নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) আওয়ামী ও স্বৈরাচারের দোসর এবং বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত শিক্ষকদের পুনর্বাসন অভিযোগ উঠেছে বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি গঠিত হয়েছে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন নোবিপ্রবি সাধারণ শিক্ষক পরিষদ। কমিটিতে আওয়ামী মদদপুষ্ট শিক্ষক স্থান পেলেও বাদ পড়েছেন চব্বিশ এর জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষকরা। নিজেদের দল ভারী করতেই বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষকদের পুনর্বাসিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ বিএনপি-জামায়াতপন্থী কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
শুক্রবার (২৭ জুন) সাধারণ শিক্ষক পরিষদের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি জানানাো হয়। বার্তা প্রেরক ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাসুদ কাইয়ুমের সাক্ষরিত ঐ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, গত ২৪.০৬.২৫ ইং তারিখে আইকিউএসি সেমিনার রুমে সাধারণ শিক্ষকদের সাথে আলোচনা এবং ২৬.০৬.২০২৫ ইং তারিখে অনলাইনে (জুম মিটিংয়ে) সাধারণ শিক্ষকদের সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত জোরালোভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করার জন্য একটি অন্তবর্তীকালীন “নোবিপ্রবি সাধারণ শিক্ষক পরিষদ” গঠন করার প্রস্তাব আসে। গঠিত কমিটি পরবর্তী শিক্ষক সমিতির নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত নোবিপ্রবি শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় সাধারণ শিক্ষকদের মতামতের ভিত্তিতে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট (জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়) একটি কমিটির অনুমোদন করা হয়।
এদিকে কমিটি গঠনের পর উক্ত কমিটিতে আওয়ামীলীগ সরকারের দোসর শিক্ষকদের স্থান দেওয়া, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সম্মুখসারির শিক্ষকদের বাদ দেওয়া, অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষকদের মতামত না নেওয়া, সম্মতি না নিয়ে কমিটিতে নাম দেওয়া, ক্যাম্পাসে একাডেমিক এবং প্রশাসনিক সব কার্যক্রম থেকে দুই বৎসরের নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত আইন বিভাগের শিক্ষক বাদশা মিয়াকে অনলাইন সভায় যুক্ত করে পুনর্বাসনের চেষ্টাসহ একাধিক অভিযোগ উঠেছে বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণ শিক্ষক পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে গত ২৪ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকিউএসি রুমে মাত্র ২৫-৩০ জন শিক্ষক নিয়ে একটি আলোচনা সভা করা হয়। পরবর্তীতে মাত্র প্রায় ৮০ জন শিক্ষক গত ২৬.০৬.২৫ (বৃহস্পতিবার) অনলাইনে (জুম প্ল্যাটফর্ম) অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৪২১ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। অর্থাৎ অনলাইন ঐ সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষকের মাত্র ২০ শতাংশ উপস্থিত ছিলেন। ফলে অর্ধেকেরও কম সংখ্যক শিক্ষকের মতামত নিয়ে কিভাবে শিক্ষক সমিতির বিকল্প হিসেবে নোবিপ্রবি সাধারণ শিক্ষক পরিষদ গঠিত হয় সে প্রশ্ন উঠেছে সর্ব মহলে।
অভিযোগ উঠেছে, ভবিষ্যতে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ছক কষেছেন বিএনপি-জামাত পন্থী শিক্ষকরা। এতে নিজেদের ভোটের পাল্লা ভারি করতে শিক্ষার্থীদের সাথে অন্যায় করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি পাওয়া আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদেরও কাছে টানছেন তারা। এরই অংশ হিসেবে সাধারণ শিক্ষকদের নাম করে গুটিকয়েক শিক্ষক নিয়ে করা মিটিং এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফয়েজ আহমদকে কারাবরণ-শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত করা এবং পর্দা নিয়ে হেনস্তার অভিযোগে শাস্তি প্রাপ্ত আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বাদশা মিয়াকে।
