নির্বাচনের দাবি করায় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আসা কটাক্ষ ও সমালোচনার জবাব দিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘বিরাজনীতিকরণের’ চেষ্টার কথা তুলে ধরেছেন।
এখন নির্বাচনের দাবি জনগণ মেনে নেবে না বলে জামায়াতের পক্ষ থেকে আসা বক্তব্যের বিপরীতে তিনি বলেছেন, যারা ভোটে জিততে পারবে না, সরকার চালাতে পারবে না, তারা এসব কথা বলে।
বুধবার (২৮ আগস্ট) দুপুরে গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের করা মন্তব্যের জবাব দেন।
বিএনপির ‘নির্বাচন, নির্বাচন, নির্বাচন জিকির জনগণ মেনে নেবে না’ বলে জামায়াত প্রধানের বক্তব্যের জবাব দিয়ে ফখরুল বলেন, “যাদের জনসমর্থন নেই, জনগণ মনে করে না যে এরা সরকার চালাতে পারবে, তারা এ ধরনের বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করে, আমি কোনো দলের নাম বলছি না।
“সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে, আমাদের লড়াইটা গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। সেটার জন্যই তো নির্বাচন। এটা তো আমাদের অধিকার। আমরা তো নির্বাচনের জন্যই এতদিন লড়াই করেছি, সংগ্রাম করে এসেছি।”
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা এখনও এক-এগারোর কথা ভুলে যাইনি। তাই আবার যখন ওই চেহারাগুলো সামনে আসে, তখন যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হয়, প্রশ্ন এসে যায়। সেজন্য আমরা একটা আলোচনার কথা বলেছি, পারস্পরিক আলোচনা দরকার।”
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের মত ‘বিরাজনীতিকরণের’ লক্ষণ দেখছেন কি না- এই প্রশ্নেও জামায়াতের আমিরকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য রাখেন বিএনপি মহাসচিব।
তিনি বলেন, “আমি লক্ষণ দেখছি না, সতর্ক করছি। কিছু ফেইস দেখলে আমরা ভয় পাই। আপনারাও দেখেছেন। কোনো দিন দেখিনি… হঠাৎ করে মিডিয়ার ফ্রন্ট পেইজে চলে আসছে…তার বক্তব্য, তাদের থিওরি এগুলো আপনারা প্রচার করছেন।”
অন্তর্বর্তী সরকার কী চায়, জনগণ কী চায়, এটা নিয়ে আলোচনা হতে হবে মন্তব্য নির্বাচন প্রশ্নে আবার সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘অতি দ্রুত’ সংলাপের দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব।
“এটাই (সংলাপ) আমরা বলেছি, খুব জোর দিয়ে বলেছি। আজকে আবারও বললাম দ্রুত আলোচনা প্রয়োজন। না হলে হবে কী? অনেক ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হয়। সব কিছু তো পাবলিকলি হয় না। অনেক সময়ে আলোচনার মাধ্যমে অনেক কিছু বেরিয়ে আসে।”
১৯৯৯ সাল থেকে জোটবদ্ধ বিএনপি ও জামায়াতের জোট ২০২২ সালে ভেঙে যায় বলে সে বছরের অক্টোবরে একটি রুকন সম্মেলনে প্রকাশ করেন শফিকুর রহমান। পরে ৯ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল স্বীকার করেন, তারা ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়েছেন। তবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যোগাযোগ সব সময়ই ছিল, যুগপৎ কর্মসূচিও দিয়েছে দুই দল।
গত ৫ অগাস্ট ছাত্র জনতার তুমুল আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও বঙ্গভবনে গিয়ে বৈঠক করেছে, ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে গেছে, চারদিন পর ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে ১৫ অগাস্ট জাতীয় শোক দিবসের ছুটি বাতিলের পরামর্শ দিয়েছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার কবে নির্বাচন দেবে- এই প্রশ্নে এখন বিএনপি ও জামায়াত বিপরীতমুখী অবস্থানে। গত ২৪ অগাস্ট ফখরুল হঠাৎই বলেন, ‘কয়েকজন ব্যক্তির সংস্কারে’ তার বিশ্বাস নেই। তিনি নির্বাচন নিয়ে দ্রুত সংলাপের দাবি জানান।
পরদিন সিলেটে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, তারা নির্বাচন প্রশ্নে সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে প্রস্তুত হলেও অনির্দিষ্টকালের জন্য সময় দিতে চান না।
