নির্বাচান অবাধ, নিরপেক্ষ ও সহিংসতা মুক্ত করতে নির্বাচন কমিশন ও সরকারি দল নানা ধরণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেই সাথে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি বাড়াতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবাধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে । কিন্তু প্রতীক পাওয়ার পর প্রচারণার শুরুতেই আওয়ামী লীগের মনোনীত ও দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ-উত্তেজনা শুরু হয়েছে। প্রচারণার শুরুতেই অন্তত আটটি আসনে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনা স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে।
গত সোমবার রাত থেকে গতকাল মঙ্গলবার(১৯ ডিসেম্বর) পর্যন্তই দেশের বিভিন্ন স্থানে এ সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারের দ্বিতীয় দিন গতকাল দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী প্রচারে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মিছিল করেছেন নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত। এ সময় শতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে তাঁর অনুসারীরা মিছিলে অংশ নেন। এতে যান চলাচল বিঘ্নিত হয়। চট্টগ্রাম নগরের পাঠানটুলি ওয়ার্ডে ব্যস্ততম সড়কে গণসংযোগ করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এম এ লতিফ। সেখানে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়।
মেমন ছিল প্রচারণার শুরুটা
আগামী ৭ জানুয়ারী সাধারণ নির্বাচণ অনুষ্ঠিত হবে। ভোটের আরও দুই সপ্তাহের বেশি সময় বাকি আছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের আশঙ্কা- প্রচারের শেষ পর্যায়ে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে থাকবে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন।
গতকাল ১ম দিনে যশোর, জয়পুরহাট, পাবনা, জামালপুর, কুষ্টিয়া, নাটোর, টাঙ্গাইল ও ঢাকার সাভারে আওয়ামী লীগের দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া ফরিদপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের পক্ষের প্রচারে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হকের সমর্থকেরা বাধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাঁর প্রচারপত্র (লিফলেট) ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।
যেসব স্থানে সহিংসতা হলো-
যশোর-১ (শার্শা) আসনে গতকাল আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ও তাঁর সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ ও স্থানীয়দের তথ্য মতে, স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম তাঁর কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে বন্দরের ১ ও ২ নম্বর ফটকে শ্রমিকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছিলেন। এ সময় তাঁদের ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিনের সমর্থক শ্রমিকদের একটি পক্ষ। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ও তাঁর ১০ কর্মীকে পিটিয়ে জখম করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আশরাফুলকে উদ্ধার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনে। এ ঘটনায় প্রায় এক ঘণ্টা বন্ধ থাকে বেনাপোল স্থলবন্দরের কার্যক্রম।
শার্শা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা ইসলাম ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে হামলায় জড়িত বন্দরের ৩ শ্রমিককে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফিল উদ্দিনের লোকজন তাঁদের ওপর হামলা করেছেন। এ বিষয়ে থানায় মামলা করতে গেলেও গ্রহণ করা হয়নি।
বেনাপোল বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন ভক্ত বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করেছেন। একই ঘটনায় দুটি মামলা হওয়ার সুযোগ নেই তাই আশরাফুল আলমের মামলা নেওয়া হয়নি । অভিযোগের বিষয়ে শেখ আফিল উদ্দিন বলেন, বন্দরের ভেতরে শ্রমিকদের সঙ্গে আশরাফুলের কথা-কাটাকাটি হয়েছে। সেখানে শ্রমিকেরা তাঁকে ধাক্কা বা মারধরও করতে পারেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় থানা ঘেরাও
এদিকে জয়পুরহাট-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহফুজ চৌধুরী গত সোমবার রাতে দুই শতাধিক কর্মী-সমর্থক নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়্র ফটকে অবস্থান নেন। তাঁর অভিযোগ, আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের সমর্থকেরা সোমবার বিকেলে কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নে তাঁর কর্মী-সমর্থকদের মারপিট করেছেন। তাঁর প্রধান এজেন্ট ও মাত্রাই ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হাবীব তালুকদারকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তাঁর নির্বাচনী কার্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর এবং ১২ হাজার পোস্টার লুট করা হয়েছে।
রিটার্নিং কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক (ডিসি) সালেহীন তানভীর গাজী তাঁর কার্যালয়ে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তাঁর প্রধান এজেন্টকে ডেকে নিয়ে কথা বলেন। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীকেপরামর্শ দিয়েছেন, থানায় লিখিত অভিযোগ করতে। পুলিশ তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবে।
