কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু। আর শেষটা হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ স্বৈরা শাসনের পতনের মাধ্যমে। কেন হঠাৎ পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন শেখ হাসিনা? এর পেছনে কি শুধু কোটার সংস্কারই ছিলো? চলুন এক নজরে দেখে আসি পুরো কোটা সংস্কার আন্দোলনটি।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রথম কোটার প্রবর্তন করা হয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মোট কোটা ছিলো ৫৬ শতাংশ। যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতগোষ্ঠী কোটা ৫ শতাংশ ও প্রতিবন্ধী কোটা ১ শতাংশ। তবে সমস্যা যেটা হয় তা হচ্ছে বেশিরভাগ চাকরি প্রত্যাশিদেরই ছিলো না কোন কোটা। অর্থাৎ তাদের সবার প্রতিযোগিতা করা লাগতো মাত্র ৪৪ শতাংশ সিটের জন্য।
এই বৈষম্যের কারণে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে রাস্তায় নামেন। তাদের দাবি ছিলো কোটা সংস্কার করা। যেন মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। এছাড়াও তখন সরকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও উঠে যে এই কোটার ব্যবহার করে সরকার তার অনুগত লোকদের সব খাতে বসাচ্ছে যেন সব ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে।
শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেন। তাদের দাবির জবাবে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধারা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের বাচ্চারা কোটা পাবে?” তার এই বক্তব্যের ফলে ফেটে পরে ছাত্রসমাজ। আরও জোরদার হয় আন্দোলন। কিন্তু সেই আন্দোলন দমাতে সরকার পুলিশ ও ছাত্রলীগকে দায়িত্ব দেয়। একদিকে পুলিশ টিয়ারশেল ছোড়ে ও লাঠি চার্জ করে। অন্যদিকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পরে নিরস্ত্র ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর।
এই হামলায় বহু শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হামলার ভিডিও ছড়িয়ে যায় দেশ বিদেশে। সরকার ফেসবুকসহ বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ইতমধ্যেই এই হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নজর কাড়ে। এবং অনেকটা চাপে পড়েই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা প্রথা বাতিল করে দেন এবং শেষ হয় আন্দোলন। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপনও জারি করে সরকার।
এর পর কেটে যায় ৬ বছর। ২০২৪ এর নির্বাচন শেষে ৪র্থ বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। শপথ নেয়ার ৬ মাসের মাথায়, ৫ই জুন, ২০১৮ তে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দেয় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগ এবং কোটা পুনর্বহাল করা হয়। ফলে আবারও ফুঁসে ওঠে ছাত্র সমাজ।
এবার বৈসম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাস্তায় নামে। এবারও তাদের দাবি কোটা সংস্কারের। সরকারের বেশ কিছু মন্ত্রী বলেন তাদের দাবির পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়েছে এবং বিষয়টি প্রকৃয়াধীন রয়েছে। শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরতে বলেন তারা। শুনানির দিন ধার্য্য করা হয় ৭ আগস্ট। কিন্তু ছাত্রদের বুঝতে আর বাকি ছিলো না যে, এইটা সরকারের একটা কৌশল কোটা পুনর্বহাল করার। কারণ বিচার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রশাসনের সব ক্ষেত্রই আওয়ামী লীগ সরকারের অনুগত। তাই তাদের দাবি ছিলো সংসদে আইন পাশ করে কোটা প্রথা সংস্কার করা।
২০২৪ সালের ১৪ জুলাই চীন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে অভিহিত করেন। তার এই বক্তব্যের প্রতিকৃয়ায় সেদিন রাতেই উত্তাল হয়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকেন, “তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার।”
শিক্ষার্থীদের এই স্লোগানকে ইস্যু করে একে একে উস্কানীমূলক বক্তব্য দিতে থাকেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সহ অনেকেই। ওবায়দুল কাদের তার এক বক্তব্য বলেন, “এসব রাজাকারদের প্রতিহত করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট”। তার এই উষ্কানীমূলক বক্তব্যের পর সভাপতী সাদ্দামের নেতৃত্বে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঠিক ২০১৮ এর মতো এবারও সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলে পরে ছাত্রলীগ। লাঞ্ছিত করা হয় নারী শিক্ষার্থীদেরও। তবে এবার আর শিক্ষার্থীরা চুপ থাকেনি। তারাও পালটা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে পালাতে শুরু করে ছাত্রলীদের নেতাকর্মীরা। একে একে দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ছাত্রলীগ মুক্ত’ ঘোষণা করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
