ঢাকা ০৮:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাবি ছাত্রলীগ নেতাদের শাস্তি হলেও যৌন নিপীড়ক শিক্ষক জনির কি শাস্তি হবে?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই তিন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ও ৬ জনের সনদ স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু দেড় বছর হয়ে গেলেও যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিচার শেষ করছে না প্রশাসন। যদিও তদন্ত কমিটি অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। স্ট্রাকচার্ড কমিটির কাছেও লিখিত বক্তব্যে জনি সব স্বীকার করেছেন। কিন্তু সাময়িক বহিষ্কার তো দূরে থাক বহাল তবিয়তে আছেন জাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এ সভাপতি।

এ বিচার শেষ না হওয়ার পেছনে উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের সদিচ্ছার অভাব দেখছেন স্ট্রাকচার্ড কমিটির একজন সদস্য। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, ‘লিখিত বক্তব্যে মাহমুদুর রহমান জনি তার বিরুদ্ধে উঠা যৌন নিপীড়নের সব অভিযোগ স্বীকার করেছেন। আমরা কমিটির সদস্যরাও নিশ্চিত হয়েছি যে, তিনি অপরাধী। তার কঠিন শাস্তি হবে। এখন উপাচার্য চাইলে এটি শেষ করে দিতে পারেন।’

তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পাঁচটি সভা হয়েছে। সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারী) ছয় নম্বর সভা ছিল, কিন্তু উপাচার্য তা স্থগিত করেছেন। প্রতি সভায়ই উপাচার্যের কথায় মনে হয় তিনি বিচার শেষ করে দেবেন। তিনিও চান বিচার হোক। কিন্তু পরে তিনি (উপাচার্য) কোন কথা বলেন না। সবসময় এড়িয়ে যান। এখন তিনি স্ট্রাকচার্ড কমিটির প্রধান। তার বাইরে গিয়ে আমরা কেউ বিষয়টি সিন্ডিকেটে তুলতে পারি না।’

বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও মনে করছেন, নৈতিক স্খলনের দায়ে অভিযুক্ত জনি সরাসরি বলেছেন তার সহযোগিতায় বর্তমান উপাচার্য নূরুল আলম চেয়ার বসেছেন। এজন্যই হয়তো তিনি বিচার করছেন না। কালক্ষেপণের মাধ্যমে তাকে দায়মুক্তি দিতে পারেন।

ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনিসা পারভীন জলির মতে, এমন হলে পরবর্তীতে যৌন হয়রানি বা প্রতারণার মতো এমন ঘটনা আরও বাড়তে থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরা শিক্ষক সমাজের জন্য তা লজ্জাজনক।

তিনি বলেন, ‘জনির মত একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের মত পবিত্র জায়গায় বিচরণ করলে শিক্ষক সমাজের মাথা নুয়ে পড়ার মতো অবস্থা হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরও জনির বিচারে সব নিয়ম ভঙ্গ করেছে প্রশাসন। তিনি বীরদর্পে প্রশাসনের প্রভাবশালী শিক্ষকদের সাথে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ান। এতেই বুঝা যায়, কারা ক্যাম্পাসকে ধর্ষক, সন্ত্রাসী, খুনিদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছেন।’

বর্তমান উপাচার্য নূরুল আলম অভিযুক্ত জনির সহযোগিতায় এ চেয়ারে বসেছেন। সেজন্যই বিষয়টি নিয়ে উপাচার্য নীরব ভূমিকা পালন করছেন। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, জনির দাবি সত্য। এজন্য উপাচার্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। আর বরাবরের মতো উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম মাহমুদুর রহমান জনির বিষয়টি এড়িয়ে যান। রোববার (৪ ফেব্রুয়ারী) সন্ধ্যায় সিন্ডিকেট সভা শেষ সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন।

মাহমুদুর রহমান জনি পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৩৬ ব্যাচের ছাত্র। ২০১২ সালে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি হন। ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে তিনি সহকারী অধ্যাপক। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে ‘অনৈতিক’ সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ ওঠে।

