গুম, খুন ও ভোটাধিকার হরণের মাধ্যমে লুটপাট, অর্থপাচারসহ আকুণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনেও নেই অনুশোচনা। ভুল শুধরে রাজনীতিতে ফেরার প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে তারা এখনও দাবি করছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ষড়যন্ত্র করে তাদের উৎখাত করা হয়েছে। তারা পুরোনো মসনদ ফিরে পেতে চায়। অথচ আওয়ামী লীগই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি নিয়ে রাজনীতি করছে। ভয়ংকর পতনের তিন মাস পেরুলেও কর্মসূচি ঘোষণা করছেন দেশ ছাড়া নেতারা। বঞ্চিত গুটিকয়েক কর্মীও তাদের নির্দেশনা অনুসারে বেছে নিচ্ছেন ‘আত্মঘাতী’ পথ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জনরোষের মধ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করে কিছু কর্মীকে বিপথে ঠেলে দিয়ে আওয়ামী লীগ মূলত চায়, কিছু লাশ পড়ুক। আর এই লাশের ওপর ভর করে তারা সরকারকে বিব্রত করে নিজেদের ফেরার পথ খুঁজছে। এতে দলটি আরও জনবিচ্ছিন্ন হবে। আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। বরং ক্ষমা চেয়ে ভুল শুধরে মাঠে আসা উচিত তাদের।
তবে এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কোনো কোনো নেতা বলছেন, ‘আমাদের এখন চুপ থাকাই বেটার। এক সময় মানুষ নিজ থেকেই বলবে, আওয়ামী লীগ কথা বলুক।’ কোনো কোনো নেতা চাইছেন, ‘মাঠ গরম থাকুক। চুপ থাকলে হারিয়ে যাবে। বরং এই সরকারকে সমর্থন দিয়ে তাদের কাজের সমালোচনা করে এবং কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকতে হবে। এর মধ্য দিয়ে তৈরি হবে আওয়ামী লীগের ফেরার পথ।’
আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন পরিকল্পনা ও কর্মসূচির আলোকে গুটিকয়েক কর্মী মাঠে নামলেও অধিকাংশই আত্মগোপনে। তারা বলছেন, ২০-২৫ বা কেউ ৩০ বছর রাজনীতি করেছেন। তারা মাঠে শ্রম দিয়েছেন। আর শেখ পরিবারের সদস্যসহ গুটিকয়েক নেতা ক্ষমতার ক্রিম খেয়েছেন। এখন তো সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না। এক সময় রাজনীতি করেছেন, পিছুটান ছিল না। আবেগ-মোহ কাজ করেছে। এখন পিছুটান আছে, বউ-বাচ্চা আছে। তারা মরলে পরিবারের সদস্যদের কে দেখবে? তাদের লাশ নিয়ে যারা রাজনীতি করে ক্ষমতায় আসবে, সেই নেতাদের কি সময় হবে তাদের পরিবার দেখার?
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের ভয়ংকর পতনের পর থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক কেউ দলটির পক্ষ থেকে কথা বলেননি। এমনকি, এখনও সরাসরি বক্তব্য আসেনি- কীভাবে কোন প্রেক্ষাপটে দেশ ছেড়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের পক্ষে নানাজন নানান সময়ে বিবৃতি দিলেও সেটি অফিসিয়াল প্রক্রিয়ায় আসেনি। ৫ আগস্ট থেকে এখনও আওয়ামী লীগের মেইল থেকে কোনো মেইল আসেনি গণমাধ্যমে। অথচ প্রতিদিন সেটি থেকে একাধিক মেইল আসতো।
ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের পর ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ। এ কারণে এবারও দলটিতে ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্ব আসছে বলে গুঞ্জন এসেছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্ব ঘোষণাও করে ফেলেছে কেউ কেউ। তবে এটি উড়িয়ে দিয়েছেন নেতারা। তারা বলছেন, ঘটনাটি সত্য নয়। কিন্তু নেতাদের এই বক্তব্যেরও সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রিপরিষদের সাবেক এক সদস্য বলেন, ‘সহসাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসছে না। ওয়ান/ইলেভেনের মতো ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালানোরও প্রয়োজনীয়তা নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশে যে কোনো জায়গা থেকেই দল পরিচালনা করা সম্ভব। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার বিকল্প তৈরি হয়নি। তার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়নি।’
শহীদ নূর হোসেন দিবসসহ সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কর্মসূচি দিয়ে পালন করেনি আওয়ামী লীগ। গুটিকয়েক কর্মী কর্মসূচিতে এসে বেকায়দায় পড়লেও কোনো নেতাকে আসতে দেখা যায়নি। এমনকি কর্মসূচির ঘোষকও ছিলেন না। বরং দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবিসহ কর্মসূচি পালনের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি নিয়ে আটক হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ঢাকায় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গণপিটুনিরও শিকার হয়েছেন কয়েকজন।
অব্যাহতভাবে ভোটাধিকার হরণ ও আকুণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকার কারণে গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়ার পর এই মুহূর্তে কর্মসূচি দেওয়া উচিত কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, ‘রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে বিভিন্ন জাতীয় ও দলীয় দিবসে কর্মসূচি থাকবে। করতে দেবে কি দেবে না, এটা পরের বিষয়।’
তবে নেতাদের কথন ও বিবৃতি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রিপরিষদের সাবেক এক সদস্য বলেন, ‘চুপচাপ থাকাই আওয়ামী লীগের জন্য কাজের। কথা না বলাই বেটার। মানুষই এক সময় চাইবে, আওয়ামী লীগ কথা বলুক। মানুষের কথা তো কেউ বলে না। বিএনপি যা বলছে, নির্বাচন নিয়ে বলে। তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য।’
এ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের পাশাপাশি কর্মীদের মধ্যেও আছে মিশ্র মত। কেউ বলছেন, নেতারা আত্মগোপনে। কর্মীরা কেন মাঠে নেমে জীবন বিপন্ন করবে? বরং ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল, অন্তত ১৬ মাস নীরব থাকুক। আবার কেউ বলছেন, এখনই এই সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। মূলত দ্বিতীয় এ পক্ষটি মনেই করে না, আওয়ামী লীগের কোনো ভুল ছিল। যার কারণে পতন হয়েছে। বরং তারা মনে করে, ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘এটা (গণঅভ্যুত্থান) যে একটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল, ইউনূস সরকারের কথাবার্তা ও কাজ-কর্মে সেটি ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন।’
বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘ষড়যন্ত্র হচ্ছে সেটা আমরা জানতাম। কিন্তু কোটা ইস্যু ধরে সেটি যে এতদূর গড়াতে পারে, ওইটা আমরা কেউই ভাবতেই পারিনি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীগুলোও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।’