ছাত্রলীগের চেষ্টা বিফলে গেলে মাঠে নামে পুলিশ। তারা শিক্ষার্থীদের উপর লাঠিচার্জ করে, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে এমনকি ছররা গুলিও চালায়। একে একে সব বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। এমন অবস্থায় রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদকে পুলিশ নিরস্ত্র অবস্থায় খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পরে আবু সাঈদের হত্যার ভিডিও। এতদিন চুপ থাকলেও আবু সাঈদের মৃত্যুর পর মাঠে নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না, সারা দেশের স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেয় আন্দোলনে। রাজধানীর রামপুরা, উত্তরা, যাত্রাবাড়িসহো দেশের অনেক জায়গায় শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ। ১৭ তারিখও ইস্টওয়েস্ট, ব্র্যাক, এমআইএসটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইম্পেরিয়াল কলেজের ছাত্রসহ সারা দেশে অন্তত ১০ জন নিহত হয়।
পরদিন অর্থাৎ ১৮ জুলাইও চলে সংঘর্ষ। রামপুরায় বিটিভির ভবনে ধরিয়ে দেয়া হয় আগুন। হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হয় গুলি। একের পর এক খবর আসতে থাকে ছাত্র হত্যার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরতে থাকে এসব ভিডিও। অবস্থা ক্রমেই আইনশৃঙ্গখলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১৮ জুলাই রাত থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট। ফলে পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাংলাদেশ। জারি করা হয় কারফিউ এবং রাস্তায় সেনা বাহিনী মোতায়েন করা হয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রুতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, শিক্ষার্থীরা ডেটা সেন্টারে আগুন দিয়েছে তাই বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধের পেছনে ছিলো এক ভয়াবহ পরিকল্পনা। সারা দেশে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে শুরু হয় ক্র্যাক ডাউন। বিভিন্ন বাহিনীতে থাকা সরকারের অনুগত লোকদের নামিয়ে দেয়া হয় রাস্তায়। এবার আর ছররা গুলি না। চাইনিজ রাইফেল, অ্যাসল্ট রাইফেল ও পিস্তল নিয়ে একে একে গুলি করে মারা হয় নিরস্ত্র ছাত্রদের। শিক্ষার্থীদের বুকে ও মাথায় টার্গেট করে চালানো হতে থাকে গুলি। ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই চলে এই গণহত্যা।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এই গণহত্যার খবর খুব একটা প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু ২৩ জুলাই ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের চাপে ইন্টারনেট চালু করতে বাধ্য হয় সরকার। তবে বন্ধ থাকে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ সহো বেশ কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কিন্তু ভিপিএন’র কল্যাণে সামাজিক মাধ্যমে একে একে প্রকাশ পেতে থাকে নৃশংস গণহত্যার ভিডিও ও ছবি। শুধু তাই না, প্রতি রাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় লাইট বন্ধ করে ব্লক রেইড চালিয়ে আন্দোলনের সাথে জড়িত শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কারোই আর বুঝতে বাকি থাকে না কেন ইনটারনেট বন্ধ করা হয়েছিল।
এরই মধ্যে তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুন আর রশীদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বায়ককে নিরাপত্তার অযুহাতে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রাখে এবং একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করায় যাতে বলা হয়, তারা সব আন্দোলন প্রত্যাহার করছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বুঝে ফেলে এই বক্তব্য জিম্মি করে আদায় করা। তাই তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনার ক্ষমা চাওয়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগ এবং সকল হত্যাকাণ্ডের বিচারসহো ৯ দফা দাবি প্রস্তাব করেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে শেখ হাসিনা একে একে বিটিভি ভবন, ভাঙ্গচুর হওয়া মেট্রো রেলের স্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে কান্না করেন। যা শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মধ্যে জন্ম দেয় চরম ক্ষোভ। তারা বলেন এতগুলো মৃত্যুর চেয়ে মেট্রো রেল আর বিটিভির মূল্য বেশি? একে একে রাস্তায় নেমে আসেন মাদরাসার শিক্ষার্থীরা, অভিভাবক, শিক্ষক, অভিনয় শিল্পী, ব্যান্ড তারকাসহ সর্বস্তরের মানুষ। এমনকি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান রাজধানীর রিকশা চালকরাও।
