পবিত্র রমজানের শুরুতেই জমজমাট হয়ে উঠেছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী চকবাজার। প্রথম ইফতারকে কেন্দ্র করে শাহী মসজিদের সামনে দেখা গেছে চিরচেনা সেই রূপ। বরাবরের মতো। নানান ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক ও বাহারি সব খাবার, শরবত আর হাঁকডাকে সরগরম পুরো এলাকা। যেন উৎসবের আমেজ চলছে। নানান স্বাদের ইফতার কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে ছুটে আসেন এখানে। রোজায় ইফতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষঙ্গ। ইফতারের খাবারসামগ্রী বিক্রির জন্য বহুল পরিচিত নাম ঢাকার চকবাজার। বহু বছরের ঐতিহ্য আর খাবারের ভিন্ন স্বাদের কারণে পুরান ঢাকার এই খানদানি ইফতারের সুনাম ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। সে জন্য প্রতিবারের মতো এবারো রমজানের প্রথম দিনেই উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে এই ইফতার বাজারে। চকবাজারের ইফতার আইটেমের মধ্যে প্রতিবারের ন্যায় এবারো অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। এই ইফতার আইটেমটি তৈরিতে গোশত, সুতি কাবাব, গোশতের কিমা, ভাবলি, বুটের ডাল, ডিম, মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনো মরিচসহ নানা পদ এবং মসলার ব্যবহার করা হয়। প্রতি কেজির দাম ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। এই খাবারকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের কৌতূহল আর আগ্রহ যেমন বেশি, তেমনি বিক্রেতাদের হাঁকডাকও বেশি। ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গা ভইরা লইয়া যায়’, ‘ধনী-গরিব সবাই নায়, মজা পাইয়া লইয়া যায়’, ‘মজার খাওন খাইয়া যান, প্যাকেট ভইরা লইয়া যান’, ‘আসল খাওন দেইখা যান, বাসার লাইগা নিয়া যান’সহ বিভিন্ন ছন্দ কাটতে দেখা যায় দোকনদারদের। আর এই খাবার কিনতে ক্রেতাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। অনেকে এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকেও। তবে এখানে ইফতার কিনতে আসা মানুষের যেমন ভিড় ছিল, তেমনি শুধু দেখতে আসা মানুষের ভিড়ও কম ছিল না।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, এবার প্রতি পিস চিকেন মোমো ৩৫ টাকা, বাকনাব্য ৪৫ টাকা, কিমা পরাটা ১১০ টাকা, টান পরাটা ৭০ টাকা, চিকেন সাসলিক ১১০ টাকা, অ্যারাবিয়ান কাবাব ৮০ টাকা, মুর্তি কাবাব ৬০ টাকা, হালিম (প্রতি কেজি) ৮০০ টাকা, বটি কাবাব ১২০ টাকা, দই বড়া ২০ টাকা, শাহী জিলাপি (প্রতি কেজি) ৩০০ টাকা, সাধারণ জিলাপি (প্রতি কেজি) ২০০ টাকা, চিকেন চাপ ১৫০ টাকা, কোয়েল পাখির রোস্ট ১০০ টাকা, টিকা ৪০ টাকা, জালি টিক্কা ৫০ টাকা, চিকেন কারি ৭০ টাকা, বিফ কারি ৮০ টাকা, শাহী পরাটা ৬০ টাকা, সাদা সাদা পরাটা ৪০ টাকা, সুতি কাবাব (প্রতি কেজি) এক হাজার ২০০ টাকা, কবুতর রোস্ট ৩৫০ টাকা, খাসির লেগ রোস্ট এক হাজার টাকা, আন্ত চীন্য হাঁস রোস্ট এক হাজার ৫০০ টাকা, আজ চিকেন গ্রিল ৪৫০ টাকা, আন্ত পাতিহাস এক হাজার টাকা, গরুর সুতি কাবার (প্রতি কেজি) এক হাজার ২০০ টাকা, চিকেন পরাটা ৬০ টাকা, বিফ পরাটা ৭০ টাকা, চিকেন রোল ৫০ টাকা, পরর