সর্বশেষ ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর মাহমুদুর রহমান জনি ও একই বিভাগে নিয়োগ পাওয়া প্রভাষক আনিকা বুশরা বৈচির একটি অন্তরঙ্গ ছবি (সেলফি) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে পোস্টারিং করা হয়। যেখানে বলা হয়, এভাবেই ললিপপের ভেল্কিতে শিক্ষিকা হলেন আনিকা বুশরা বৈচি।

একই সঙ্গে বিভাগের শিক্ষক পদে আবেদনকারী ৪৩ ব্যাচের এক ছাত্রীর সঙ্গে অন্তর‌ঙ্গ কথাবার্তার অডিও প্রকাশ্যে আসে। যেখানে মাহমুদুর রহমান জনি ভুক্তভোগীকে জোরপূর্বক গর্ভপাত করান। এছাড়া, জনির সঙ্গে ছাত্রলীগের একাধিক নেত্রীর ‘অনৈতিক’ সম্পর্ক স্থাপন এবং ‘অশালীন’ চ্যাটিংয়ের ছবি ও তথ্য সামনে আসে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে জনির বিচারের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। পরে ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর একাধিক ছাত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগে জনির বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তখন চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এ সময় জনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু এরপরও জনির বিচার নিয়ে শুরু হয় কালক্ষেপণ।

এরই মধ্যে পার হয়ে যায় এক বছর। ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কুরিয়ারযোগে সাংবাদিকদের কাছে উপাচার্যকে গালিগালাজ করার অডিও ক্লিপ সম্বলিত একটি ডিভিও, দায়মুক্তিপত্র প্রত্যাহার সংক্রান্ত আবেদনপত্র ও একটি উড়োচিঠি আসে। সেখানে ৫২ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপে মাহমুদুর রহমান জনিকে বলতে শোনা যায়, ‘বাট ইউ ফরগেট, আই ওয়াজ ওয়ান্স আপন এ টাইম, আই ওয়াজ দ্য এক্স প্রেসিডেন্ট অফ বিএসএল-জেইউ। আমি হয়তো ধরা খাবো, ধরা খাবো না এমন বলছি না। কিন্তু ধরা খাওয়ার আগে আমি চার-পাঁচটা মুখ শেষ করে দেবো।’

এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘এন্ড ভিসিকে আমি একজনকে দিয়ে রিচ করেছিলাম, ভিসি বলছে যে আমি ওকে বহিষ্কার করে দিচ্ছি, সাসপেন্ড করে দিচ্ছি। ওকে আইনের আশ্রয় নিতে বলো। যেহেতু আমাকে আইনের আশ্রয় নিতে বলছে, আমাকে নাকি বহিষ্কার করে দিচ্ছে ইউনিভার্সিটি থেকে। তবে ওই মাদার… (উপাচার্য) যে আমার জন্য চেয়ারে বসেছে, সেটা সে ভুলে গেছে।’

এছাড়াও ডকুমেন্টের সাথে ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি উপাচার্য বরাবর লিখিত পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের ভুক্তভোগী ছাত্রী স্বাক্ষরিত পাঁচ পৃষ্ঠার একটি আবেদনপত্র পাওয়া গেছে।

ভুক্তভোগী ছাত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মাহমুদুর রহমান জনি বিভিন্ন চাপের মুখে পড়ার পর আমি যেন বিষয়টি স্বীকার না করি সেজন্য আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখায় এবং বলে যদি এসব কিছু ঠিক হয়ে যায়, তাহলে সে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি দিবে। এ বলে সে আমার কাছ থেকে উপাচার্য বরাবর চার পৃষ্ঠার একটি দায়মুক্তিপত্র লিখিয়ে নেয়। তবে পরবর্তীতে সে কথা রাখেনি এবং যথারীতি সে একজন প্রতারক।’

