ঢাকা ০১:৪২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

টাকার অভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ বন্ধ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার দূরত্ব অংশ উদ্বোধন করেছেন। কথা ছিল বাকি ৯ কিলোমিটারের নির্মাণকাজ ২০২৪ সালের ৩০ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন হবে। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন ‘২০২৪ সালের মধ্যেই ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শেষ হবে’। কিন্তু হঠাৎ থমকে গেছে নির্মাণ কাজ। অনেক কর্মীকে বিনা বেতনে ছুটি দেয়া হয়েছে। বিদেশী তিন কোম্পানীর বিরোধে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ। এমনকি বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীলরা নিজেদের দায় এড়িয়ে বলছেন, কন্টাক্ট পাওয়া বিদেশী কোম্পানীগুলো নিজেদের মধ্যে বিরোধের কারণে আদালতে মামলা করায় কাজের গতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু কাজ বন্ধ হয়নি। সরকারের দায়িত্বশীলরা নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে কাজ বন্ধ হয়নি দাবি করলেও সরেজমিন দেখা যায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারওয়ান থেকে কুতুবখালী নির্মাণকাজ বন্ধ। হাতিরঝিল এলাকায় কিছু শ্রমিক দেখা গেলেও অন্য সব এলাকা শ্রমিকশূন্য। কারওয়ান বাজার, মগবাজার ও মালিবাগ হয়ে প্রায় কমলাপুর, টিটিপাড়া যাওয়া একেকটা পিলার, গার্ডার, টিগার্ডার পড়ে আছে। কোথাও কোনো কর্মযজ্ঞ নেই। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি, এখন হাতিরঝিল আর পান্থপথ অংশেই কেবল কিছু কাজ চলমান।

জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে শুরু হয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে তেজগাঁও, মগবাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও, কমলাপুর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে ওই এক্সপ্রেসওয়ে। নকশায় এক্সপ্রেসওয়েতে উঠা-নামার জন্য মোট ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র‌্যাম্প রয়েছে। এই র‌্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৭ কিলোমিটার। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার অংশ উদ্বোধন করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বর থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। চলতি বছরের ২০ মার্চ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) গেটসংলগ্ন একটি র‌্যাম্প খুলে দেয়া হয়। এরপর কাজ এগিয়ে চলতে থাকলেও হঠাৎ করে কাজের গতি কমে যায়। এখন মগবাজারের হাতিরঝিল এলাকায় স্বল্প পরিসরে অল্পসংখ্যক কর্মী দিয়ে কাজ চলছে, তবে অন্যসব স্থানের কাজ বন্ধ রয়েছে। মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত সব পিলার উঠে গেলেও পিলারের ওপর স্প্যান বসানোর কাজ চলছে না। কমলাপুরের দিকে পিলার তৈরির কাজও বন্ধ রয়েছে।

প্রকল্পের হাতিরঝিল ওয়ার্ক ইয়ার্ডের কর্মীরা জানান, গত দুই মাস ধরে কম কাজ হচ্ছে। কাজ কম থাকায় অনেক কর্মীকে ছুটি দেয়া হয়েছে। এক মাস আগে রাতের বেলাতেও কাজ চলত, এখন হয় না। অন্য ইয়ার্ড থেকে কিছু কর্মীকে হাতিরঝিল এলাকায় আনা হয়েছে। প্রকল্পের তেজগাঁও ইয়ার্ডে কাজ বন্ধ রয়েছে। কমলাপুর, টিটিপাড়াতেও একই অবস্থা। রড বানানো, গার্ডার ঢালাই, বৈদ্যুতিক কাজসহ সব ধরনের কাজই কম হচ্ছে। কমলাপুর ও টিটিপাড়া এলাকায় শুধু নিরাপত্তা কর্মীরাই রয়েছেন। ঢালাই তৈরির জন্য প্ল্যান্ট একেবারেই নিশ্চুপ।

কথা ছিল অগ্রাধিকারমূলক এ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ মার্চ মাসে সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেয়া হয়। ফলে কাজ চলার কথা দ্রুত গতিতে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ কার্যত বন্ধ হয়ে রয়েছে। মূলত তিন বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্বে বন্ধ হয়ে গেছে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের নির্মাণকাজ। বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। রায় না পাওয়া পর্যন্ত বাকি কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।

