নির্বাচন কমিশন গঠন হচ্ছে না বলে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের পর এমনটাই ভাবছে সংশ্লিষ্ট ছাত্রসংগঠনগুলো।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন। পরবর্তীকালে দাবি উঠলেও নির্বাচন আয়োজনে উদ্যোগ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এদিকে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পরিবর্তনের পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জোরাল দাবি ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানান ঢাবি শিক্ষার্থীরা। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন ডাকসু আয়োজনের কাজ শুরু করলেও গত মে মাসের মাঝামাঝিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম হত্যার পর সৃষ্ট ঘোলাটে পরিবেশের কারণে সেটির অগ্রগতি থমকে পড়ে।
এরপর ২১ মে একদল শিক্ষার্থী ভিসি বাসভবনের সামনে অনশনে বসেন। দুই দিন পর ২৪ মে ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান ২ জুনের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন কমিশন গঠনের আশ্বাসে তখন দীর্ঘ ৮১ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙেন ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লাসহ তিন শিক্ষার্থী।
তারিখ অনুযায়ী সোমবারের (২ জুনের) মধ্যে ডাকসুর নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণে ঈদের আগে ডাকসু নির্বাচন কমিশন গঠন হচ্ছে না বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক চিঠিতে জানানো হয়, ডাকসুর প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় গত ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু নির্বাচনের একটি টাইমলাইন প্রকাশ করেছিল। এই টাইমলাইন অনুসারেই নির্বাচন আয়োজনের কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে এবং ঘোষিত টাইমলাইন অনুসারে চতুর্থ ধাপের কাজ পুরোপুরিভাবে সম্পন্ন হয়েছে। পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম ধাপের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত কার্যক্রমের ফলাফল নিয়ে পঞ্চম ধাপে ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্বের বৈঠক ১৩ মে সম্পন্ন হয়েছে। ঈদের ছুটির পর ক্যাম্পাস খোলা হলে সেটি সম্পন্ন করা হবে। এ ছাড়া ষষ্ঠ ধাপে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে তিন শিক্ষককে নির্বাচন কমিশনের সদস্য হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তারা হলেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম শামীম রেজা ও ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম।
তবে এ অগ্রগতির বিষয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অধিকাংশ ছাত্রসংগঠনের নেতারা। তারা বলছেন, প্রশাসন ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে যে আন্তরিকতা দেখানোর কথা ছিল, তা দেখা যায়নি। বিশেষ করে ভিসি তাদের হতাশ করেছেন। এখন প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমেই ডাকসু নির্বাচন আদায় সম্ভব বলে তারা মনে করছেন।
জানা গেছে, ডাকসু আদায়ে ডানপন্থী, মধ্যপন্থী ও ইসলামী ঘরানার ছাত্রসংগঠনগুলো এসব বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা সেরে নিয়েছে। এসব সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, ছাত্রশিবির, ইনকিলাব মঞ্চ, ছাত্র অধিকার পরিষদ, স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংসদ, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, জুলাই ঐক্য ও জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ। এ আলোচনার কিছুটা বাইরে রয়েছে ছাত্রদলসহ বামপন্থী দলগুলো। ডাকসু আদায়ে সম্ভাব্য এই প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাত্রদল ও বাম দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা না হলেও কোনো কোনো সংগঠনের ব্যক্তি পর্যায়ে নেতারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে ক্রিয়াশীল এসব সংগঠনের সঙ্গে একই ব্যানারে আন্দোলন করার বিষয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ প্রথম দিকে একমত হলেও পরে কিছুটা পিছুটান