২০২৪ সালের ১২ জুলাই। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই আন্দোলনকারীদের উপর হামলায় প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভে মিছিল শেষে হামলার শিকার হন ডিগ্রি ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী ও কলেজ সাংবাদিক সমিতির সদস্য মো. তামিম হোসেন। দেশের ইতিহাসে জুলাই আন্দোলনকেন্দ্রিক ছাত্রলীগের হামলায় আহত প্রথম শিক্ষার্থী তিনিই।
তবে এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো এই ঘটনায় কলেজ প্রশাসন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল বাশার ভূঁইয়া সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “ভিক্টিমের পরিবার মামলা না করলে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা যাবে না।
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলাকালে তামিম তার মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, কুমিল্লা মহানগর ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী তার উপর চড়াও হয়ে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় এবং কলেজের কাজী নজরুল ইসলাম হলে নিয়ে গিয়ে তাকে প্রায় দুই ঘণ্টা আটকে রেখে বেধড়ক মারধর করে।
তৎকালীন সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আবু সুফিয়ান রাসেলের উদ্যোগে সহপাঠীরা তাকে উদ্ধার করে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। ঘটনার ছবি ও ভিডিও দেশের বেশ কিছু গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়।
একবছর পেরিয়ে গেলেও কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনার কোনো কার্যকর তদন্ত প্রকাশ হয়নি। ফলে কলেজজুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
তৎকালীন সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আবু সুফিয়ান রাসেল ইনকিলাবকে আরো জানান,
নজরুল হলে ছাত্রলীগের ১৫-২০ জন কর্মীর হামলার শিকার হন তামিম হোসেন। নেতৃত্বে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন বিভাগের হাবিব গাজীসহ তার সহযোগীরা। ৯৯৯-এ কল করে পুলিশ তামিমকে উদ্ধার করা হয়।
১২ ও ১৩ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও কলেজ প্রশাসন বা হল কর্তৃপক্ষ কেউ খোঁজ নেয়নি। অভিযোগ রয়েছে, ১৬ জুলাই হলে সিসিটিভি ফুটেজ মুছে ফেলা হয়।
৫ আগস্ট পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কলেজ প্রশাসন । তামিমের মোবাইল ও মানিব্যাগ আটকে রাখা হয় ১২ আগস্ট পর্যন্ত। অধ্যক্ষ চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা দিলেও এক বছরেও প্রকাশ হয়নি তদন্ত প্রতিবেদন কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা জাহিদুল ইসলাম বলেন,
“তামিমের ওপর বর্বর হামলার পর কলেজ প্রশাসন কয়েকবার আশ্বাস দিলেও কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি। ৫ আগস্টের পর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল। তবুও প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তা দুঃখজনক।”
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মনির হোসেন জানান,“আমরা হামলাকারীদের বিচার চেয়ে বারবার কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে গেছি। কিন্তু শুধু আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাইনি। যা কলেজ প্রশাসনের অদক্ষতার পরিচয় বহন করে। হামলার এক বছরেও কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি ”
তাছাড়া আহত ৩৫৭ জন ছাত্রের সরকারি তালিকায়ও তামিমের নাম নেই। কলেজ কর্তৃপক্ষের টালবাহানার কারণে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আহত শিক্ষার্থীদের এমআইএস তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি।
তামিম হোসেন বলেন,“কলেজে গিয়ে একেকদিন একেক অজুহাত দিয়েছে— ‘নেট নেই’, ‘লোক ডিউটিতে’, ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত আমার নামই ওঠেনি।
কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল বাশার ভূঁইয়া ইনকিলাবকে বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে অভিযুক্ত সাতজনকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং তাদের পরীক্ষা দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। তালিকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে পরিবার মামলা না করলে তদন্ত কপি দেওয়া যাবে না।”
তিনি আরও জানান, “মামলা না হওয়ায় প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। তদন্তে উপাধ্যক্ষ আব্দুল মজিদকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল।
তামিমের বাবা জানান, প্রথমে থানায় অভিযোগ করতে চাইলে ছাত্রলীগ নেতারা বাধা দেয়। পরে গোপনে কান্দিরপাড় ফাঁড়িতে লিখিত অভিযোগ দিই। এক অফিসার ফোনে কয়েকবার কথা বললেও পরে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। অভিযোগটাই হারিয়ে গেছে।”
তিনি আরো জানান , যখন ঘটনা ঘটে তখন থানায় অভিযোগ করতে চাইলে ছাত্রলীগ বাধা দেয়। পরে গোপনে গিয়ে কান্দিরপাড় পুলিশ ফাঁড়িতে আমি লিখিত অভিযোগ দায়ের করি। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে একজন পুলিশ অফিসার কে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফোনের মাধ্যমে কয়েকবার কথা হল অভিযোগ অদৃশ্য হয়ে যায়। এছাড়া তখন কলেজ প্রশাসন কোন ধরনের সহযোগিতা করেনি। আমি আমার সন্তান নিয়ে এখনো সংখ্যায় আছি। বিভিন্ন দিক থেকে সন্ত্রাসীরা হুমকি দিচ্ছে। আমি এই ঘটনার সুস্থ তদন্ত এবং বিচার দাবি করি। ঐসময়ের কলেজ অধ্যক্ষ কোনো সহায়তা করে নি। বর্তমানে কলেজ প্রশাসন তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। একবছর হয়ে গেলো। আমার সন্তানের কি বিচার পাবো নাহ্।
এক বছর পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনায় প্রশাসনিক ও আইনি কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। বরং তালিকা থেকে বাদ পড়ায় কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
এই ঘটনা কেবল একটি নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীকে নিয়ে নয়— এটি পুরো কলেজ প্রশাসনের জবাবদিহি, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত শিক্ষাঙ্গন গঠনের প্রশ্নও জড়িয়ে আছে। তদন্ত রিপোর্টের উপর নির্ভরশীলতা, মামলার অজুহাত এবং সিসিটিভি ফুটেজ মুছে ফেলার ঘটনা প্রশাসনের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তোলে।