জনির বিরুদ্ধে দায়মুক্তিপত্র লেখানোর অভিযোগ উঠার পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপি দেয় মহিলা পরিষদ। পরে জনির বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেয় ইউজিসি। পরবর্তীতে জনিকে দায়মুক্তি দেয়ার শঙ্কায় শিক্ষার্থীরা আবারও আন্দোলন শুরু করেন।

সর্বশেষ গত বছরের ১০ আগস্ট ওই কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা নিশ্চিত হওয়া সাপেক্ষে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠিত হয়।

দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ অনুসারে স্ট্রাকচার্ড কমিটি ৬ সদস্য বিশিষ্ট হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন উপাচার্য। এ ছাড়া নিজ অনুষদের ডিন, বিভাগের চেয়ারম্যান, দুজন সিন্ডিকেট সদস্য এবং রেজিস্ট্রার এই কমিটির সদস্য মনোনীত হন। স্ট্রাকচার্ড কমিটির কার্যক্রম উপাচার্যের আহবানে সংগঠিত হয়। সে হিসেবে মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে গঠিত এই কমিটিতে আছেন উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম, জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক নুহু আলম, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান মাহফুজা মোবারক এবং সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক লায়েক সাজ্জাদ এন্দেল্লাহ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক আশরাফ-উল আলম।

নিয়ম অনুযায়ী ওইসময় জনিকে সাময়িক বহিষ্কার করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। বিষয়টি পাঠানো হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলেও।

এ বিষয়ে সেলের সভাপতি ও লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. জেবউননেছা বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে খুব কঠোর। ২০২২ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর ১৩টি অভিযোগের মধ্যে ১১টি নিষ্পত্তি করেছি। এজন্য নিয়ম অনুযায়ী জনির বিষয়টি আমার সেলে আসার কথা থাকলেও প্রশাসন থেকে দেয়া হয়নি। তারা ধারণা করেছে, আমি ছাড় দেবো না; কালক্ষেপণও করবো না। শাস্তির সুপারিশ করে প্রতিবেদন দিয়ে দেবো। এজন্যই হয়তো এ সেলে পাঠানো হয়নি।’

জাবি ছাত্রলীগ নেতাদের শাস্তি হলেও যৌন নিপীড়ক শিক্ষক জনির কি শাস্তি হবে?

আপডেট সময় ০৭:৩৩:৩৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই তিন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ও ৬ জনের সনদ স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু দেড় বছর হয়ে গেলেও যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিচার শেষ করছে না প্রশাসন। যদিও তদন্ত কমিটি অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। স্ট্রাকচার্ড কমিটির কাছেও লিখিত বক্তব্যে জনি সব স্বীকার করেছেন। কিন্তু সাময়িক বহিষ্কার তো দূরে থাক বহাল তবিয়তে আছেন জাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এ সভাপতি।

এ বিচার শেষ না হওয়ার পেছনে উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের সদিচ্ছার অভাব দেখছেন স্ট্রাকচার্ড কমিটির একজন সদস্য। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, ‘লিখিত বক্তব্যে মাহমুদুর রহমান জনি তার বিরুদ্ধে উঠা যৌন নিপীড়নের সব অভিযোগ স্বীকার করেছেন। আমরা কমিটির সদস্যরাও নিশ্চিত হয়েছি যে, তিনি অপরাধী। তার কঠিন শাস্তি হবে। এখন উপাচার্য চাইলে এটি শেষ করে দিতে পারেন।’

তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পাঁচটি সভা হয়েছে। সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারী) ছয় নম্বর সভা ছিল, কিন্তু উপাচার্য তা স্থগিত করেছেন। প্রতি সভায়ই উপাচার্যের কথায় মনে হয় তিনি বিচার শেষ করে দেবেন। তিনিও চান বিচার হোক। কিন্তু পরে তিনি (উপাচার্য) কোন কথা বলেন না। সবসময় এড়িয়ে যান। এখন তিনি স্ট্রাকচার্ড কমিটির প্রধান। তার বাইরে গিয়ে আমরা কেউ বিষয়টি সিন্ডিকেটে তুলতে পারি না।’

বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও মনে করছেন, নৈতিক স্খলনের দায়ে অভিযুক্ত জনি সরাসরি বলেছেন তার সহযোগিতায় বর্তমান উপাচার্য নূরুল আলম চেয়ার বসেছেন। এজন্যই হয়তো তিনি বিচার করছেন না। কালক্ষেপণের মাধ্যমে তাকে দায়মুক্তি দিতে পারেন।

ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনিসা পারভীন জলির মতে, এমন হলে পরবর্তীতে যৌন হয়রানি বা প্রতারণার মতো এমন ঘটনা আরও বাড়তে থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরা শিক্ষক সমাজের জন্য তা লজ্জাজনক।

তিনি বলেন, ‘জনির মত একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের মত পবিত্র জায়গায় বিচরণ করলে শিক্ষক সমাজের মাথা নুয়ে পড়ার মতো অবস্থা হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরও জনির বিচারে সব নিয়ম ভঙ্গ করেছে প্রশাসন। তিনি বীরদর্পে প্রশাসনের প্রভাবশালী শিক্ষকদের সাথে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ান। এতেই বুঝা যায়, কারা ক্যাম্পাসকে ধর্ষক, সন্ত্রাসী, খুনিদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছেন।’

বর্তমান উপাচার্য নূরুল আলম অভিযুক্ত জনির সহযোগিতায় এ চেয়ারে বসেছেন। সেজন্যই বিষয়টি নিয়ে উপাচার্য নীরব ভূমিকা পালন করছেন। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, জনির দাবি সত্য। এজন্য উপাচার্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। আর বরাবরের মতো উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম মাহমুদুর রহমান জনির বিষয়টি এড়িয়ে যান। রোববার (৪ ফেব্রুয়ারী) সন্ধ্যায় সিন্ডিকেট সভা শেষ সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন।

মাহমুদুর রহমান জনি পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৩৬ ব্যাচের ছাত্র। ২০১২ সালে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি হন। ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে তিনি সহকারী অধ্যাপক। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে ‘অনৈতিক’ সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ ওঠে।

সর্বশেষ ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর মাহমুদুর রহমান জনি ও একই বিভাগে নিয়োগ পাওয়া প্রভাষক আনিকা বুশরা বৈচির একটি অন্তরঙ্গ ছবি (সেলফি) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে পোস্টারিং করা হয়। যেখানে বলা হয়, এভাবেই ললিপপের ভেল্কিতে শিক্ষিকা হলেন আনিকা বুশরা বৈচি।

একই সঙ্গে বিভাগের শিক্ষক পদে আবেদনকারী ৪৩ ব্যাচের এক ছাত্রীর সঙ্গে অন্তর‌ঙ্গ কথাবার্তার অডিও প্রকাশ্যে আসে। যেখানে মাহমুদুর রহমান জনি ভুক্তভোগীকে জোরপূর্বক গর্ভপাত করান। এছাড়া, জনির সঙ্গে ছাত্রলীগের একাধিক নেত্রীর ‘অনৈতিক’ সম্পর্ক স্থাপন এবং ‘অশালীন’ চ্যাটিংয়ের ছবি ও তথ্য সামনে আসে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে জনির বিচারের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। পরে ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর একাধিক ছাত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগে জনির বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তখন চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এ সময় জনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু এরপরও জনির বিচার নিয়ে শুরু হয় কালক্ষেপণ।

এরই মধ্যে পার হয়ে যায় এক বছর। ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কুরিয়ারযোগে সাংবাদিকদের কাছে উপাচার্যকে গালিগালাজ করার অডিও ক্লিপ সম্বলিত একটি ডিভিও, দায়মুক্তিপত্র প্রত্যাহার সংক্রান্ত আবেদনপত্র ও একটি উড়োচিঠি আসে। সেখানে ৫২ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপে মাহমুদুর রহমান জনিকে বলতে শোনা যায়, ‘বাট ইউ ফরগেট, আই ওয়াজ ওয়ান্স আপন এ টাইম, আই ওয়াজ দ্য এক্স প্রেসিডেন্ট অফ বিএসএল-জেইউ। আমি হয়তো ধরা খাবো, ধরা খাবো না এমন বলছি না। কিন্তু ধরা খাওয়ার আগে আমি চার-পাঁচটা মুখ শেষ করে দেবো।’

এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘এন্ড ভিসিকে আমি একজনকে দিয়ে রিচ করেছিলাম, ভিসি বলছে যে আমি ওকে বহিষ্কার করে দিচ্ছি, সাসপেন্ড করে দিচ্ছি। ওকে আইনের আশ্রয় নিতে বলো। যেহেতু আমাকে আইনের আশ্রয় নিতে বলছে, আমাকে নাকি বহিষ্কার করে দিচ্ছে ইউনিভার্সিটি থেকে। তবে ওই মাদার… (উপাচার্য) যে আমার জন্য চেয়ারে বসেছে, সেটা সে ভুলে গেছে।’

এছাড়াও ডকুমেন্টের সাথে ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি উপাচার্য বরাবর লিখিত পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের ভুক্তভোগী ছাত্রী স্বাক্ষরিত পাঁচ পৃষ্ঠার একটি আবেদনপত্র পাওয়া গেছে।

ভুক্তভোগী ছাত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মাহমুদুর রহমান জনি বিভিন্ন চাপের মুখে পড়ার পর আমি যেন বিষয়টি স্বীকার না করি সেজন্য আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখায় এবং বলে যদি এসব কিছু ঠিক হয়ে যায়, তাহলে সে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি দিবে। এ বলে সে আমার কাছ থেকে উপাচার্য বরাবর চার পৃষ্ঠার একটি দায়মুক্তিপত্র লিখিয়ে নেয়। তবে পরবর্তীতে সে কথা রাখেনি এবং যথারীতি সে একজন প্রতারক।’

জনির বিরুদ্ধে দায়মুক্তিপত্র লেখানোর অভিযোগ উঠার পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপি দেয় মহিলা পরিষদ। পরে জনির বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেয় ইউজিসি। পরবর্তীতে জনিকে দায়মুক্তি দেয়ার শঙ্কায় শিক্ষার্থীরা আবারও আন্দোলন শুরু করেন।

সর্বশেষ গত বছরের ১০ আগস্ট ওই কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা নিশ্চিত হওয়া সাপেক্ষে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠিত হয়।

দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ অনুসারে স্ট্রাকচার্ড কমিটি ৬ সদস্য বিশিষ্ট হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন উপাচার্য। এ ছাড়া নিজ অনুষদের ডিন, বিভাগের চেয়ারম্যান, দুজন সিন্ডিকেট সদস্য এবং রেজিস্ট্রার এই কমিটির সদস্য মনোনীত হন। স্ট্রাকচার্ড কমিটির কার্যক্রম উপাচার্যের আহবানে সংগঠিত হয়। সে হিসেবে মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে গঠিত এই কমিটিতে আছেন উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম, জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক নুহু আলম, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান মাহফুজা মোবারক এবং সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক লায়েক সাজ্জাদ এন্দেল্লাহ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক আশরাফ-উল আলম।

নিয়ম অনুযায়ী ওইসময় জনিকে সাময়িক বহিষ্কার করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। বিষয়টি পাঠানো হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলেও।

এ বিষয়ে সেলের সভাপতি ও লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. জেবউননেছা বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে খুব কঠোর। ২০২২ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর ১৩টি অভিযোগের মধ্যে ১১টি নিষ্পত্তি করেছি। এজন্য নিয়ম অনুযায়ী জনির বিষয়টি আমার সেলে আসার কথা থাকলেও প্রশাসন থেকে দেয়া হয়নি। তারা ধারণা করেছে, আমি ছাড় দেবো না; কালক্ষেপণও করবো না। শাস্তির সুপারিশ করে প্রতিবেদন দিয়ে দেবো। এজন্যই হয়তো এ সেলে পাঠানো হয়নি।’