শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে পুলিশ বাহিনী। সরকারের সব অপকর্মের সঙ্গী হিসেবে জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ পুলিশের ওপর। এজন্য জনতার হামলায় অনেক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শত শত সদস্য। এই অবস্থায় পুলিশের সব সদস্যকে থানা থেকে লাইনগুলোতে সরিয়ে নেওয়া হয়। কার্যত ফাঁকা হয়ে পড়েছে দেশের থানাগুলো। পুলিশ পরিণত হয়েছে ছন্নছাড়া এক বাহিনীতে।
এই অবস্থায় নতুন আইজিপি বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) সন্ধ্যার মধ্যে সব পুলিশ সদস্যকে নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে এই আহ্বানে সাড়া মিলেছে সামান্যই। এখন পর্যন্ত অর্ধেকের বেশি পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে যোগদান করেনি। প্রায় ৪০ শতাংশ পুলিশ সদস্য মৌখিকভাবে ঊর্ধ্বতনকে জানিয়েছেন, তারা উপস্থিত আছেন এবং কোথাও পালিয়ে যাননি।
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে তারা কর্মে ফিরবেন না। সাবেক সরকারের তেলবাজি করতে গিয়ে যারা তাদের জীবন হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে তাদের যথাযথ বিচানও দাবি করেন পুলিশ সদস্যরা।
১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতিও পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা। সহকর্মীদের হত্যার বিচারসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন তারা। তাদের এসব দাবি মেনে নিয়ে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে গেজেট আকারে প্রকাশের আলটিমেটাম দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। অন্যথায় সারাদেশে কর্মবিরতি চলমান থাকবে বলেও হুমকি দিয়েছেন তারা।
ঊর্ধ্বতনদের দেখলেই মারতে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা!
রাজারবাগে অবস্থানরত কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কাজে যোগদান না করা পুলিশ সদস্যদের অনেকে এতটাই ক্ষুব্ধ যে, তারা ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কাউকে পেলে মারধর করতে উদ্ধত হচ্ছেন। বুধবার রাতে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের আট সদস্যের জানাজার সময় তারা সেই কথা সরাসরি আইজিপিকেও জানিয়েছেন।
এমন একটি ঘটনা ঘটেছে পার্বত্যজেলা বান্দরবানে। সেখানে এসআই পদমর্যাদার একজন পুলিশ সদস্য ওসিকে মারধরের চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পুলিশ লাইন্সে গেলে তার ওপরও চড়াও হন পুলিশ সদস্যরা। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি কোনো রকম পালিয়ে রক্ষা পান।
রাজারবাগে বুধবার রাতে আইজিপিকে কাছে পেয়ে পুলিশের এক নারী সার্জেন্ট জানিয়েছেন, তারা তাদের জরুরি পোস্টিং চান। তিনি আইজিপিকে জানান, তিনি গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরেছেন পুলিশের আইডি কার্ড ছাড়া। এ সময় তিনি আইজিকে প্রশ্ন করেন, ‘স্যার আমি কেন আইডি কার্ড ছাড়া কর্মস্থলে আসব বলেন! আমি আমার আইডি কার্ডটা পর্যন্ত আনতে পারিনি ভয়ে। ঢাকায় এবং কর্মস্থলে ফেরা পুলিশ সদস্যরা পথে পথে জনতার সাথে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অনেকে মারধরের শিকার হচ্ছেন।’
সারা দেশের পুলিশ সদস্যদের আহ্বান জানিয়ে কর্মবিরতি পালনের ডাক দিয়েছেন পুলিশ সদস্য সোয়াইবুর রহমান জয়। বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) তিনি এক ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, কোনোক্রমে পুলিশ সদস্যদের পুলিশ লাইন ত্যাগ করা যাবে না। পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত তিনি সারা দেশের পুলিশ সদস্যদের কর্মবিরতি পালন করে যাওয়ার আহ্বান জানান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ইতোমধ্যে ৬১টি জেলা বা ইউনিটে কর্মবিরতি চলছে।