২০১১ সালে থাইল্যান্ডের কোম্পানি ইতাল থাই রাজধানী ঢাকায় ২০ কিলোমিটার দূরত্বের এলিভেটেড এসপ্রেসওয়ের কাজ পায়। অর্থ জোগাড় করতে না পরায় কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয় ৮ বছর। অতপর ২০১৯ সালে চাইনিজ দুই কোম্পানি শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ও সিনোহাইড্রোকে যুক্ত করে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের নির্বাহী প্রতিষ্ঠান হলেও এ কাজে তিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ইতালথাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি- ৫১, চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ৩৪, ও সিনো হাইড্রো করপোরেশন-১৫ শতাংশ। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণ ব্যয়ের ৭৩ শতাংশের যোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু ঠিকাদারি তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চলা দ্বন্দ্ব আদালতে গেছে। এতে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঋণ সহায়তা বন্ধ করে দেয় দুটি ব্যাংক এক্সিম ও আইসিবিসি ব্যাংক। এতে করে শঙ্কা শুরু হয়েছে পুরো প্রকল্প নিয়ে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, নির্মাণ কাজে যেসব কোম্পানি অংশীদার তাদের মধ্যে কিছু আইনগত বিষয় নিয়ে মামলা রয়েছে। সেই মামলা দুটি যায়গায় চলমান রয়েছে। থাইল্যান্ডের একটি কোম্পানি এবং একটি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশের আদালতেও মামলা করেছে। এ মামলার কারণে কাজের গতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু কাজ এখনও চলছে।

এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কর্মকর্তারা এবং এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও পরিচালনা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কয়েক মাসে প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মীকে বিনা বেতনে ছুটি দেয়া হয়েছে। মূলত টাকার অভাবে প্রকল্পের কাজের গতি কমে গেছে। টাকার সংস্থান না হওয়া পর্যন্ত কাজ এভাবে চালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। সরকারের সংশ্লিষ্টদের এই প্রকল্পের বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। কাজের গতি হারিয়ে ফেলায় প্রকল্পের মেয়াদ আবারো বাড়াতে হবে। তবে প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার জানিয়েছেন, প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়নি, চলমান রয়েছে। তবে আর্থিক কারণে কিছুটা ধীর গতিতে চলছে। ঋণের টাকা ছাড় হওয়া না-হওয়ার বিষয়টি আমাদের দেখার দায়িত্ব না। এটা বিনিয়োগকারীরা দেখবেন। আমরা মালামাল পেলে কাজ চালিয়ে নেব। আর্থিক বিষয়গুলো বিনিয়োগকারীরা দেখবেন, মন্ত্রণালয় দেখবে। তবে ঋণের টাকার ছাড় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পের কাজ শেষ হতে আরো সময় লাগবে। অর্থ পেতে চেষ্টা চলছে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘চুক্তি অনুসারে বিকল্প অর্থায়নের ব্যবস্থা আছে। প্রকল্পে দলবদ্ধভাবে কাজ হচ্ছে। ফলে ঋণ ছাড় না হওয়া বা অন্য কোনো কারণে এক প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন করতে ব্যর্থ হলে অন্যরা অর্থের ব্যবস্থা করবে। ফলে কাজ থেমে যাবে না। পুরো প্রকল্প আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে।’ বাস্তবতা হচ্ছে নির্মাণ কাজের শ্রমিকদের যে কর্মচঞ্চল্য ছিল এখন তা নেই, কাজ কার্যত থেমে গেছে।

বিনিয়োগকারী চীনা দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দাবি, ব্যাংকঋণের সুদ পরিশোধে (পে ব্যাক) ইতালথাইয়ের ব্যর্থতার কারণেও ব্যাংকঋণ আটকে দেয়ায় কাজ ধীর গতিতে চলছে। ইতালথাই নিজেদের অংশের অর্থ জোগাড় করতে পারেনি। ব্যাংক বলে দিয়েছে (এফডিইইকে) ৬ মাসের মধ্যে সুদের টাকা পরিশোধ করতে হবে। নয়তো ইতালথাইকে তাদের শেয়ারের ৯৯ শতাংশ বিক্রি করে দিতে হবে। ব্যাংকের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন কোর্টে অভিযোগ করেছে ইতালথাই। অন্যদিকে ইতালথাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি (এফডিইই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাই নাগরিক ভাস্কন খান্নাভা ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রকল্পের জন্য এখন বিকল্প পরিকল্পনা হিসেবে কম সময়ের জন্য ছোট ঋণ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সেটা এ দেশের কোনো ব্যাংক বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্মাণকাজে সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত দেরি হতে পারে। কোনো অবস্থাতেই প্রকল্পের কাজ বন্ধ হবে না। ইতালথাই শেয়ার ছাড়বে না। এই প্রকল্প থেকেও সরবে না। অন্য দুটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান শ্যাংডন ও সিনোহাইড্রো অন্যায় ও অনৈতিকভাবে শেয়ার নেওয়ার চেষ্টা করছে।’

২০০৯ সালে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১১ সালে নির্মাণের চুক্তি হয়। নির্মাণকাল ধরা ছিল সাড়ে তিন বছর। তবে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। উড়ালসড়কটির আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮,৯৪০ কোটি টাকা। সে হিসেবে এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৯১ কোটি টাকারও বেশি।

জানা গেছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের ঋণছাড় বন্ধ হয়ে গেছে। এ বছরের ৩০ মার্চের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হবে না জেনে গত ১৭ জানুয়ারি ঋণ আটকে দিয়েছে চীনের দুটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় নির্মাণকাজ নিয়ে অংশীদারি বিদেশি তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।

চুক্তির শর্তমতে কোনো প্রতিষ্ঠান অর্থ যোগানে ব্যর্থ হলে বাকি প্রতিষ্ঠান তার শেয়ার নিয়ে নিতে পারবে। তাই সেই দিকেই আগ্রহ চীনা প্রতিষ্ঠানের। অন্যদিকে অর্থ যোগান না দিয়েই নিজেদের শেয়ার ধরে রাখতে চায় ইতাল থাই। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই চীনা অংশীদারি প্রতিষ্ঠান সমস্যা সমাধানের চাইতে ইতাল থাইয়ের শেয়ার নিতে আগ্রহী বেশি। আর থাইল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান কোনো ভাবেই শেয়ার ছাড়বে না। ফলে বিদেশী তিন কোম্পানীর বিরোধে আটকে গেছে ঢাকা এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের কাজ।

জনপ্রিয় সংবাদ

টাকার অভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ বন্ধ

আপডেট সময় ১২:২৪:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার দূরত্ব অংশ উদ্বোধন করেছেন। কথা ছিল বাকি ৯ কিলোমিটারের নির্মাণকাজ ২০২৪ সালের ৩০ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন হবে। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন ‘২০২৪ সালের মধ্যেই ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শেষ হবে’। কিন্তু হঠাৎ থমকে গেছে নির্মাণ কাজ। অনেক কর্মীকে বিনা বেতনে ছুটি দেয়া হয়েছে। বিদেশী তিন কোম্পানীর বিরোধে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ। এমনকি বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীলরা নিজেদের দায় এড়িয়ে বলছেন, কন্টাক্ট পাওয়া বিদেশী কোম্পানীগুলো নিজেদের মধ্যে বিরোধের কারণে আদালতে মামলা করায় কাজের গতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু কাজ বন্ধ হয়নি। সরকারের দায়িত্বশীলরা নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে কাজ বন্ধ হয়নি দাবি করলেও সরেজমিন দেখা যায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারওয়ান থেকে কুতুবখালী নির্মাণকাজ বন্ধ। হাতিরঝিল এলাকায় কিছু শ্রমিক দেখা গেলেও অন্য সব এলাকা শ্রমিকশূন্য। কারওয়ান বাজার, মগবাজার ও মালিবাগ হয়ে প্রায় কমলাপুর, টিটিপাড়া যাওয়া একেকটা পিলার, গার্ডার, টিগার্ডার পড়ে আছে। কোথাও কোনো কর্মযজ্ঞ নেই। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি, এখন হাতিরঝিল আর পান্থপথ অংশেই কেবল কিছু কাজ চলমান।

জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে শুরু হয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে তেজগাঁও, মগবাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও, কমলাপুর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে ওই এক্সপ্রেসওয়ে। নকশায় এক্সপ্রেসওয়েতে উঠা-নামার জন্য মোট ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র‌্যাম্প রয়েছে। এই র‌্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৭ কিলোমিটার। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার অংশ উদ্বোধন করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বর থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। চলতি বছরের ২০ মার্চ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) গেটসংলগ্ন একটি র‌্যাম্প খুলে দেয়া হয়। এরপর কাজ এগিয়ে চলতে থাকলেও হঠাৎ করে কাজের গতি কমে যায়। এখন মগবাজারের হাতিরঝিল এলাকায় স্বল্প পরিসরে অল্পসংখ্যক কর্মী দিয়ে কাজ চলছে, তবে অন্যসব স্থানের কাজ বন্ধ রয়েছে। মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত সব পিলার উঠে গেলেও পিলারের ওপর স্প্যান বসানোর কাজ চলছে না। কমলাপুরের দিকে পিলার তৈরির কাজও বন্ধ রয়েছে।

প্রকল্পের হাতিরঝিল ওয়ার্ক ইয়ার্ডের কর্মীরা জানান, গত দুই মাস ধরে কম কাজ হচ্ছে। কাজ কম থাকায় অনেক কর্মীকে ছুটি দেয়া হয়েছে। এক মাস আগে রাতের বেলাতেও কাজ চলত, এখন হয় না। অন্য ইয়ার্ড থেকে কিছু কর্মীকে হাতিরঝিল এলাকায় আনা হয়েছে। প্রকল্পের তেজগাঁও ইয়ার্ডে কাজ বন্ধ রয়েছে। কমলাপুর, টিটিপাড়াতেও একই অবস্থা। রড বানানো, গার্ডার ঢালাই, বৈদ্যুতিক কাজসহ সব ধরনের কাজই কম হচ্ছে। কমলাপুর ও টিটিপাড়া এলাকায় শুধু নিরাপত্তা কর্মীরাই রয়েছেন। ঢালাই তৈরির জন্য প্ল্যান্ট একেবারেই নিশ্চুপ।

কথা ছিল অগ্রাধিকারমূলক এ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ মার্চ মাসে সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেয়া হয়। ফলে কাজ চলার কথা দ্রুত গতিতে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ কার্যত বন্ধ হয়ে রয়েছে। মূলত তিন বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্বে বন্ধ হয়ে গেছে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের নির্মাণকাজ। বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। রায় না পাওয়া পর্যন্ত বাকি কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।

২০১১ সালে থাইল্যান্ডের কোম্পানি ইতাল থাই রাজধানী ঢাকায় ২০ কিলোমিটার দূরত্বের এলিভেটেড এসপ্রেসওয়ের কাজ পায়। অর্থ জোগাড় করতে না পরায় কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয় ৮ বছর। অতপর ২০১৯ সালে চাইনিজ দুই কোম্পানি শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ও সিনোহাইড্রোকে যুক্ত করে শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের নির্বাহী প্রতিষ্ঠান হলেও এ কাজে তিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ইতালথাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি- ৫১, চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ৩৪, ও সিনো হাইড্রো করপোরেশন-১৫ শতাংশ। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী নির্মাণ ব্যয়ের ৭৩ শতাংশের যোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু ঠিকাদারি তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চলা দ্বন্দ্ব আদালতে গেছে। এতে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঋণ সহায়তা বন্ধ করে দেয় দুটি ব্যাংক এক্সিম ও আইসিবিসি ব্যাংক। এতে করে শঙ্কা শুরু হয়েছে পুরো প্রকল্প নিয়ে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, নির্মাণ কাজে যেসব কোম্পানি অংশীদার তাদের মধ্যে কিছু আইনগত বিষয় নিয়ে মামলা রয়েছে। সেই মামলা দুটি যায়গায় চলমান রয়েছে। থাইল্যান্ডের একটি কোম্পানি এবং একটি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশের আদালতেও মামলা করেছে। এ মামলার কারণে কাজের গতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু কাজ এখনও চলছে।

এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কর্মকর্তারা এবং এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও পরিচালনা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কয়েক মাসে প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মীকে বিনা বেতনে ছুটি দেয়া হয়েছে। মূলত টাকার অভাবে প্রকল্পের কাজের গতি কমে গেছে। টাকার সংস্থান না হওয়া পর্যন্ত কাজ এভাবে চালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। সরকারের সংশ্লিষ্টদের এই প্রকল্পের বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। কাজের গতি হারিয়ে ফেলায় প্রকল্পের মেয়াদ আবারো বাড়াতে হবে। তবে প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার জানিয়েছেন, প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়নি, চলমান রয়েছে। তবে আর্থিক কারণে কিছুটা ধীর গতিতে চলছে। ঋণের টাকা ছাড় হওয়া না-হওয়ার বিষয়টি আমাদের দেখার দায়িত্ব না। এটা বিনিয়োগকারীরা দেখবেন। আমরা মালামাল পেলে কাজ চালিয়ে নেব। আর্থিক বিষয়গুলো বিনিয়োগকারীরা দেখবেন, মন্ত্রণালয় দেখবে। তবে ঋণের টাকার ছাড় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পের কাজ শেষ হতে আরো সময় লাগবে। অর্থ পেতে চেষ্টা চলছে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘চুক্তি অনুসারে বিকল্প অর্থায়নের ব্যবস্থা আছে। প্রকল্পে দলবদ্ধভাবে কাজ হচ্ছে। ফলে ঋণ ছাড় না হওয়া বা অন্য কোনো কারণে এক প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন করতে ব্যর্থ হলে অন্যরা অর্থের ব্যবস্থা করবে। ফলে কাজ থেমে যাবে না। পুরো প্রকল্প আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে।’ বাস্তবতা হচ্ছে নির্মাণ কাজের শ্রমিকদের যে কর্মচঞ্চল্য ছিল এখন তা নেই, কাজ কার্যত থেমে গেছে।

বিনিয়োগকারী চীনা দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দাবি, ব্যাংকঋণের সুদ পরিশোধে (পে ব্যাক) ইতালথাইয়ের ব্যর্থতার কারণেও ব্যাংকঋণ আটকে দেয়ায় কাজ ধীর গতিতে চলছে। ইতালথাই নিজেদের অংশের অর্থ জোগাড় করতে পারেনি। ব্যাংক বলে দিয়েছে (এফডিইইকে) ৬ মাসের মধ্যে সুদের টাকা পরিশোধ করতে হবে। নয়তো ইতালথাইকে তাদের শেয়ারের ৯৯ শতাংশ বিক্রি করে দিতে হবে। ব্যাংকের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন কোর্টে অভিযোগ করেছে ইতালথাই। অন্যদিকে ইতালথাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি (এফডিইই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাই নাগরিক ভাস্কন খান্নাভা ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রকল্পের জন্য এখন বিকল্প পরিকল্পনা হিসেবে কম সময়ের জন্য ছোট ঋণ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সেটা এ দেশের কোনো ব্যাংক বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্মাণকাজে সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত দেরি হতে পারে। কোনো অবস্থাতেই প্রকল্পের কাজ বন্ধ হবে না। ইতালথাই শেয়ার ছাড়বে না। এই প্রকল্প থেকেও সরবে না। অন্য দুটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান শ্যাংডন ও সিনোহাইড্রো অন্যায় ও অনৈতিকভাবে শেয়ার নেওয়ার চেষ্টা করছে।’

২০০৯ সালে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১১ সালে নির্মাণের চুক্তি হয়। নির্মাণকাল ধরা ছিল সাড়ে তিন বছর। তবে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। উড়ালসড়কটির আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮,৯৪০ কোটি টাকা। সে হিসেবে এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৯১ কোটি টাকারও বেশি।

জানা গেছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের ঋণছাড় বন্ধ হয়ে গেছে। এ বছরের ৩০ মার্চের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হবে না জেনে গত ১৭ জানুয়ারি ঋণ আটকে দিয়েছে চীনের দুটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় নির্মাণকাজ নিয়ে অংশীদারি বিদেশি তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।

চুক্তির শর্তমতে কোনো প্রতিষ্ঠান অর্থ যোগানে ব্যর্থ হলে বাকি প্রতিষ্ঠান তার শেয়ার নিয়ে নিতে পারবে। তাই সেই দিকেই আগ্রহ চীনা প্রতিষ্ঠানের। অন্যদিকে অর্থ যোগান না দিয়েই নিজেদের শেয়ার ধরে রাখতে চায় ইতাল থাই। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই চীনা অংশীদারি প্রতিষ্ঠান সমস্যা সমাধানের চাইতে ইতাল থাইয়ের শেয়ার নিতে আগ্রহী বেশি। আর থাইল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান কোনো ভাবেই শেয়ার ছাড়বে না। ফলে বিদেশী তিন কোম্পানীর বিরোধে আটকে গেছে ঢাকা এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের কাজ।