চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে অস্থির হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের বাজার। যদিও এই দুটি দেশ জ্বালানি রপ্তানি করে না। তবে দু’দেশের সংঘাতের প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেল রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সংঘাতে দেশের জ্বালানি সরবরাহ চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, রয়েছে দাম বৃদ্ধির আশঙ্কাও। যা পরোক্ষভাবে ডলার সংকট ও মূল্যস্ফীতি আরও উষ্কে দেবে।
এর আগে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে গত বছর শুরুর দিকে ভর্তুকি সত্ত্বেও কয়েক হাজার কোটি টাকা লোকসানের হিসাব দিয়েছিল দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল আমদানিকারক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। ফলে গত আগস্টে দেশের বাজারে ৪০ শতাংশের বেশি দাম বৃদ্ধি করা হয়। তবে এ বছরের প্রথম ৮ মাস ব্যাপক মুনাফা পেয়েছে এ সংস্থাটি। কিন্তু গত দু’মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে ফের জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে দেশে লোকসানের তেল বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিপিসির কর্মকর্তারা। অন্যদিকে গত দু-মাসে ডলার সংকটে বিপিসির তেল আমদানি বাবদ বকেয়া ৬শ’ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দ্রুত এসব বিল পরিশোধ করা না হলে সরবরাহ সংকট দেখা দিতে পারে। যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। যদিও পাওনা পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ঋণ সহায়তা চেয়েছে বিপিসি।
এ পরিস্থিতিতে ইসরাইল ফিলিস্তিনি সংঘাত আমদানি ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে লোকসানের পরিমাণ কয়েকগুণ বাড়ার আশঙ্কা করছেন দেশের জ্বালানি বিশ্লেষকরা। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম গত কয়েক দিন ধরে গড়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ হারে বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, এই সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষ তেল রপ্তানিকার দেশগুলো প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল প্রাইস ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইউএস টেক্সাস ইটারমিডিয়েট ক্রুড বা ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ব্যারেল প্রতি ৮৭ ডলার ৬৯ সেন্টে ওঠানামা করছে। আর ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ওঠানামা করছে ৯০ ডলার ৮৯ সেন্টে। যা আগামী ডিসেম্বরে ব্যারেল প্রতি ৯৮ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলেও প্রক্ষেপণ করছে বৈশ্বিক তথ্য-উপাত্ত সরবরাহকারী ওয়েবসাইট ট্রেডিং ইকোনমিক্স।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে হারে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ছে তাতে নির্বাচনের আগেই দেশের বাজারে ফের তেলের দাম বৃদ্ধি সম্ভাবনা তৈরি হবে। তা করা হলে সার্বিক উৎপাদন ব্যয় আরও বেড়ে যাবে, বাড়বে মূল্যস্ফীতি। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাবে। এদিকে দেশে বাজারে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের ৭০ শতাংশ পরিশোধিত বাকিটা অপরিশোধিত। যার মধ্যে ৭০ ভাগই ডিজেল। জ্বালানি বিভাগের তথ্যানুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩২ লাখ ৬৫ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল কেনার পরিকল্পনা রয়েছে বিপিসির। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ টন। অর্থাৎ আগামী দু-মাসে আরও প্রায় ১২ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির করা হতে পারে। এর বাইরে একই সময়ে ৬ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিরও কথা রয়েছে।
এদিকে রুশ ইউক্রেন যুদ্ধে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে দেশের সব তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে দেশব্যাপী লোডশেডিং ও শিল্প উৎপাদন তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ যায়যায়দিনকে বলেন, ফের যদি তেল আমদানি হ্রাস বা দাম বৃদ্ধি করা হয় তাহলে বিদ্যুৎ উপাদন ও খুচরা পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি শঙ্কা রয়েছে। কারণ এলএনজি কিংবা কয়লা দিয়ে দেশের চাহিদার শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। যা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের এই সাবেক কর্মকর্তার মতে, আসন্ন সংকট সমাধানে সরকারের প্রস্তুতি বা প্লান বি থাকা প্রয়োজন। যা অন্যান্য দেশের রয়েছে। এ ছাড়াও তেলের বাজারের প্রভাব পড়তে পারে এলএনজির বাজারেও। আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণের তথ্যানুযায়ী, এরই মধ্যে এলএনজির দাম বাড়তে শুরু করেছে। স্পট মার্কেটে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) ১৪ ডলার ৪৭ সন্টে ওঠানামা করছে। যা আগামী ডিসেম্বর নাগাদ প্রতি এমএমবিটিইউ ২০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। এর ফলে স্পট থেকে আমদানি ব্যয় আরও বেড়ে যাওয়ার অশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেখা গেছে, দেশে স্থানীয় গ্যাসের বাইরে প্রতি বছর স্পট থেকে প্রায় ২ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানি করে পেট্রোবাংলা। যার বড় একটি অংশই ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
এদিকে দেশের রিজার্ভ এখন ১৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ক্রমাগত আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিতে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। কারণ ব্যাংকগুলো ঋণপত্রের (এলসি) দায় মেটানোর জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের সাড়ে তিন মাসেই রিজার্ভ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করতে হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে তুলনায় দ্বিগুণ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানি ব্যয় মেটানোসহ সরকারের ঋণ পরিশোধে প্রতি মাসে গড়ে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ ক্ষয় হচ্ছে। এ অবস্থায় আমদানি নির্ভর জ্বালানি খাতে সংকট আরও গভীর হতে পারে।