দুর্নীতিবাজ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অধীনে আর কাজ করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। তাদের সবার অপকর্মের বিচার চান তারা।
জানা গেছেশ বাংলাদেশ পুলিশের যে সব সদস্য কর্মস্থলের বাইরে রয়েছেন তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছিল। তাদের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ রিপোর্ট করেছেন। বাকিরা এখনো আসতে পারেননি। অনেকে ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। আর কেউ কেউ কর্মে ফিরবেন না বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তবে ঢাকায় ফেরার পথে গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যরা নিগৃহীত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকালও পুলিশের ৬ জন মারা গেছেন। বুধবার চট্টগ্রামে রেজাউল ইসলাম নামে রেলওয়ে পুলিশের একজনকে বেধড়ক মারধর করে জনতা। পরিস্থিতিতে কর্মে ফেরা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন উদ্বিগ্ন সদস্যরা।
সারাদেশে ৬১টি ইউনিটের পুলিশ সদস্যদের কর্মে ফেরাতে বিভিন্ন জায়গায় সেনা সদস্যদের পাঠানো হচ্ছে। গতকাল সিলেটে ইউনিটের পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন সেনা সদস্যরা। এ সময় সেখানে একজন পুলিশ বাহিনীর প্রতি বৈষম্য, ঊর্ধ্বতনদের প্রতি ক্ষোভের কারণ এবং বিভিন্ন সুখ-দুখের কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি পুলিশ হত্যার বিচার দাবি করেন সেই পুলিশ সদস্য।
এদিকে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেওয়ার পর আজ শুক্রবার (৯ আগস্ট) তারা কার্যক্রম শুরু করেছে। আজই প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যান্য উপদেষ্টারা রাজাবাগ পুলিশ লাইন্সে যাচ্ছেন। দ্রুততম সময়ে পুলিশকে সক্রিয় করাই নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
পুলিশের যত ক্ষোভ ও দাবি
পুলিশ সদস্যরা চাইছেন, এখন তাদের জন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করা হোক। যার মাধ্যমে তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রয়োজন হবে না। রাজনৈতিক পরিচয় নিয়োগকৃত পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের তেল দিয়ে চলতে হবে না। তখন আর অবৈধ আদেশ বাস্তবায়ন করা লাগবে না।
কর্মবিরতি পালনকারী পুলিশ সদস্যরা বলছেন, তাদের জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন, পুলিশ বাহিনীকে সংস্কার করে দলীয় প্রভাবমুক্ত ও জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত করতে হবে। তারা যে রংয়ের ইউনিফর্ম পরিধান করে কলংকিত হলেন সেই পোশাকের রং পরিবর্তন করে কনস্টেবল থেকে আইজি পর্যন্ত একই ড্রেসকোড করতে হবে।
তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে, সকল পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতালোভী দালাল পুলিশ অফিসার যাদের কারনে শত শত পুলিশ সদস্য ও সাধারণ ছাত্র জনতা মারা গেছেন তাদের গ্রেফতার করে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিচার করতে হবে। তাদের অবৈধ সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে পুলিশের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে।
চলমান সহিংসতায় যেসব পুলিশ সদস্য আহত ও নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব সদস্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জানমালের নিরাপত্তার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বিভাগীয় ব্যবস্থা অথবা হয়রানি করা যাবে না।
