সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিল শুনানি শেষ হয়েছে। সোমবার (২ জুন) রায়ের দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট।
গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারল শামীমা দিপ্তী।
সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জসিম সরকার, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার সুমাইয়া আজিজ ও লাবনী আক্তার।
এর আগে, গত ২৩ এপ্রিল এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শুরু হয়। ২১ এপ্রিল আলোচিত এ হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। একইসঙ্গে মামলার যাবতীয় নথি বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠানো হয়।
এ মামলার ১ নম্বর আসামি ও তৎকালীন বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের বরখাস্ত পুলিশ পরিদর্শক চট্টগ্রামের পটিয়ার লিয়াকত আলীসহ অন্যান্য আসামির কী ধরনের সাজা হবে তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। এদিকে বরখাস্ত বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের সাবেক পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও তার সহযোগীদের যেন ফাঁসি হয় সে রায় চান পটিয়ার জনসাধারণ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পটিয়ার একাধিক ব্যক্তি বলেন, মেজর সিনহা হত্যাকারী লিয়াকত আলী পটিয়ার জন্য কলঙ্ক। তিনি পুলিশের প্রভাব খাঁটিয়ে পটিয়ায় মাদক ব্যবসা করেছিলেন।
তার অনুসারীরা মাদক ও অন্যান্য মামলায় আটক হলেও তখন লিয়াকতের অদৃশ্য ক্ষমতার দাপটে কয়েক দিন পরই ছাড়া পেয়ে যেতেন। তাই পটিয়ার জনসাধারণ লিয়াকত আলীসহ তার সহযোগীদেরও যেন এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সর্বোচ্চ বিচার ফাঁসি হয়, সেই রায় চান।
এদিকে, প্রায় ৫ বছর আগে টেকনাফে চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনায় আলোচনায় উঠে আসে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক পটিয়ার লিয়াকত আলীর নাম। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব হুলাইন গ্রামে লিয়াকতের বাড়ি। তিনি ওই গ্রামের মৃত মো. সাহাব মিয়ার ছেলে।
ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে লিয়াকত পঞ্চম। লিয়াকত আলী ২০১০ সালে পুলিশে যোগ দেন। প্রথমে ডিবি, পরে সোয়াট ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটে কাজ করেন।
লিয়াকত আলী প্রথমে চন্দনাইশ উপজেলায় বিয়ে করেন। ওই স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর বোয়ালখালী উপজেলায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ওই ঘরে তার ৯ বছরের এক ছেলে রয়েছে।
২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি টেকনাফ থানার বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রে যোগদান করেন লিয়াকত আলী। পরে ওই বছরেরই ৩১ জুলাই ঘটনার দুই বছর আগে পুলিশ পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান লিয়াকত। তদন্তকেন্দ্রে যোগদানের সাত মাসের মধ্যেই তিনি এলাকায় মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসতে থাকে লিয়াকতের একের পর এক কাহিনি। বাহারছড়া এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী ও মানব পাচারের অভিযোগ তুলে অনেকের কাছ থেকেই চাঁদা আদায় করতেন তিনি। ওই এলাকার বেশ কয়েকটি ফিশারিজ ঘাট থেকেও নিয়মিত মাসোহারা আদায় করতেন তিনি। পাশাপাশি ওসি প্রদীপের মতো টাকা নেওয়ার পরও ক্রসফায়ারে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে লিয়াকতের বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগর এলাকায় এক জঙ্গি অভিযানে ১৫ বছরের এক কিশোরসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেন লিয়াকত আলী। এ ছাড়া ২০১৬ সালে সীতাকুণ্ডে এক কথিত জঙ্গি অভিযানে আরও দুজনকে গুলি করে হত্যা করেন তিনি। তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের কিলিং টিমের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবেও তিনি কাজ করতেন বলে জানা গেছে।
২০১০ সালে লিয়াকত সরাসরি পুলিশের উপপরিদর্শক পদে চাকরি পান। পুলিশের চাকরি পাওয়ার পর লিয়াকত আলী ভালো থাকলেও সিএমপিতে থাকা অবস্থায় তৎকালীন সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। সর্বশেষ কক্সবাজারে বদলি হওয়ার পর ওসি প্রদীপ দাসের সঙ্গে মিলে নানা ঘটনার জন্ম দেন লিয়াকত। মূলত সিনহা হত্যার ঘটনাটি তারই একটি উদাহরণ।
যদিও ঘটনার পর কক্সবাজার পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, রাশেদ তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেনথ। পরে ‘পিস্তল বের করলেথ চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাঁকে গুলি করে। তবে পুলিশের এমন ভাষ্য নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ওঠে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তার এক সঙ্গীর বক্তব্যের সঙ্গে পুলিশের ভাষ্যের অমিল রয়েছে বলে একটি সূত্র জানায়। এমন প্রেক্ষাপটে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখতে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ওসি প্রদীপের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নিজেও এলাকায় গড়ে তোলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এদিনে সিনহা রাশেদের মৃত্যুর ঘটনার পর তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত হোসেনসহ ১৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সিনহা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করে র্যাব।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীর পরপর ৪টি গুলিতে ঘটনাস্থলে নিহত হন মেজর সিনহা। ঘটনার পাঁচদিন পর আদালতে মামলা করেন নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস। ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেয় র্যাব। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডথ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এ ছাড়া কক্সবাজারের বাহারছড়ার মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ ও মো. নিজাম উদ্দিনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান বাকি সাত আসামি। পরে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। একই সঙ্গে আপিল করেন দণ্ডিতরা।
এর আগে ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি লিয়াকত আলী বেকসুর খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেছেন। পটিয়ার অধিবাসী লিয়াকত আলী ঘটনার সময় বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক ছিলেন। পরে তাকে বরখাস্ত করা হয়। সে মাসের ৮ ফেব্রুয়ারি সিনহা হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীর ডেথ রেফারেন্স গত ৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে পৌঁছায়।
অন্যদিকে, সিনহা ‘লেটস গোথ নামে একটি ভ্রমণবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য প্রায় এক মাস কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার একটি রিসোর্টে অবস্থান করছিলেন। ওই কাজে তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।
তখন কক্সবাজারের পুলিশ বলেছিলেন, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে তল্লাশিতে বাধা দেন। পরে পিস্তল বের করলে চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী তাকে গুলি করেন। ঘটনার পাঁচ দিন পর ২০২০ সালের ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। তদন্ত শেষে র্যাব ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়।
এ মামলার আসামিরা হলেন টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ মোস্তফা, এপিবিএনের তিন সদস্য এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ, টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাবেক এএসআই সাগর দেব।
অপরদিকে, সিনহা নিহতের ছয় দিন পর পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও ওসি প্রদীপসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার অভিযোগে টেকনাফ থানার পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন সাক্ষী ও শামলাপুর চেকপোস্টে ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনকারী এপিবিএনের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা।
২০২১ সালেন ২৪ জুন মামলার অন্য পলাতক আসামি টেকনাফ থানার সাবেক এএসআই সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আসামিদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তদন্ত শেষে ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১৫-এর তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
২০২২ সালের ২৭ জুন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়। সে বছর বিচারকারজের প্রথম দফায় গত ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনে এ মামলায় সাক্ষ্য দেন দুজন। তারা হলেন মামলার বাদী ও সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস এবং ২ নম্বর সাক্ষী ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গে গাড়িতে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাত। দ্বিতীয় দফায় চার দিনে চার, তৃতীয় দফার তিন দিনে আট, চতুর্থ দফার দুই দিনে ছয়, পঞ্চম দফার তিন দিনে ১৫, ষষ্ঠ দফার তিন দিনে ২৪, সপ্তম দফার তিন দিনে পাঁচ ও অষ্টম দফায় তিন দিনে একজনের (তদন্তকারী কর্মকর্তা) সাক্ষ্য নেওয়া হয়। নবম দফায় ১৫ আসামির সাক্ষ্য নেওয়া হয়।