দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত-সমালোচিত একটি দল জাতীয় পার্টি। স্বাধীন বাংলাদেশে দুই মেয়াদে সরকারও গঠনের ইতিহাস আছে দলটির। কারাগারে বন্দি থেকেও চমক দেখিয়েছিলেন দলের চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তেমনি ক্ষণে ক্ষণে মত বদলানোর কারণেও হয়েছিলেন সমালোচিত।
সরকারি দলের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ, আবার ওই সংসদের বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকা এবং সেই অবস্থায় সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান করে নেওয়া জাতীয় পার্টি ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে দল গঠনের পর দুই মেয়াদে সরকারও গঠন করে দলটি। কিন্তু ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ক্ষমতা হারালেও রংপুর অঞ্চলে একক আধিপত্য ছিল জাতীয় পার্টির। এ কারণে রংপুরকে একটা সময় বলা হতো জাতীয় পার্টির দুর্গ। তবে সেই দুর্গ এখন আর আগের অবস্থানে নেই। দলীয় কোন্দল, বিভক্তি, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জোট গঠন, সাংগঠনিক দুর্বলতা, বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণসহ নানান কারণে আস্থার সংকটে পড়েছে দলটি। এমনকি জেলা, উপজেলাসহ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও সুবিধা করতে পারেনি তারা। দলটি ক্রমেই জনপ্রিয়তা হারিয়ে রংপুর বিভাগের পরিবর্তে রংপুর জেলাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।
যদিও দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে রংপুরে বেশ শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে তারা। তবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে সে আশায় গুড়েবালির সম্ভাবনাও আছে।
দলীয় কোন্দল, বিভক্তি, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জোট গঠন, সাংগঠনিক দুর্বলতা, বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণসহ নানান কারণে আস্থার সংকটে পড়েছে দলটি।
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর ফলাফলে দেখা যায়, ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি ‘জাতীয় পার্টি’গঠনের পর ওই বছরের ৭ মে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৫৩টি আসন নিয়ে সেবার সরকার গঠন করে দলটি। এর দুই বছরের মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই ভোট বর্জন করলে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। কিন্তু এরপর থেকে জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা কমতে থাকে।
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সারাদেশে ৩৫টি আসনে জয়ী হয়। এরমধ্যে রংপুর বিভাগের ৩৩টির বিপরীতে জাপার দখলে ছিল ১৭টি আসন। এছাড়া আওয়ামী লীগ ৯টি, বিএনপি একটি, সিপিবি তিনটি, জামায়াত একটি, বাকশাল ও ন্যাপ একটি করে আসন পেয়েছিল। ওই বছর জাপা প্রার্থীদের জয়ে ভোটের ব্যবধানও ছিল অনেক। দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় ৫টি আসনে নির্বাচন করে ৫টিতেই জয়লাভ করেন।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট আসন কমে ৩২টি হলেও রংপুরে কিছুটা ভালো করেছিল জাপা। ওই বছর রংপুর বিভাগে জাতীয় পার্টি পায় ২১টি আসন। আওয়ামী লীগ ৮, বিএনপি তিন ও জামায়াত একটি আসন পায়। ’৯৬ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসন কম পেলেও সুবিধা করেছিল জাপা ও বিএনপি।
