দীর্ঘদিনের দুরবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি)। বিশেষ করে পূর্বাভাসে অসঙ্গতি গরমিল যেন ‘নিয়মে’ পরিণত হয়েছে। তিলকে তাল তালকে তিল বানানো হয় পূর্বাভাসে। এ নিয়ে জনসাধারণের মাঝে হাসাহাসি তো আছেই। আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে মানুষের আস্থা তলানিতে। টানা প্রায় এক মাস ধরে উচ্চ তাপদাহ আর খরা-অনাবৃষ্টিতে পুড়ছে দেশ। ফেটে চৌচির ফসলের মাঠ-ঘাট, ফল-ফলাদির বাগান, ক্ষেত-খামার। শুকিয়ে গেছে নদ-নদী-খাল-বিল। প্রচণ্ড গরমে হাঁপাচ্ছে, লাখো মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছে, হিটশকে পুড়ছে ফল-ফসল। ত্রাহিদশা মানুষ, প্রাণিকুল, উদ্ভিদ, প্রাণ-প্রকৃতির।
১৮ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশের জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে আবহাওয়া-জলবায়ুর। সামনে আসছে বজ্রপাত, কালবৈশাখী ঝড়, সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের মৌসুম। অথচ সময়োচিত ও সঠিক পূর্বাভাস প্রদানে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে আবহাওয়া বিভাগ। আবহাওয়া কেমন যাবে, কবে খরা, কবে বৃষ্টিপাত, ভারতের উজানে বৃষ্টি ও ঢল-বানের কখন কী পরিস্থিতি এসব বিষয়ে নিয়মিত যথানিয়মে পূর্বাভাস আবহাওয়া বিভাগ দেবে কীভাবে? আকাশপানে তাকিয়ে আকাশের হাল-অবস্থা দেখে? আবহাওয়ার এসব পূর্বাভাস যে রাডারের সাহায্যে দেয়া হয় আবহাওয়া বিভাগের ৫টি রাডারের সবক’টি রাডার নষ্ট বা অকেজো।
আবহাওয়া বিভাগ (বিএমডি) আধুনিক যুগোপযোগী প্রযুক্তি, যান্ত্রিক সরঞ্জাম, পর্যাপ্ত দক্ষ-অভিজ্ঞ জনবল, দক্ষতা-অভিজ্ঞতা অর্থাৎ যুগের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ। এসব ক্ষেত্রে বিএমডি যোজন যোজন দূরে। জনস্বার্থ ও জনগুরুত্বসম্পন্ন আবহাওয়া বিভাগটি মান্ধাতা আমলের ধ্যান-ধারণা, কর্তাব্যক্তিদের সেকেলে মানসিকতায় স্থবির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সম্প্রতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সহায়তায় নেয়া একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা ও রংপুরের নষ্ট, বিকল দু’টি রাডার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু উভয় রাডার স্থাপনের প্রকল্প শুরু হওয়ার আগেই আবহাওয়া বিভাগের পুরনো সবক’টি রাডার নষ্ট বা অকেজো হয়ে যায়। এর ফলে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়েছে আবহাওয়া বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা, রংপুর, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, রংপুর ও মৌলভীবাজারে আবহাওয়া বিভাগের (বিএমডি) ৫টি রাডার স্টেশন রয়েছে। ঢাকা ও রংপুরের রাডার দু’টি স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। ১৫ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় রংপুরের রাডার ইতোমধ্যে অকেজো হয়ে গেছে। ঢাকায় হাইরাইজ ভবন বেশি হওয়ায় ‘রেডিও জ্যামিং’ সমস্যার কারণে অকেজো ঢাকার রাডারও। বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ নষ্ট ও বিকল হয়ে গেছে সবক’টি রাডারের। পুরনো এসব রাডারের খুচরা যন্ত্রাংশ বিশ্ববাজারে আর মিলছে না। এ অবস্থায় দু’টি পুরোপুরি নষ্ট। অবশিষ্ট তিনটিও অকেজো।