তবে এ ঘটনায় কালাই থানায় দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি মামলা করেছে। একটি মামলার বাদী স্বতন্ত্র গোলাম মাহফুজ চৌধুরী। অপর মামলার বাদী মাত্রাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মী ইমরান হোসেন। এখন পর্যন্ত এ মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি বলে কালাই থানা সূত্রে জানা গেছে।
নৌকার স্লোগান দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী ওপর হামলা
পাবনায় নৌকার স্লোগান দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও পাবনা-১ (সাঁথিয়া-বেড়া আংশিক) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু সাইয়িদকে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা যায়, আনুমানিক দুপুর ১২টার দিকে আবু সাইয়িদ বাড়ি থেকে কয়েকটি গাড়ি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণার উদ্দেশ্যে বের হন। তাঁর সাথে ছিলেন নৌকার প্রার্থী ও সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হকের ভাই এবং বেড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল বাতেন। নৌকার স্লোগান দিয়ে একদল ব্যক্তি গাড়িবহরটিকে অবরুদ্ধ করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে গাড়িবহরটি বেলা একটার দিকে সাঁথিয়ার বোয়ালিয়া বাজারে পৌঁছালে আবারও বাধার মুখে পড়ে। এ সময় আবু সাইয়িদ তাঁর লোকজন নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে একটি দোকানে আশ্রয় নেন।
আবু সাইয়িদ অভিযোগ করেন, গাড়িবহর আটকে নেতা-কর্মীদের মারপিট করার ঘটনায় তাঁর সাতজন কর্মী আহত হয়েছেন। সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আল্পনা ইয়াসমিন খবর পেয়ে বিকেল পৌনে চারটার দিকে ঘটনাস্থলে গেলে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বের হন আবু সাইয়িদ। সাঁথিয়া থানার ওসি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ পাঠিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছি।
জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মু. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমি বিষয়টি শুনেছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
জামালপুরে নৌকা-স্বতন্ত্রের মধ্যে ধাওয়া-সংঘর্ষ
জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহবুবুর রহমান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রশিদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয় পক্ষের চারজন আহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্র মতে, সরিষাবাড়ী রেলস্টেশনের সামনের সড়কে বেলা ১১টার দিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুর রশিদের সমর্থক মিঠু মিয়ার সঙ্গে নৌকার প্রার্থী মাহবুবুর রহমানের সমর্থক লুৎফর রহমানের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের সমর্থকেরা জড়ো হয়ে সংঘর্ষে জড়ান। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
কুষ্টিয়ায় ভাঙচুরের অভিযোগ
কুষ্টিয়া-৪ (খোকসা-কুমারখালী) আসনেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রউফ অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফের সমর্থকেরা তাঁর নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করেছেন ও তাঁর কুমারখালীর বাসায় হামলা চালিয়েছেন। তিনি সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
খোকসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা বলেন, নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুরের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি।
সাভারে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কার্যালয়ে হামলা
ঢাকা-১৯ (সাভার-আশুলিয়া) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ। এ আসনের আর একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। স্বতন্ত্র এ দুই প্রার্থীর অস্থায়ী নির্বাচনী কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাভার মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) নয়ন কারকুন বলেন, ‘থানা এমন একটি ঘটনার লিখিত অভিযোগ পেয়েছি।’
নাটোরে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ
নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আসিফ আবদুল্লাহ বিন কুদ্দুসের দুই সমর্থককে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় গুরুদাসপুর থানায় একটি মামলা হয়েছে। গুরুদাসপুর থানার ওসি উজ্জ্বল হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে পুলিশ।
টাঙ্গাইলে হামলা-ভাঙচুর
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইউনুস ইসলাম তালুকদারের নির্বাচনী সভা এবং গাড়িবহরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এই হামলার জন্য ইউনুস আওয়ামী লীগের প্রার্থী তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনিরের অনুসারীদের দায়ী করেছেন।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে ভূঞাপুর কাঁচাবাজার এলাকায় একটি বিমা কোম্পানির শাখা কার্যালয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইউনুস ইসলাম তালুকদার তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মীদের নিয়ে সভা করছিলেন। এ সময় একদল যুবক ওই অফিসে হামলা করে। ইউনুস ইসলাম বলেন, হামলাকারীদের নাম উল্লেখ করে থানায় অভিযোগ দিয়েছেন তিনি।
ভূঞাপুর থানার ওসি মো. আহসান উল্লাহ বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছে।