নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার প্রবেশদ্বার ও দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মাছের পাইকারি বাজার চেয়ারম্যানঘাট এখন সিন্ডিকেটের কবলে। হরণী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আক্তারুজ্জামান দোলন ও সেক্রেটারী আমিনুল এহসান জুয়েল এর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের কথিত সমন্বয়ক কমিটি ও ৪০ সদস্যের আরো একটি কমিটিতে রয়েছেন বিএনপি ও এর অংগসংগঠনের নেতাকর্মীরা। অবৈধ টোল আদায়, নৌ-চলাচলের শিডিউল ঠিক করা, ঝুঁকিপূর্ণ ট্রলার-স্পীডবোটে ধারণ ক্ষমতার অধিক যাত্রী বোঝাই, মাছের ট্রলার থেকে জোরপূর্বক মাছ বিক্রিসহ ঘাটের সব রকম নিয়ন্ত্রণ করছে দোলন-জুয়েল নেতৃত্বাধীন কমিটি।
জানা যায়, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর চেয়ারম্যানঘাটের সী-ট্রাকের ইজারাদার জিএম কাজলসহ ফ্যাসিবাদী শাসনের সমর্থক ও সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় পুরো ঘাট, মাছ বাজার ও চেয়ারম্যানঘাট বাজার নিয়ন্ত্রণে নেয় হরণী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আক্তারুজ্জামান দোলন ও সেক্রেটারী আমিনুল এহসান জুয়েল। মাছ ব্যবসায়ীদের ডাকের বাক্স দখলে নেয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা, যাদের অনেকে বাস্তবে মাছের ব্যবসার সাথে জড়িত নয় বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।
সীট্রাক ইজারাদারের প্রতিনিধি ফাহিম উদ্দিন জানান, ৫ আগস্টের পর ইজারাদারের অনুপস্থিতিতে সী-ট্রাকের আয় হতে ইজারাদারের অংশ হরণী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আক্তারুজ্জামান দোলনের কাছে জমা হয়। গত ৭-৮ মাসে ইজারাদার কোন টাকা-পয়সা পায়নি।
এদিকে মাছ ব্যবসায় সিন্ডিকেটের অবৈধ হস্তক্ষেপের শিকার হাতিয়া উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ও মাছ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন ইলিয়াছ নিজ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। সম্প্রতি এ সিন্ডিকেটের দখলদারিত্বের শিকার হয়ে তিনি সরব হয়েছেন।
জানা যায়, ২২ এপ্রিল (সোমবার) চেয়ারম্যানঘাট মাছ বাজারে অবস্থিত ইলিয়াছের গদিতে মাছ বিক্রি করতে আসার পথিমধ্যে দাদনগ্রহীতা বোট মালিক মুজাম্মেল হাজীর কাছ থেকে জোর পূর্বক মাছ নিয়ে ডাকের বাক্সে তুলে বিক্রি করে সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
ভুক্তভোগী বোট মালিক মুজাম্মেল হাজী জানান, তিনি ইসমাইলের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা দাদন নিয়েছিলেন, তাই চুক্তি অনুযায়ী ইসমাইলের গদিতে মাছ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা জোর করে অন্যত্র বিক্রি করে ১৭ লাখ টাকার মাছের কমিশন আত্মসাৎ করা হয়।
ইসমাইল হোসেন ইলিয়াস জানান, হাতিয়া চেয়ারম্যানঘাটটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাইকারি মাছের বাজার। সম্প্রতি এই বাজারটি দখল করে সাধারণ ব্যবসায়ীদের মাছ বিক্রি করে কমিশন ভাগিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে এখানে। এ জন্য বিএনপি নেতা দোলন, ইমাম হাসান ও জুয়েলের নেতৃত্বে ৫১ জনের সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়েছে। এদের অনেকে মাছ ব্যবসার সাথে জড়িত নয় কিন্তু তারা এখন মাছ বাজার নিয়ন্ত্রন করছেন। আমি উপজেলা যুবদলের আহবায়ক। অথচ তারা আমার দাদন দেওয়া ট্রলারের মাছ জোরপূর্বক নিয়ে বিক্রি করে দেন। প্রায় ১৭ লাখ টাকা মাছ বিক্রির কমিশনও ভাগিয়ে নেয় এ সিন্ডিকেট।
ইসমাইল আরো জানান, মাছ বাজার নিয়ে তাদের এই অপকর্মের বিষয়ে বিএনপির জেলা ও বিভাগীয় নেতৃবৃন্দকে বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আক্তারুজ্জামান দোলনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মাছ বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমি ছেলেদেরকে ইসমাইলের গদির মাছ বিক্রি করতে নিষেধ করেছি তবুও তারা বিক্রি করে ফেলেছে। এতে যে কমিশন এসেছে তা ইসমাইলকে ফেরত দিতে বলে বিষয়টি মীমাংসা করে দিয়েছি। ঘাট নিয়ন্ত্রণের ৪০ জনের কমিটিতে আমি নেই, ১৩ সদস্যের সম্মিলিত সমন্বয়ক কমিটিতে আছি। এছাড়া যাত্রী পারাপারের ঘাট তার নিয়ন্ত্রণে থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
এদিকে চেয়ারম্যান ঘাটে সীট্রাক, স্পীড বোট ও ট্রলারে যাত্রী ও মালামাল পারাপারেও এ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য রয়েছে বলে জানা যায়। সীট্রাকের টিকিট বিক্রিতে হস্তক্ষেপ, নির্ধারিত সময়ের আগে কম যাত্রী নিয়ে সরকারি সীট্রাক ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। ট্রলার ও স্পীডবোটে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রী পারাপারের মাধ্যমে এ ঘাটের নিয়ন্ত্রণ করছে ১৩ সদস্যের সম্মিলিত সমন্বয়ক কমিটি।
এ বিষয়ে সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসন ও কোস্টগার্ডের এক বৈঠকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সীট্রাকের ইজারাদারকে সীট্রাকের সিডিউল ও টিকেট বিক্রি এবং ঘাটের ইজারাদারকে ঘাটের যাবতীয় বিষয় দেখাশুনা করার নির্দেশনা দিলেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে তা উপেক্ষিত হয়ে আসছে।
সম্প্রতি হাতিয়া উপজেলা প্রশাসন হাতিয়ার ৩৯টি হাটবাজার ইজারা দেয় যার মধ্যে চেয়ারম্যানঘাট বাজার একটি। এ সিন্ডিকেট সুকৌশলে চেয়ারম্যানঘাট বাজারের ইজারা নিয়ে জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা সিএনজি, বাস-মিনিবাস, প্রাইভেট কার ও ট্রাক থেকে টোল আদায় করছে বলে জানা যায়। স্থানীয়রা জানায় ইতোপূর্বে চেয়ারম্যানঘাট বাজারের কোন ইজারাদার টোল বা চাঁদা আদায় করেনি।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর হাতিয়া উপজেলা উত্তর শাখা এক লিখিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করে জানায়, চেয়ারম্যানঘাট বাজারের ইজারাদার রিয়াজ সব ধরণের যানবাহন ও পরিবহন থেকে টোলের নামে চাঁদা আদায় করছে। এর ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হচ্ছে। টোলের ভয়ে এখন এদিকে যাত্রীবাহী গাড়ীর পরিমাণ কমে যাওয়ায় জনসাধারণ চরম ভোগান্তিতে রয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী শামীম বলেন, চেয়ারম্যান ঘাট বাজারে আসা ট্রাক, সিএনজি সহ বিভিন্ন যাত্রী পরিবহন থেকে অবৈধভাবে টোল আদায়ের বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। আমরা এ বিষয়ে চেয়ারম্যান ঘাট বাজারের ইজারাদারকে সতর্ক করেছি। এছাড়া উপজেলা পরিষদ থেকে ইজারা দেওয়া প্রত্যেক বাজারের ইজারাদারদের অবৈধ টোল আদায় বন্ধে চিঠি ইস্যু করেছি।
এদিকে দোলন-জুয়েল সিন্ডিকেটের অনিয়মের বিষয়ে উপজেলা এবং জেলা বিএনপি অবগত রয়েছেন বলে জানা যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা কর্মী জানান, এ সকল অনিয়মের কারণে তাদেরকে জেলাতে ডেকে নিয়ে তিরস্কার করা হয়েছে। তাতেও কোন পরিবর্তন হয়নি।
এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সভাপতি একেএম ফজলুল হক খোকন বলেন, দলের নাম ভাঙ্গিয়ে যারা চাঁদাবাজি বা দলবাজি করবে তাদের বিরুদ্ধে দল কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ যারা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে তাদেকে ছাড় দেওয়া হবেনা।
দক্ষিণ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার চেয়ারম্যানঘাট হতে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে এই ঘাটে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে এবং ব্যবসায়িক পরিবেশও ভেঙে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।