দেয়। ছাত্রসংসদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ট্যাগিং থেকে বাঁচতে আপাতত এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না তারা। তবে ছাত্রদলকে বাদ দিয়ে শুধু বাম সংগঠনগুলো ইসলামপন্থীদের সঙ্গে একি ব্যানারে আন্দোলন করতে চাইলে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদও ইতিবাচক থাকবে। এ ছাড়া ভিন্ন সমীকরণে সব বাম ছাত্রসংগঠন ডাকসু আদায়ের বিষয়ে ঐকমত্যে এলে তাদের নিয়ে ভিন্ন ব্যানারে আন্দোলন করার বিষয়েও চিন্তা গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের। এ ক্ষেত্রে ছাত্রদলকেও রাজি করানোর বিষয়ও থাকবে। তবে তাদের আশ্বস্ত করতে ছাত্রদলের দাবি, ডাকসুতে তাদের আসন ছেড়ে দেওয়াকে আপাতত গুরুত্ব দিচ্ছে না ছাত্রসংসদ।
কিছু ছাত্রসংগঠন মনে করে সমঝোতা ও আশ্বস্তের মাধ্যমেই ডাকসু আদায় করে নিতে হবে। সম্ভাব্য ডাকসুবিরোধী শক্তিগুলোকে এক টেবিলে বসানোর মধ্য দিয়ে ডাকসু সম্ভব। তবে বেশির ভাগ ছাত্রসংগঠন মনে করে, প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমেই ডাকসু নির্বাচন সম্ভব। প্রশাসনের ভেতরে ও বাইরে থাকা ডাকসু বিরোধিতাকারীদের দমাতে শিক্ষার্থীদের কঠোর পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের ঢাকঢোল বেজে ওঠা এবং এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ঘুরিয়ে দেওয়ার আগেই ডাকসু আদায় করার বিষয়ে বদ্ধপরিকর সবাই।
ছাত্রদলের বিরুদ্ধে কিছু সংগঠন এ মুহূর্তে ডাকসু নির্বাচন চায় না বলে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিন বলেন, ‘আমি কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হয়ে তো বিষয়টি জানি না। ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচন চায় না, তথ্যটি সঠিক নয়। ডাকসু নিয়ে ঢাবি প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রসংগঠনে যত আলোচনা হয়েছে, তাতে ছাত্রদল অংশ নিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেছেন, ‘ডাকসু নিয়ে সব সংগঠনই একমত। আমরাও সবার সঙ্গে কথা বলছি। যে সংকট তৈরি হয়েছে তার সমাধান কী হতে পারে, তা নিয়ে কথা হচ্ছে। তবে ওইভাবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। একদম প্রাথমিক পর্যায়ে আছে বিষয়গুলো।’
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেছেন, যেদিন বিন ইয়ামিন মোল্লা ভাইসহ তিনজন শিক্ষার্থী অনশন ভেঙেছেন ওই দিনই আমরা এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা আশা করেছিলাম উপাচার্য স্যার আমাদের যে আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি কিছু হলেও বাস্তবায়ন করবেন। কোনো একটা কাজের অগ্রগতি দেখাবেন; কিন্তু তিনি আমাদের সম্পূর্ণ হতাশ করলেন।’
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘প্রশাসন ডাকসুর বিষয়ে যে আন্তরিকতা দেখানোর কথা ছিল, আমরা তা দেখিনি। ঈদের মধ্যেই আমরা আমাদের সংগঠনের নেতাকর্মীদের অ্যাকটিভ করার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। ঈদের পরে বড় আন্দোলনের বিষয়ে বিভিন্ন অংশীজনের এবং ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরাও সবার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছি। তবে কোনো বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আলাপ-আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘আমাদের প্লাটফর্মের নাম এখনো ঠিক হয়নি। কথাবার্তা চলছে। ঈদের ছুটির কারণে সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। তবে কয়েক দিন পর কিছু বিষয় চূড়ান্ত হতে পারে।’
স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক জালালুদ্দিন মোহাম্মদ খালিদ বলেন, ‘ডাকসু আমাদের অধিকার। এর জন্য সব ছাত্রসংগঠন এক জায়গায় আসা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অনেকেই এসেছে। বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা চলছে। প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে শিক্ষার্থীদের অধিকার ডাকসু বিলম্ব হতে পারে না। শিক্ষার্থীদের বেঁধে দেওয়া সময়ে ডাকসু আয়োজন করতে না পারলে প্রয়োজনে আমরা সম্পূর্ণ প্রশাসনের পদত্যাগের ডাক দেব।’