পুলিশ সদস্যদের অন্যান্য সংস্থার চাকরির মতো শ্রম আইন অনুযায়ী আট ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আট ঘণ্টার বেশি দায়িত্ব পালন করতে হলে ওভার টাইম হিসেবে গণ্য করতে হবে।
ইন্সপেক্টর থেকে ৬০ এবং ৪০ শতাংশ এএসপি পদে সরাসরি নিয়োগ দিতে হবে। পদোন্নতির জটিলতা নিরসনের জন্য সব পদে পদোন্নতির জন্য সুপার নিউমারারি চালু করতে হবে এবং ন্যূনতম পুলিশ সুপার পর্যন্ত পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। অধস্থন পুলিশ সদস্যদের টিএ/ডিএ বিল যথাসময়ে প্রদান করতে হবে এবং সোর্সমানি প্রদান করতে হবে। ঝুঁকি ভাতা বেসিকের ৭০ শতাংশ দিতে হবে এবং ফ্রেশমানি পুলিশ সদস্যের ব্যাংক হিসাবে দিতে হবে।
সব পুলিশ সদস্য ও পরিবারের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত চিকিৎসা করা হলে তার ভাউচার অনুসারে কল্যাণ তহবিল থেকে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
বিভাগীয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে একবার পরীক্ষায় পাস করার পরে পর্যায়ক্রমে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা এবং অধস্থনদের পদোন্নতির বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনে সুপার নিউমারারি পদ সৃজন করতে হবে।
ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিগত ১৫ বছরে যারা সুবিধাবঞ্চিত হয়েছেন তাদের দায়িত্ব দিতে হবে। ওসি হিসেবে দুই বারের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না এবং ৫৪ বছরের বয়সের সীমাবদ্ধতা তুলে দিতে হবে।
অধস্থন পুলিশ সদস্যদের সাথে পিআরবি অনুসারে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতে হবে। ব্যক্তিগত কাজে কোনো সদস্যকে ব্যবহার করা যাবে না। কনস্টেবল থেকে সব পর্যায়ের অফিসারের পোস্টিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।
সার্জেন্ট ও সাব-ইন্সপেক্টরদের পিএসসির অধীনে একই নিয়োগের মাধ্যমে সব ইউনিটে পদায়ন করতে হবে। বর্তমানে কর্মরত সার্জেন্টদের তদন্ত ক্ষমতা দিতে হবে এবং এটিএসআইকে এএসআই (নিরস্ত্র) হিসেবে সমন্বয় করতে হবে। জনগণের স্বার্থে এবং সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ট্রাফিক বিভাগের অবৈধ রেকার বাণিজ্য বন্ধ এবং মামলার টার্গেট প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে।
কমিউনিটি ব্যাংক এবং সব কল্যাণ তহবিলের সুস্পষ্ট হিসাব প্রতি বছর সবাইকে প্রদান করতে হবে। লোনের ক্ষেত্রে সুদের হার ৬ শতাংশ এর নিচে নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে সমন্বয় করতে হবে।
নবম গ্রেড থেকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে ৬ষ্ঠ গ্রেড নিশ্চিত করতে হবে এবং একই পদে সর্বোচ্চ ছয় বছরের মধ্যে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। ইন্সপেক্টর থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চাকরি হারালে সবাই পেনশনসহ সবধরনের সুযোগ সুবিধা পান। এবার কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যন্ত এই সুবিধা দিতে হবে। সারা দেশে যেসব সদস্যকে বরখাস্ত করে রাখা হয়েছে তাদের মানবিক কারণে বিবেচনা করতে হবে।
প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে প্রতি বছর ২০ দিন নৈমিত্তিক ছুটির পাশাপাশি দুই মাস অর্জিত ছুটি বাধ্যতামূলক ভোগ করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে নিজ রেঞ্জে পর্যায়ক্রমে পদায়নের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অধস্থন পুলিশ সদস্যদের ১০০ শতাংশ আবাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশ সদস্যদের সব ইউনিটে চাকরি করার সুযোগ রাখতে হবে। স্বায়ত্বশাসিত এবং টেকনিক্যাল বলে কোনো ইউনিট থাকবে না এবং সবাইকে সব ইউনিটে বদলির সুযোগ থাকতে হবে। পুলিশ সুপারের নিচে বডিগার্ড, অর্ডালি নিয়ম বন্ধ করতে হবে।