রাডার নষ্ট বা অকেজো থাকলে আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থা অনেকাংশে মুখ থুবড়ে পড়ে। কেননা রাডারের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সাধারণত আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে আগাম বার্তা দেয়া হয়। তাতে মাঠে কৃষকের কৃষিকাজ থেকে শুরু করে সমুদ্রে জেলেদের মাছ শিকার, সমুদ্র বন্দর কার্যক্রম সচল, স্থগিত অথবা সতর্কতায় রাখার পূর্বাভাস দেয়া হয়ে থাকে। এমনিতেই বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দিকে রয়েছে। দুর্যোগের আগাম বার্তা দ্রুততর জানা ও জানানো নাগরিক অধিকার। অথছ যেখানে রাডারই নষ্ট বা অকেজো সেখানে পূর্বাভাসের জন্য বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হচ্ছে অন্যান্য দেশ ও সংস্থার প্রযুক্তিগত তথ্য ও পূর্বাভাস ব্যবস্থার উপর।
এ অবস্থায় আবহাওয়া বিভাগ কখন, কী পূর্বাভাস দিয়ে থাকে তা অনেক সময়েই কঠিন । জনগণ নাকি কার উদ্দেশে পূর্বাভাস তাও প্রশ্ন। অনেকেই রসিকতা করে বলেন ‘আবহাওয়া বিভাগ যদি বলে বৃষ্টি হবে, সেদিন ধরে নিতে হবে রোদ থাকবে। রোদ থাকবে বললে বৃষ্টি পড়বে। অর্থাৎ পূর্বাভাসের উল্টোটাই ঘটবে!
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনসূত্রে আরো জানা গেছে, ঢাকা ও রংপুরে অকেজো দু’টি রাডারের স্থলে নতুন করে স্থাপনের জন্য জাপানের সঙ্গে সরকার যোগাযোগ করে। জাপান সরকার দু’টি রাডারের জন্য অনুদান দিতে রাজি হয়। ২০১৫ সালের ২৪ জুন উভয় সরকারের মধ্যে একটি অনুদান চুক্তি স্বাক্ষর হয়। জাইকা’র সহায়তায় অনুদানের পরিমাণ ছিল ১৮৬ কোটি টাকা। তবে আইএমইডি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বলেছে, ঢাকা ও রংপুরে দু’টি রাডার স্থাপন প্রকল্পটি গ্রহণ করার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। কিন্তু অবশিষ্ট তিনটি রাডারও যে অতি পুরনো, সেকেলে এবং নষ্ট বা বিকল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, এ বিষয়টি সেই সম্ভাব্যতা যাচাইকালে উঠে আসেনি কেন? তাছাড়া তখন নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের আগেই পুরনো সবগুলো রাডার একসঙ্গে কীভাবে নষ্ট বা অকেজো হলো?
এদিকে ‘ঢাকা ও রংপুরে আবহাওয়া রাডারের উন্নয়ন’ শীর্ষক জাইকা’র ১৮৬ কোটি টাকার অনুদানে মোট ২০৮ কোটি টাকায় প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। তবে বাস্তবায়নে হাত দেয়ার আগেই দুই দফায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৬০ কোটি টাকা। তবে ওই প্রকল্পে ২০২২ সাল পর্যন্ত অর্থায়ন হয়নি। পরে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত আরেক দফায় বাড়ানো হয়েছে।
এ প্রকল্পের উপর পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতি, অদূরদর্শিতা, প্রকল্পের ঝুঁকি, সমস্যাবলী উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে। কর্মকর্তাদের অবহেলাতেই রাডারগুলো নষ্ট ও অকেজো হয়ে পড়েছে কিনা সেই প্রশ্নও উঠেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে প্রকল্পটি গ্রহণের সময় ৫টি রাডার স্টেশনের মধ্যে ঢাকা ও রংপুরের দু’টি ছাড়া অন্য তিনটি রাডার স্টেশন (কক্সবাজার, খেপুপাড়া ও মৌলভীবাজারে স্থাপিত) সচল ছিল। যদিও সেগুলো পুরনো ও সেকেলে। নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগেই বর্তমান সব রাডার নষ্ট বা অকেজো হয়ে পড়েছে। অথচ এ প্রকল্পটি হাতে নেয়ার আগেই সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হয়েছিল।
