ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে দলীয় রাজনীতিতে নতুন কৌশল আনছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চারবারের সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলটি একদিকে যেমন নিজেদের গায়ে লেগে থাকা ‘ফ্যাসিবাদ’ তকমা সরাতে চাইছে, তেমনি নানা বাধা পেরিয়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে রাজনীতির মাঠে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাপাকে জাতীয় সংলাপে ডাকা হয়নি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার হত্যার অভিযোগে দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রাজধানীতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সভা-সমাবেশের অনুমতি মেলেনি। এমনকি দলের শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে আসতেও ভয় পাচ্ছেন। এসব নিয়ে দলের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও তা প্রকাশ করতে পারছে না।
এমন অবস্থায় রাজনীতির মাঠে আবার ঘুরে দাঁড়াতে ও নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনছে দলটি। অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের পরিবর্তে তরুণদের নেতৃত্বে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিতর্কিতদের আপাতত নেতৃত্বের বাইরে রাখা হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চুপ রয়েছে রওশন এরশাদপন্থি অংশ।
দল মনে করছে, সরকার নয়, তাদের সঙ্গে রেষারেষি ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের। সেজন্য দলের পক্ষ থেকে সমন্বয়কদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চলছে। নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে কোনো ধরনের চাপ দেবে না দলটি। দলের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত করতে নেওয়া হয়েছে নামা কর্মসূচি। দলের চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় ও কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতারা নিয়মিত বৈঠক করছেন। তবে নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগসহ সব দলের অংশগ্রহণ চান। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও জাপার বিতর্কিত এবং অভিযুক্ত নেতাদের বিচার ও শাস্তিতে জাপার কোনো অমত নেই।
জাপার কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব নেতা বলেছেন, তারা সরকারের পক্ষে রয়েছেন। সব ধরনের সহযোগিতাও করতে চান। তারা চান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে সংস্কার ও পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে।
এ ব্যাপারে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘এত বড় গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে পরিশীলিত রাজনীতি ও বৈষম্যবিরোধী সমাজব্যবস্থা কায়েমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর থাকা বাধাগুলো দূর করার সুযোগ এসেছে। এখন সবাই চায় সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মূল সংস্কার শেষে সব দলকে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্বাচন দিক। নির্বাচনী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করুক। সরকারের উচিত সব দলকে নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই কাজগুলো করা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরাও তরুণদের নেতৃত্বে আনছি। মানুষের আকাক্সক্ষা ও তরুণদের ভাবনার সমন্বয় করে জাপা ভবিষ্যৎ রাজনীতি করবে।’
আসছে নেতৃত্বে পরিবর্তন : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আমরা এখন দলীয় রাজনীতিকে নতুনভাবে নিতে চাইছি। অভ্যুত্থানের পর মনে হলো রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তনকে ধরতে না পারলে আমরা পিছিয়ে যাব। সেজন্য তরুণদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে মানুষের আকাক্সক্ষাকে মিলিয়ে কর্মসূচি তৈরি করেছি। সেই কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে যাব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সুবিধা হচ্ছে প্রত্যেক জেলায় আমাদের কমিটি আছে। কিন্তু সে কমিটিতে বেশিরভাগই বয়সী, তরুণদের সংখ্যা কম। সে কারণে আমরা তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি। প্রত্যেক জেলা ও উপজেলায় তরুণ নেতৃত্ব আনব। সংগঠন পুনর্গঠনের চিন্তাভাবনা করেছি। ইতিমধ্যেই আমরা আমাদের অঙ্গসংগঠন ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে বসেছি। তাদের চিন্তাভাবনা শুনেছি। সেখান থেকেই এই পরিবর্তনের ভাবনা উঠে এসেছে।’
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধার অভিযোগ : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শীর্ষ নেতা বলেন, এখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা আসছে। কাকরাইল মোড়ে আমরা একটা সমাবেশ করতে চেয়েছিলাম। করতে দেওয়া হয়নি। উল্টো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একটি অংশ দলীয় কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে। ভাঙচুর করেছে। এরপর গত ১ জানুয়ারি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান করতে পুলিশ মৌখিকভাবে অনুমোদনও দেয়। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগের দিন ৩১ ডিসেম্বর রাতে বলেছে, ওপরের নির্দেশে অনুষ্ঠান করা যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কবে হবে, ঠিক নেই। এখন কাজ হলো দল গোছানো। দলে নতুন নেতৃত্ব আনার চেষ্টা করছি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে জাপার প্রতি মানুষের সমর্থন আছে।’
অবশ্য নেতাকর্মীরা চাঙা আছেন বলে দাবি করেন এক প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি বলেন, ‘যত বাধা আসবে, দল তত এগিয়ে যাবে। পার্টি অফিসে আগুন দিল, তাতে পার্টি আরও একধাপ এগিয়ে গেছে। যারা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন, তারাও জেগে গেছেন। নেতারা সবাই আছেন। তারা নিয়মিত পার্টির কাকরাইল ও বনানী চেয়ারম্যান কার্যালয়ে যাচ্ছেন, সভা করছেন। ধরপাকড় নেই। তবে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ পার্টির কয়েক নেতার বিরুদ্ধে কিছু মামলা হয়েছে।’
এই নেতা আরও বলেন, ‘চেয়ারম্যানের বনানী অফিসে নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত সাংগঠনিক মিটিং হয়েছে। রওশন এরশাদ শান্ত। দলীয় বিরোধ নেই। তাদের অংশের কোনো কার্যক্রম নেই।’
সব দলকে নির্বাচনে চায় জাপা : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘জাপা চায় আওয়ামী লীগসহ সব দল নির্বাচনে আসুক। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সব দলকে নির্বাচনে আসার সুযোগ দিতে হবে। বিগত শাসক দল আওয়ামী লীগ বা আমরাও যদি কোনো দোষ করে থাকি, মামলা হবে, বিচার হবে, হোক। কিন্তু দোষী লোক ছাড়াও তো দলে আরও নেতা আছে। সরকার তাদের নিয়ে বসতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই না কোনো মারামারি, হানাহানি, যারা অপরাধ করেছে, দুর্নীতি করেছে, তাদের বিচার হোক। দলের বাকি নেতাদের নিয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা ভালো নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করা হোক। যাতে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। এই সরকার বেসিক (মৌলিক) কিছু সংস্কার করুক ও পরবর্তী সরকার সেগুলোর বৈধতা দিক।’
জাপার আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘শুধু বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও সমন্বয়করা মিলে নির্বাচন করলে তো হবে না। আওয়ামী লীগ, জাপা, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ সব রাজনৈতিক দলকে নিয়েই নির্বাচন করতে হবে। যারা অপরাধ করেছে, তাদের বিচার হোক। কিন্তু দলকে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও জামায়াতে ইসলামী বা বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি, রুখতে পারেনি।’
সূত্র- দেশ রুপান্তর