কাবাব ৫০ টাকা, খাসির জালি কাবাব ৫০ টাকা, ডিম চপ ৪০ টাকা, চিকেন বটি কাবাব ১৫০ টাকা, চিকেন তন্দুরি ২৫০ টাকা, চিকেন লেগ পিস ৫০ টাকা, আলু পরাটা ৩০ টাকা, ঘুগনি (২৫০ গ্রাম। ৩০ টাকা, ঘিয়ে ভাজ্য জিলাপি (প্রতি কেজি) ৩০০ টাকা, কাশ্যিরি বটি কাবাব (প্রতি কেজি) এক হাজার ৮০০ টাকা, চিকেন আচারি (প্রতি কেজি) এক হাজার টাকা, গরুর কোপ্তা ২০ টাকা, চিকেন বন ১৫ টাকা, শাহী তন্দুরী ১২০ টাকা, কেশোয়ারি ৪০ টাকা, চিকেন কাটলেট ৬০ টাকা, কিমা পরাটা ৬০ টাকা, চিকেন ফ্রাই ১৫০ টাকা, আন্ত মুরগির রোস্ট ৬০০ টাকা, ছোট পিজ্জা ৫০ টাকা, সবজি নান ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া পানীয়ের দিক দিয়ে প্রতি লিটার শরবত-ই মোহাব্বত ২০০ টাকা, মাঠা ১৪০ টাকা, গোড ২৫০ টাকা, লাবাং ২০০ টাকা, বোরহানি ১২০ টাকা, পেস্তা বাদামের শরবত ৩৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিষ্টিজাতীয় খাবারের মধ্যে প্রতি পিস মালপোয়া ৩০ টাকা, পাটিসাপ্টা ৩০ টাকা, ফালুদা (বক্স) ১১০-২২০ টাকা, ফিরনি (বক্স) ১২০ টাকা, জর্ন্য (বক্স) ১২০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়।
গত বছরের তুলনায় এবার চকবাজারে ইফতার আইটেমের দাম বেশি বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা। অবশ্য বাড়তি দামের বিষয়টি মানতে নারাজ বিক্রেতারা। তারা বলছেন, বাজারে সবকিছুর দাম এমনিতেই বেশি। ইফতারেও এর প্রভাব পড়েছে। তবে দাম বাড়লেও খানদানি ইফতার কিনতে কার্পণ্য ছিল না ক্রেতাদের। চকবাজারে তিন প্রজন্য ধরে ইফতার বিক্রি করে আসছেন মন্টু মিয়া। থাকেন পুরান ঢাকার বকশিবাজারে। তিনি বলেন, আমার নানা এখানে ইফতার বিক্রি করতেন। তারপর মামারা বিক্রি করতেন। এখন আমি বিক্রি করছি। ১০ বছর বয়স থেকে এখানে ইফতার বিক্রি করি। প্রায় ৩২ বছর হয়েছে। প্রতি বছরই ঐতিহ্যবাহী এই ইফতার বাজার জমে ওঠে। এবারো এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রথম দিনেই ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় রয়েছে। ইফতারের আগ মুহূর্তে এটি আরো বাড়বে।
রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খানদানি ইফতার কিনতে চকবাজারে ছুটে এসেছেন ক্রেতারা। তাদের একজন জুয়েল। চাকরি করেন একটি ল চেম্বারে। তিনি এসেছেন কাকরাইল থেকে। জুয়েল বলেন, প্রতি বছরই চকবাজারে ইফতার কিনতে আসা হয়। এবার প্রথম দিনেই এসেছি। কাবাব, চিকেন কাল ফ্রাই, চিকেন গ্রিল, ডিম চপ, রোস্ট-সহ বিভিন্ন আইটেম কিনেছি। একসাথে এত ইফতার দেশের আর কোথাও পাওয়া যায় না। প্রথম দিনেই এই ইফতার বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে।
আব্দুর রহমান নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ১৬৭৬ সালে পুরান ঢাকার চকবাজারে শাহী মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন মোগল সুবেদার শায়েস্তা খান। পরে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ ১৭০২ সালে চকবাজারকে একটি আধুনিক বাজারে রূপ দেন। তখন থেকে প্রতি রমজানে এখানে মুখরোচক ইফতারি বাজারের প্রচলন গুদাম হয়। এটি এখন পর্যন্ত চলছে। অনেকে বংশপরম্পরা এখানে ব্যবসা করছেন। এটা অনেক দিনের ঐতিহ্য।