দেশের রাডারগুলো যে সচল নয়; প্রায়ই নষ্ট ও অকেজো অবস্থায় পড়েছিল এ বিষয়টি সাম্প্রতিক কয়েক বছরের বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রকারের দুর্যোগের পূর্বাভাস পর্যালোচনা করলেই ধরা পড়ে। এ সময়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন দুর্যোগ সম্পর্কে বহির্বিশ্বের বিজ্ঞানী এবং আবহাওয়া-জলবায়ু পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে জানতে পেরেছে আবহাওয়া বিভাগ (বিএমডি)। এরপরই সতর্কবার্তা প্রচার এবং সতর্ক সঙ্কেত ওঠানামা হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড়সড় কোন দুর্যোগের পূর্বাভাস প্রদানে সক্ষম হয়নি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন আইএমইডি’র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে, শুধুই ঢাকা কিংবা রংপুরের নষ্ট রাডার নতুন করে স্থাপনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেই সমস্যার কোন সমাধান হবে না। কারণ অবশিষ্ট তিনটি রাডার নষ্ট হওয়ায় সঠিক তথ্য বিশ্লেষণের জন্য ঢাকায় অপর তিনটি বাইরের রাডারের তথ্য সমন্বয় বা নেটওয়ার্কিং করা সম্ভব হবে না। এ দু’টি রাডার স্থাপনের মাধ্যমে বর্তমানে অন্য যে তিনটি রাডার স্টেশন (কক্সবাজার, খেপুপাড়া ও মৌলভীবাজারে স্থাপিত) অকেজো ও নষ্ট থাকায় ঢাকার সাথে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপন করে একই প্লাটফর্মে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
আইএমইডি বলেছে, রাজধানী ঢাকার সুউচ্চ ভবনগুলো রাডার কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ‘রেডিও জ্যামিং’-এর জন্য বড় একটি বাধা। যথাসময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না করার কারণে আবহাওয়া অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তাই এস ডপলার রাডার ব্যবহারের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেননি।
আইএমইডি পরামর্শ দিয়েছে, ঢাকা ও রংপুরের নষ্ট বা বিকল দু’টি নতুন রাডার স্থাপনের সাথে সাথেই বর্তমানে প্রায় অকার্যকর অপর তিনটি স্থানেও (কক্সবাজার, খেপুপাড়া ও মৌলভীবাজার) নতুন রাডার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাহলে সবক’টি রাডারের সাথে আন্তঃযোগাযোগ বা নেটওয়ার্কিং স্থাপিত হবে। ১৫ থেকে ১৭ তলা উচ্চতার রাডার ভবনে লিফট স্থাপন, পর্যাপ্ত সংখ্যক আবহাওয়াবিদ ও প্রকৌশলী এবং প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব দূরীকরণ, জনবলের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। রাডারের খুচরা যন্ত্রাংশ সহজলভ্য না হওয়ায় যন্ত্রপাতিগুলোর টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি সম্পাদন করার পরামর্শ দিয়েছে সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন আইএমইডি।
এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ভিসি সাবেক চুয়েট ভিসি প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উৎক্ষেপিত ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এবং আশপাশের অন্যান্য স্যাটেলাইটের সর্বাধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তিগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে সারা দেশে এমনকি ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে সময়মতো সঠিক আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রদানের লক্ষ্যে সরকার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু কেন তা বিলম্বিত হচ্ছে বিষয়টি উদ্বেগজনক। শুধুই গরম-ঠাণ্ডার পূর্বাভাস নয়; কৃষিকাজ, খামারি থেকে শুরু করে সমুদ্রে মাছ শিকারি জেলেদের নিরাপত্তায়ও সঠিক পূর্বাভাস প্রয়োজন। এরজন্য আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থা যুগোপযোগী আধুনিকায়ন করে ঢেলে সাজানো এবং জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে।