নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়া ও এর অন্তর্গত নিঝুম দ্বীপের মানুষের কাছে “টেকসই বেড়িবাঁধ” এখন কেবল একটি দাবি নয়, এটি হয়ে উঠেছে তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই জনপদ, কিন্তু সুরক্ষার ব্যবস্থায় নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ।
১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে আইলা, আম্পান, সর্বশেষ রিমাল—প্রতিটি দুর্যোগে নিঝুম দ্বীপসহ হাতিয়ার বহু গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। ২-৩ নম্বর সতর্ক সংকেতেই সেখানকার বাড়িঘর ভেসে যায়, রাস্তাঘাট অচল হয়ে পড়ে, আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। সম্প্রতি রিমালের সময় নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের ১১টি গ্রামে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে।
প্রতিবার দুর্যোগের পরই উঠে আসে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর আসে না। স্থানীয়দের অভিযোগ, বেশিরভাগ বাঁধই মেয়াদোত্তীর্ণ ও দুর্বল। সরকারি কাগজে থাকে বরাদ্দ ও সংস্কারের হিসাব, বাস্তবে বাঁধ থাকে ভঙ্গুর। অনেক সময় জোয়ারের ঠিক আগে কাদা, মাটি আর পলিথিন দিয়ে ‘মেরামত’ করে দায় সারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ—যেন মানুষের জীবন নয়, জমি রক্ষায় নামমাত্র প্রয়াস।
এদিকে দেশে মেগা প্রজেক্টে ব্যয় হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা—পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার—সবই দৃশ্যমান। কিন্তু উপকূল সুরক্ষায় দৃশ্যমান কোনো টেকসই উদ্যোগ নেই। জনগণের ক্ষোভ: “আর কত ক্ষতি হলে টেকসই ভাবা হবে?”
সোনাদিয়া ইউনিয়নের এক জেলে রহিম বলেন, “আমরা চাই না বারবার ভেসে যাক ঘরবাড়ি। শুধু চাই একটি টেকসই বাঁধ—যেটা আমাদের জীবন রক্ষা করবে।”
হাতিয়া সোনাদিয়া ইউনিয়নের সাবেক বিএনপি সাধারণ সম্পাদক ও বাজার বনিক সমিতির নেতা আব্দুল মন্নান রানা বলেন, “উপকূল উন্নয়নে দরকার মানবিকতা নয়, দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা ও স্থানীয়দের সম্পৃক্ততা জরুরি।”
বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এবং নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী মাহবুবুর রহমান শামীম বলেন,
“হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের জলবায়ু ঝুঁকির সম্মুখভাগে। এখানে একটি দীর্ঘমেয়াদি, সমন্বিত বেড়িবাঁধ প্রকল্প প্রয়োজন—যা শুধু একটি বাঁধ নয়, হবে একটি পূর্ণাঙ্গ উপকূলীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা।”
তিনি আরও বলেন, “উপকূল রক্ষা মানেই শুধুমাত্র একটি অঞ্চল নয়, এটি আমাদের সামুদ্রিক সীমানা, খাদ্য নিরাপত্তা ও মানুষের জীবন রক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি এখন আর সামাজিক দায় নয়—রাষ্ট্রীয় কর্তব্য।”
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আলাউদ্দিন বলেন, “উপকূলীয় সুরক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডে সুপারিশসহ প্রস্তাব পাঠিয়েছি। স্থানীয় প্রশাসনও কাজ করে যাচ্ছে।”
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), নোয়াখালী জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মো: হালিম সালেহী বলেন,
“বর্তমানে হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপে যেসব বাঁধ রয়েছে, তা জোয়ারভাটা ও সাইক্লোনের চাপ সহ্য করার মতো নয়। ইতোমধ্যে আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি ‘টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প’ তৈরি করেছি। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আগামী ৩০-৪০ বছর এই অঞ্চল রক্ষা করা সম্ভব হবে। তবে বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত ও অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন।”