একই দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণে এসে ড. ইউনূস তার সরকারের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরলেও নির্বাচন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা তার সরকারের সিদ্ধান্ত নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পরদিন মির্জা ফখরুল এক আলোচনায় বলেন, এই বক্তব্যে সংস্কার নিয়ে তার ‘ধোঁয়াশা’ কাটেনি। তিনি আবার নির্বাচন নিয়ে সংলাপ দাবি করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজউদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার এক আলোচনায় দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করেন।
বিএনপি বারবার নির্বাচন প্রশ্নে সংলাপের দাবি করায় দুই যুগের জোটসঙ্গী জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান দলটিকে ধুয়ে দিয়েছেন। গত সোমবার দলটির এক আলোচনায় বিএনপির নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, “এখন জাতি বহুমুখী সংকটে, একদিকে শহীদ পরিবারগুলো আহাজারি করছে, আহতরা হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে, পা হারা, হাত হারা, চোখ হারা, কী কষ্টের মধ্যে তারা আছে। আবার ইতিমধ্যে বন্যার ভয়াবহতা শুরু হয়েছে।
“যারা জনগণের জন্য রাজনীতি করে… রাজনীতি তো জনগণের জন্য তাদের তো উচিত এই বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এই সময়টায় ওখানে না দাঁড়িয়ে যদি নির্বাচন, নির্বাচন, নির্বাচন জিকির করলে জাতি তা কবুল করবে?”
বিএনপির সঙ্গে আর জোটে না যাওয়ার কথা জানিয়ে দলটির বিরুদ্ধে দখলবাজির অভিযোগও আনেন জামায়াত নেতা।
তিনি বলেন, “নির্বাচন ওনাদের (বিএনপি) লাগেও তো না, যেখানে যা দখল করা, ফুটপাত থেকে ফকিরের বাণিজ্য পর্যন্ত সব ওনারা নিয়ে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ১৫ বছরে যা সাজিয়েছিল, তার ৮০ শতাংশ ওনাদের দখলে ইতিমধ্যে চলে গেছে। বাকি ২০ ভাগ বাকি আছে। আর কী করবে সরকারে গেলে? সরকার তো হয়েই গেছে।”
জামায়াত আমিরের এই বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ফখরুল বলেন, “বিভিন্ন জায়গায় কিছু কিছু দুর্বৃত্ত দখলবাজি করে তা বিএনপির ওপরে চাপানোর চেষ্টা করছে। আমরা স্পষ্টভাষায় বলে দিতে চাই যে, কোনো রকম দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে বিএনপি বা তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়িত নন… এটা আমরা জোর দিয়ে বলছি।
“আমার খুব অবাক লেগেছে নামকরা পত্রিকাগুলো, তারাও বিএনপিকে জড়িয়ে নিউজ করছেন। একজন দুই জন ব্যক্তিবর্গ যদি অপকর্ম করে সেটা তো বিএনপির দ্বারা হয় না। আমরা যখনই শুনছি তখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রায় ৫৬/৫৭ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।”
নির্বাচন প্রশ্নে তিনি বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে বাতিল করা হল, তার জন্য ওই দলগুলো মিলেই তো আমরা আন্দোলন করেছি। ওই দলগুলোর অনেকের আন্দোলনে অনেক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এমনকি তাদের অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
“এখন ওই আন্দোলনকে ওই বিষয়কে বাদ দিয়ে আমি তো অন্য রাজনৈতিক চিন্তা এই মুহূর্তে করব না।”
অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দিতে হবে মন্তব্য করে আবার সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গ টানেন ফখরুল। তিনি বলেন, ‘আমরা তো ভুলে যাইনি এক-এগারোর সময় কারা চেষ্টা করেছিল বিরাজনীতিকীকরণের। এমনকি ওই সময়ে আমাদের দলকে পর্যন্ত পুরোপুরি বাতিল, নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টাও হয়েছিল। এ কথাগুলো তো আমরা ভুলতে পারি না।
“আবার ওই চেহারাগুলোই যদি সামনে দেখি, তখন তো যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হয়, প্রশ্ন এসে যায়। সে কারণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘দোসর’ হিসেবে যারা কাজ করেছেন, যারা সহায়তা করেছেন, যারা ‘হত্যা করেছে’, আমরা তাদের চেহারা যেভাবে দেখতে চাই না। যারা গণতন্ত্রকে ব্যাহত করার জন্য, ধ্বংস করার জন্য কাজ করেছেন, তাদেরও এ দেশের মানুষ দেখতে চায় না।”