সরকার চাপে পড়ে আশ্বাস দেয় যে সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করা হবে এবং আটক ৬ সমন্বায়কদের ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয়। নিহত শিক্ষার্থীদের স্বরণে ৩১ জুলাই সরকারিভাবে শোক ঘোষণা করা হয়। সারা দেশের ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণ সেই শোক প্রত্যাক্ষাণ করে এবং কালোর বদলে লাল রং ধারণ করেন। ৩১ জুলাই সম্পুর্ণ ফেসবুক ছেয়ে যায় লাল রঙের প্রোফাইল পিকচারে।
আগস্টের ২ তারিখ বিকেলে আনুমানিক ২ লক্ষ লোক জড়ো হন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বয়ে যায় এক গণজোয়ার। অনেকেই একে বলেন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণভুথ্যান। সেদিনই ৬ সমন্বায়ক ১ দফা দাবি তুলে ধরেণ শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং ৪ আগস্ট থেকে ডাক দেন অসহযোগ আন্দোলনের। শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানান, তিনি বলেন, গণভবনের দরজা খোলা আছে। তবে পরদিনই অর্থাৎ ৩ আগস্ট উত্তরা, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জসহ দেশের বেশ কিছু জায়গায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ হামলা চালায়। সেদিনও নিহত হয় বেশ কয়েকজন। ৩ তারিখ রাতেই ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্দেশণা দেন পর দিন থেকে প্রতি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। এদিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান এক জরুরি বৈঠকে বসেন অন্যান্য সেনা কর্মকর্তাদের সাথে। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেনাবাহিনী আর গুলি চালাবে না। তারা সাধারণ মানুষের পাশে থাকবে। আর এই সিদ্ধান্তের পরই পরিস্থিতি পালটে যায় ছাত্রদের পক্ষে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় ৩ আগস্ট রাতেই ডিবির হারুন বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার হওয়া প্রায় ১৫০০টি অবৈধ অস্ত্র তুলে দেয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাতে। ৪ আগস্ট রবিবার। সকাল থেকেই অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয় শিক্ষার্থীসহ নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ। আন্দোলনকারীরা জরো হতে থাকে শাহাবাগ, সাইন্সল্যাবসহো দেশের বিভিন্ন জায়গায়। বেলা ১১টার পর থেকেই তাণ্ডব শুরু করে অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এবং এই দিন পুলিশ নিষ্ক্রিয় ভুমিকা পালন করে। সম্পূর্ন কোটা আন্দোলনে এই ৪ আগস্ট ছিলো সবচেয়ে রক্তাক্ত। এ দিন পুলিশ, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীসহো শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। শুরুতে কিছুটা পিছুপা হলেও, অনেকটা পাবজি স্টাইলে পালটা আক্রমণ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়াও ঢাকাসহো দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ কর্মীদের আক্রমণ থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করে সেনাবাহিনীর সদস্যারা। ফলে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
৪ আগস্ট দুপুরে ঘোষণা আসে ৬ আগস্ট লং মার্চ টু ঢাকা অনুষ্ঠিত হবে। তবে সারাদিনে চলা তাণ্ডবের কথা বিবেচনা করে ৬ সমন্বায়ক ঘোষণা দেন পরদিনই অর্থাৎ ৫ আগস্ট হবে লং মার্চ টু ঢাকা। আরও ঘোষণা আসে, যদি সরকার আবার ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়, অথবা ৬ সমন্বায়ককে যদি হত্যা বা গুমও করে ফেলে তবুও যেন এই লং মার্চ অব্যাহত থাকে। তারা সারা দেশের সাধারন জনগনকে সেদিন রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান।
তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাতেই ঢাকার দিকে যাত্রা শুরু করে মানুষ। যে যেভাবে পেরেছে, কেউ ট্রাকে, কেউ সিএনজিতে তবে অধিকাংশই পায়ে হেঁটে আসতে থাকেন ঢাকার দিকে। এদিকে ৫ আগস্ট সকাল থেকেই থমথমে ছিলো রাজধানী ঢাকার পরিবেশ। সকাল সাড়ে ১০ টায় শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে জড়ো হওয়া শুরু করলে আবারও অ্যাকশনে নামে পুলিশ। ছোড়া হয় টিয়ার শেল, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড। তবে ১১টার পর থেকেই শাহাবাগে নামতে শুরু করে সাধারণ মানুষের ঢল। বঙ্গভবন ও গণভবনে বাড়িয়ে দেয়া হয় নিরাপত্তা।
এদিকে সকাল ১০টায় শেখ হাসিনা ৩ বাহিনীর প্রধান ও পুলিশের আইজিপিকে ডেকে আরও বেশি কঠোর হওয়ার নির্দেশণা দেন। বেশ কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, যে কোন মুল্যেই তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। সেনা প্রধান ওয়াকার উজ জামান শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের উপদেশ দেন এবং বলেন পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আইজিপিও বলেন পুলিশও বেশি সময় কঠোর অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা ও পুত্র জয়ও বলেন পদত্যাগ করতে। পরে তিনি পদত্যাগে রাজি হন, এবং জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ রেকর্ড করতে চান।
এদিকে ১১টার পর থেকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ি, শনিরয়াখরা, উত্তরা, সাভার দিয়ে কয়েক লক্ষ লোক ঢাকায় প্রবেশ করে। শাহাবাগে তৈরি হইয় এক জনসমুদ্র। এবং সেই জনসমুদ্র যাত্রা শুরু করে গণভবনের দিকে। পরিস্থিতি ও দূরত্ব বিবেচনা করে সেনা প্রধান শেখ হাসিনাকে ৪৫ মিনিটের সময় বেঁধে দেন। তার ভাষণ রেকর্ডের প্রকৃয়াও বাতিল করা হয়। দুইটি লাগেজ নিয়ে গণভবন থেকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে শেখ হাসিনা চলে আসেন তেজগাঁও পুরানো বিমান বন্দরে। সেখান থেকে তিনি বঙ্গভবনে এসে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে আবার চলে যান বিমানবন্দরে। বিমানবাহিনীর একটি পরিবহণ বিমানে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পালিয়ে যান দেশ থেকে।
দুপুর ২টায় সেনাপ্রধানের জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার কথা থাকে। কিন্তু সে ভাষনের সময় পিছিয়ে দেয়া হয়। তবে ২টার কিছু পর থেকেই খবর প্রকাশিত হয়ে যায় যে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। বাঁধ ভাঙা উল্লাসে ফেটে পরে শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ। ঢাকার প্রতিটি রাস্তায় নামে আনন্দ মিছিল। লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় সারাদেশের সব রাজপথ। জনগণ সব বাঁধা উপড়ে পৌঁছে যায় গণভবনে। যদিও ততক্ষণে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। উচ্ছাসে, আনন্দে গণভবন থেকে শেখ হাসিনার ব্যবহার করা জিনিসপত্র নিয়ে যেতে থাকে জনতা। যদিও সেদিন রাতের মধ্যেই প্রায় ৮০ ভাগ জিনিস ফিরিয়ে দেন সাধারণ মানুষ।
বেলা ৩.৩০ এ সেনাপ্রধান জেনারেল ওকার উজ জামান আনুষ্ঠানিকভাবে জানান যে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। এবং শীঘ্রই দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হবে এবং সেই সরকারের আধীনে হবে নির্বাচন। অবশেষে পতন হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় স্বৈরা শাসনের। অনেকেই হয়ত ভাবতে পারেন যে সামান্য এক কোটা সংস্কার আন্দোলন কিভাবে ১৫ বছর ধরে জেঁকে বসা এক শাসকের পতন ঘটায়? আসলে এই পতনের পিছনে শুধু কোটা সংস্কার ছিলো না। সাধারণ মানুষের দীর্ঘ ১৫ বছরে ক্ষোভ, বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলোর উপর চলা অত্যাচার, সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি, ছাত্রলীগ, যুবলীগের অত্যাচার ও চাঁদাবাজি, বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড ও গুম এবং সবশেষে শেখ হাসিনার অহংকার ও দাম্ভিকতার ফলে জনমনে যে ক্রোধের বারুদ জমা হয়, সেই বারুদেই আগুন দেয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। আর বিশ্বের ইতিহাস সাক্ষী, যে কোন দেশের যে কোন স্বৈরা শাসক যখনই ছাত্রদের বুকে গুলি চালায় তখনই তার পতনের দিন গণনা শুরু হয়। জেনারেশন জেড বা জেন-জি তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে এনে দিয়েছে নতুন স্বাধীনতা, এখন আমাদের সবার দায়িত্ব নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করা।