“যখন ফোনে লগইন করে রেজাল্ট দেখলাম, মনে হলো মরুভূমির পথিক হারানো উট ফিরে পেয়েছে!”— বলছিলেন মো. মাহফুজ হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের নবাগত শিক্ষার্থী। যার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বহুলী ইউনিয়নে। ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করেছেন জেলার উল্লাপাড়া আকবর আলী সরকারি কলেজে। সাফল্যের স্বাদ যেমন মধুর, তেমনি তার পেছনে লুকিয়ে থাকে অগণিত গল্প—পরিশ্রম, ব্যর্থতা, কান্না, আবার নতুন করে জেগে ওঠা। মাহফুজের এই অভিজ্ঞতাও ব্যতিক্রম নয়।
আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অনুভূতি জানিয়ে মাহফুজ বলেন, “শুরুতেই কৃতজ্ঞতা জানাই মহান রব্বুল আলামিনের প্রতি, যিনি আমার স্বপ্ন পূরণে সহায় হয়েছেন।” রেজাল্টের পর মায়ের কাছে ছুটে গেছেন, সিজদায় লুটিয়ে পড়েছেন, দুই রাকাত শুকরানা নামাজ আদায় করেছেন, অশ্রুসজল চোখে কুরআন তেলাওয়াত করেছেন। বলছিলেন, “সেই শান্তি যেন ঐশ্বরিক কিছু ছিল!”
২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট—মাহফুজের জীবনের এক নির্মম অধ্যায়। ঐদিন ছিল এইচএসসি পরীক্ষার পদার্থবিজ্ঞান ১ম পত্র পরীক্ষা। কিন্তু তিনি ভুল করে দিনক্ষণ গুলিয়ে ফেলেন। ২৮ তারিখ ভেবে ফজরের পর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত পড়াশোনা করে ঘুমিয়ে পড়েন। বন্ধু আহমেদ আলীর ফোনে দুপুরে জানতে পারেন যে আজই পরীক্ষা ছিল, আর তিনি তা মিস করেছেন!
এই ঘটনাটি তার জীবনে বড় ধাক্কা হয়ে আসে। শুরু হয় মানসিক যন্ত্রণা, জীবন থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। আল্লাহ ও নিজের প্রতি আস্থা রেখে টিকে থাকেন। তিনি পরীক্ষায় ফেল করলে অনেকের কাছেই বলতেন— “রেজিস্ট্রেশন ভুল হয়েছে, তাই ফেল করেছি।” তবে প্রকৃত ঘটনা জানতেন কেবল তার মা এবং ঘনিষ্ঠ কয়েকজন। তখন আশপাশের প্রায় সকলের কটূক্তি, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, নেতিবাচক মন্তব্য সহ্য করতে হয়। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, বড় ভাইদের কারও কারও পক্ষ থেকেও এমন আচরণ সহ্য করতে হয়।
এইচএসসিতে দ্বিতীয়বার অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মাহফুজ। সায়েন্স গ্রুপ থেকে মানবিকে চলে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল—ভেঙে পড়া জীবনটাকে নতুনভাবে সাজানো।২০২৩ সালেই ফোকাস বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং -এর তৎকালীন প্রধান পরিচালক তরিকুল ইসলামের পরামর্শে কোচিংয়ে ভর্তি হন। সে বছরই প্রস্তুতি শুরু করেন। এই কোচিংয়ের পরিবেশ তাকে আত্মবিশ্বাস জোগায়। এইচএসসি ২০২৪-এর পর ফের ভর্তি হন সেখানে।
তিনি বলেন, “ফোকাস শুধু কোচিং নয়, এটা যেন একটা পরিবার। সবার আন্তরিকতা, পাঠদান, কনটেন্ট—সবই অসাধারণ। ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানের জন্য ফোকাসের শিট ছিল আমার মূল ভরসা। আলহামদুলিল্লাহ, ফলাফল বলে দিচ্ছে আমি সঠিক জায়গায় ছিলাম।”
ভর্তির ঠিক এক মাস আগে পারিবারিক কারণে মাহফুজকে সিরাজগঞ্জ ছেড়ে ঢাকায় বোনের বাসায় থাকতে হয়। কিন্তু সেখানে মন বসছিল না। তাঁর বাবা ও ভাই একটি পারিবারিক মামলার আসামি হয়ে যান। পরিবারের কাঠামো একদম ভেঙে পড়ে। সবাই যার যার মতো আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হন। মাহফুজ সে মামলার আসামি ছিলেন না, কিন্তু পরিবারের সদস্য হিসেবে অজ্ঞাতনামা আসামিদের তালিকায় তিনি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বাড়িতে যেতে পারতেন না কখনও। তিনি বলেন, এ মামলা ছিল প্রতিহিংসামূলক—বংশীয়ভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা মাত্র।
যাহোক, ২৬ ডিসেম্বর বই খুলে দেখেন—চোখের পানি পড়ছে পাতায়, পড়তে পারছেন না, শুধু সিরাজগঞ্জে ফিরতে ইচ্ছে করছে। তৎক্ষণাৎ ফোন করেন ফোকাসের সেই বড় ভাই তরিকুল ইসলামকে। বলেন, “ভাই, না ফিরলে চান্স পাব না।” উত্তরে তরিকুল বলেন, “কালই চলে আসো, আমরা সব দেখবো।”
পরদিনই সিরাজগঞ্জে ফিরে ফোকাস কোচিংয়ের বাসায় উঠে পড়াশোনা শুরু করেন গোপনে। কারণ এলাকার কেউ কেউ অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে তাকেও গ্রেফতার করিয়ে দিতে তৎপর হন। ফোকাসের তৎকালীন পরিচালক মাসুদ রানা ও বর্তমান পরিচালক মাহবুব হাসান—উভয়েই খোঁজখবর নেন নিয়মিত। এই সময়ই তিনি ঢাবি, জাবি ও জবিতে পরীক্ষা দিয়ে সকল স্থানেই কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
তিনি বলেন, “আমি সবসময় আম্মু-আব্বুকে বলতাম—আমার জন্য সিজদায় গিয়ে দোয়া করতে। বাবা-মায়ের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। আল্লাহ তাঁদের দোয়া কবুল করেছেন—আজ আমি অনেক খুশি। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ফিরেছে।”
চরম হতাশা আর ভুলের অতল থেকে উঠে এসে মাহফুজ আজ স্বপ্নের চূড়ায়।
তিনি চান্স পেয়েছেন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, B ইউনিট – ৬৩তম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, B ইউনিট – ১২৮তম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, C ইউনিট – ২৭তম
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, D ইউনিট – ৫৬তম
মাহফুজের এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ভুল হওয়া মানেই শেষ নয়, বরং তা হতে পারে নতুন শুরুর উপলক্ষ। প্রয়োজন শুধু আত্মবিশ্বাস, সঠিক দিকনির্দেশনা, এবং প্রভুর প্রতি নির্ভরতা।