রুয়েট অ্যালামনাই ও বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকৌশলী মো. তাসরুজ্জামান বাবু দেশীয় প্রযুক্তিতে রেলের ইঞ্জিন ও কোচ ঘোরানোর টার্ন টেবিলসহ একাধিক উদ্ভাবনের জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস ইনকরপোরেশন থেকে “মোস্ট ইনোভেটিভ টেকনোলজি লিডার অব দ্য ইয়ার (২০২৫)” ক্যাটাগরিতে সিলভার স্টেভি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন।
মো. তাসরুজ্জামান বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন) পদে কর্মরত। গত ১৭ এপ্রিল স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস ইনকরপোরেশনের ওয়েবসাইটে বিজয়ীদের নাম প্রকাশ করা হয়। উল্লেখ্য, এই পুরস্কারের সহ-বিজয়ীদের মধ্যে রয়েছেন লিংকডইনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, গুগল, অ্যামাজনসহ বিশ্বের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্ভাবকগণ। আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কারটি আগামী ১৩ মে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে প্রদান করা হবে।
বিশ্বের অন্যতম স্বীকৃত ব্যবসায়িক পুরস্কার স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস এ বছর তাদের দ্বাদশ এশিয়া-প্যাসিফিক স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস ঘোষণা করে, যেখানে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মক্ষেত্রে উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগে যোগদানের পর প্রকৌশলী তাসরুজ্জামান দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত দেশের প্রথম স্বয়ংক্রিয় টার্ন টেবিল তৈরি করে আলোচনায় আসেন। এ উদ্ভাবন পূর্ববর্তী ব্রিটিশ আমলের বিদেশি টার্ন টেবিলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্টেভি অ্যাওয়ার্ডসের বিচারকমণ্ডলী তাঁর উদ্ভাবিত এই টার্ন টেবিলকে “দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম অটোমেটেড টার্ন টেবিল” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এই উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৪ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয় তাঁকে শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবক হিসেবে সম্মাননা দেয়। এছাড়াও, তিনি জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনআইডিও) কর্তৃক প্রদত্ত স্বীকৃতিপত্র লাভ করেন।
রেলের টার্ন টেবিল ব্যবহারের ফলে ইঞ্জিন ও কোচ ঘোরানো সহজ হয়, ফলে দুই পাশের চাকা সমানভাবে ক্ষয় হয় এবং স্থায়িত্ব বাড়ে। এছাড়া চালক ইঞ্জিনের পেছনে বসলে সিগন্যাল দেখতে না পারার ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা এই টার্ন টেবিল দিয়ে সমাধান সম্ভব। দীর্ঘদিন লালমনিরহাটে টার্ন টেবিল না থাকায় মিটারগেজ ট্রেনের ইঞ্জিন ও কোচ ঢাকায় এনে ঘোরাতে হতো, যা সময় ও খরচসাপেক্ষ ছিল।
২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে তিনি আরও কয়েকটি উদ্ভাবন করেন, যার মধ্যে রয়েছে — ভাঙনপ্রতিরোধী দীর্ঘস্থায়ী হুইলসেট গাইড, রি-রেইলিং ইকুইপমেন্টস (দুর্ঘটনায় কোচ ও লোকোমোটিভ উদ্ধারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি) এবং কোচের শিডিউল মেরামতের জন্য প্রথম ইলেকট্রিক লিফটিং জ্যাক।
তার এই অর্জন প্রসঙ্গে মো. তাসরুজ্জামান বলেন,”মোস্ট ইনোভেটিভ টেকনোলজি লিডার অব দ্য ইয়ার’ ক্যাটাগরিতে প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে এই সম্মাননা পেতে যাচ্ছি—আলহামদুলিল্লাহ, সত্যিই আনন্দের এবং কৃতজ্ঞতার অনুভূতি কাজ করছে। যখন দেখলাম আমার সহ-বিজয়ীরা গুগল, অ্যামাজন-এর মতো প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে এবং জানতে পারলাম যে টেসলা, গুগল, আইবিএম, স্টারবাকস, অ্যাডোবি, অ্যামাজন এবং লিংকডইনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা রেইড হফম্যানের মতো ব্যক্তিরাও এই পুরস্কার পেয়েছেন, তখন বিস্ময় আর আনন্দে ভরে উঠেছি। তবে একই সঙ্গে এটাও উপলব্ধি করেছি—প্রোফাইল নয়, কাজই আসল। কেউ যদি আন্তরিকভাবে কাজ করে, তবে সে যেখান থেকেই আসুক না কেন, সঠিক সময় ও প্ল্যাটফর্মে তার কাজের স্বীকৃতি মিলবেই। তাই আমি মনে করি, স্বীকৃতির প্রতি মনোযোগ না দিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এই পথ সহজ নয়, নানা প্রতিবন্ধকতা আসবে, কিন্তু একমাত্র অদম্য মানসিকতাই এগিয়ে যাওয়ার উপায়। প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে আপোষ করা যাবে না। কাজটা করতে হবে সেবামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, একে একটি মহৎ ব্রত হিসেবে দেখতে হবে। আমার কাজগুলো কোনো গ্রাউন্ডব্রেকিং উদ্ভাবন ছিল না, বরং নিজের কর্মক্ষেত্রের প্রেক্ষাপটে দেশীয় প্রযুক্তি ও কারিগরি বিদ্যার সর্বোত্তম ব্যবহারে স্বল্পখরচে সমস্যার সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টা ছিল। আমি চেয়েছি বিদেশ বা আমদানিনির্ভরতা থেকে বের হয়ে স্থানীয় সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সমাধান তৈরি করতে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই আমার প্রতিটি উদ্ভাবনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। জুরি বোর্ডও বিষয়টি বুঝেছেন, তাদের মন্তব্যে সেটি প্রতিফলিত হয়েছে।’’
প্রকৌশলী মো. তাসরুজ্জামান ৩৫তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০১৭ সালে রেলওয়েতে সহকারী যান্ত্রিক প্রকৌশলী পদে যোগদান করেন। তার জন্ম ও শৈশব চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তিনি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে এডিবি-জেএসপি স্কলারশিপ নিয়ে জাপানের ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ (গ্রিপ্স) থেকে পাবলিক পলিসিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।