এই নির্বাচনেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কারাগারে বন্দি থেকে ৫টি আসনে নির্বাচন করে ৫টিতেই জয়লাভ করেন। ১৯৯৬ এর নির্বাচনের পর থেকে এ অঞ্চলে জাপার ছন্দপতন ঘটতে থাকে। আসনগুলোতে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করে নিজেদের আধিপত্য জানান দিতে থাকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত। যার প্রভাব পড়ে ২০০১ সালের নির্বাাচনে। ওই নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জোট করেও ২১ থেকে কমে ১৪টি আসন পায় জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগ ৬টি, বিএনপি ৯টি ও জামায়াত পায় ৪টি আসন।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে চারদলীয় ঐক্যজোটের বিপরীতে আওয়ামী লীগ-জাপার সমন্বয়ে গঠিত হয় মহাজোট। মহাজোট গঠনে বিএনপি-জামায়াত কোণঠাসা হলেও সুবিধা করতে পারেনি জাতীয় পার্টি। এতে আওয়ামী লীগের অবস্থান আরও পোক্ত হলেও আসন হারায় জাতীয় পার্টি। সেবার জাতীয় পার্টি পায় মোট ২৩টি আসন। এরমধ্যে রংপুর বিভাগে ছিল ১২টি। আর আওয়ামী লীগ পায় ২১টি আসন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে কিছুটা ভালো করলেও রংপুর বিভাগে জাতীয় পার্টির আসন আরও কমে যায়। ওই নির্বাচনে ৩৪টি আসনের মধ্যে রংপুর বিভাগে মাত্র ৭টি আসন পায় জাপা। বাকি আসনগুলো পায় আওয়ামী লীগ জোট। তবে বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জন করায় এই নির্বাচনটি ছিল বিতর্কিত।
রাতের ভোটখ্যাত ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে মোট ২৩টি আসনের মধ্যে রংপুর বিভাগে সাতটি আসন পায় দলটি। আওয়ামী লীগ পায় ২৫টি এবং বিএনপি একটি আসন।
জাতীয় পার্টির বেড়ে ওঠা একটা ইমোশনাল (আবেগ) প্ল্যাটফর্মের ওপর। রংপুরের মানুষের ইমোশন নিয়ে তারা বেড়ে উঠেছে। সেই ইমোশন এখন কেটে গেছে।
এরমধ্যে রংপুরে দুটি, নীলফামারীতে দুটি, কুড়িগ্রামে একটি, গাইবান্ধায় একটি ও লালমনিরহাটে একটি আসন পায় জাতীয় পার্টি। তবে জাতীয় পার্টি মহাজোট ছাড়া এককভাবে কোনো আসনে জয়লাভ করতে পারেনি।
অপরদিকে বিএনপি একটি আসন পেলেও আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন তারাই। যদিও এই নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তোলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট।
২০১৯ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় পদ নিয়ে শুরু হয় জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের দ্বন্দ্ব। আবারো ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি। রওশনপন্থিদের বাদ দিয়ে জিএম কাদের তার অনুসারীদের নিয়ে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসনে ছাড় পেয়েছিল জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। ছাড় পাওয়া ২৬ আসনের ১১টিতে জিততে পেরেছেন জাপার প্রার্থীরা। এরমধ্যে রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, কুড়িগ্রাম-১ থেকে একেএম মোস্তাফিজুর রহমান ও রংপুর-৩ আসন থেকে জিএম কাদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সমঝোতার বাইরে কোনো আসনে জিততে পারেননি দলের প্রার্থীরা। এই নির্বাচনও বর্জন করেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে জাপা নির্বাচনে অংশ নেয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশে মন্ত্রিসভায় থাকে, আবার বিরোধী দলেরও ভূমিকা পালন করে জাতীয় পার্টি। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনেও সমঝোতার মাধ্যমে আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দল হয় দলটি।
যদিও দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে রংপুরে বেশ শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে তারা। তবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে সে আশায় গুড়েবালির সম্ভাবনাও আছে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে সংসদীয় আসনে কোনো রকমে টিকে থাকতে পারলেও জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তেমন সুবিধা করতে পারেনি জাতীয় পার্টি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চলতি বছর রংপুর বিভাগের আট জেলার ৫৮টি উপজেলায় দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে অনেক উপজেলায় প্রার্থী দিতে পারেনি জাতীয় পার্টি। যেসব উপজেলায় প্রার্থী ছিলেন তারাও সুবিধা করতে পারেননি। অনেকে জামানত হারিয়েছেন। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচন বর্জন করলেও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা কোনো উপজেলায় জয়ী হতে পারেননি।