এদিকে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে স্বৈরাচার সরকারের আমলে আওয়ামীপন্থী নীল দলের পদধারী নেতা ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জনি মিয়াকে রাখা হয়েছে। তিনি নবগঠিত সাধারণ শিক্ষক পরিষদ কমিটির ১৫ নং সদস্য। এই শিক্ষক আওয়ামীলীগ আমলে নীল দলের অনুষদ ভিত্তিক কমিটির সদস্য ছিলেন। ফেসবুকে আওয়ামীলীগ ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের পক্ষে লেখালেখি করতেন নিয়মিত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মকান্ডে। ৩রা ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে WE ALL ARE SHEIKH HASINA’S MEN ফটো ফ্রেমে একটা প্রোফাইল ফটো আপলোড করেন এই শিক্ষক। তবে জুলাই বিপ্লবের পর এসব পোস্ট আর দেখা যায়নি এই শিক্ষকের আইডিতে।
পাশাপাশি আওয়ামী পন্থী শিক্ষকদের আরেক সংগঠন স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সদস্য বর্তমান সিএসটিই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো: কামাল উদ্দিনও এ কমিটির সদস্য হয়েছেন। ১০ই জানুয়ারী ২০২৩ সালে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের পক্ষ থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে ফুল দিতেও দেখা যায় তাকে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে উল্লেখযোগ্য অবদান আছে এমন শিক্ষককেও বাদ দেওয়া হয়েছে নবগঠিত সাধারণ শিক্ষক পরিষদ থেকে।
এছাড়া কমিটির বিষয়ে অবগত না করেই ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বেল্লাল হোসাইন এর নাম নাম রাখা রয়েছে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট এ অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষক পরিষদের কমিটিতে। তিনি বলেন, “আমি অনলাইন মিটিং ছিলাম না৷ সেখানে কি কথা হয়েছে সে সম্পর্কেও কিছু জানি না। মিটিং এর পর আমাকে জানানো হয় যে আমাকে শিক্ষক পরিষদে রাখা হয়েছে।”
এ বিষয়ে সাধারণ শিক্ষক পরিষদের সদস্য ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল কাইয়ুম মাসুদ জানান, আমরা শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের আগে একটি অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বকারী সাধারণ শিক্ষক পরিষদ গঠন করেছি। এটি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। শুধুমাত্র শিক্ষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই সংগঠন কাজ করবে। অনলাইনে করা জুমে প্রায় ৮২ জন শিক্ষক অংশগ্রহন করেছেন।
আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের অংশগ্রহণের বিষয়ে উক্ত শিক্ষক নেতা বলেন, প্রোগ্রামে সকল শিক্ষকের অংশগ্রহনের সুযোগ ছিলো। যেহেতু এটি শিক্ষকদের প্লাটফর্ম, আমরা কাউকে বাধা দিতে পারি না। আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বাদশা মিয়া সাময়িক সময়ের জন্য বহিষ্কার হলেও তিনি একজন শিক্ষক। তাই উনাকেও কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে এপ্লাইড ম্যাথ বিভাগের চেয়ারম্যান ও জামায়াত পন্থী শিক্ষক নেতা সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন বলেন, শিক্ষক সমিতি যেহেতু নাই তাই শিক্ষকদের স্বার্থ রক্ষার্থে সাধারণ শিক্ষক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। শিক্ষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে আমাদের প্রায় সময় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করতে হয়৷ তখন আমরা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তাই শিক্ষকদের সংগঠন হিসেবে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষক পরিষদ কাজ করে যাবে।
এ বিষয়ে নোবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইসমাইল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য প্রশাসনের দরজা সবসময় খোলা। তারা যে কোনো সময় তাদের দাবি-দাওয়া প্রশাসনের কাছে পেশ করতে পারে। এক্ষেত্রে কেউ চাইলে ব্যক্তি হিসেবে চাইলে তুলে ধরতে পারে আবার সম্মিলিতভাবেও তুলে ধরতে পারে। সাধারণ শিক্ষক পরিষদ যেহেতু প্রশাসনের অংশ নয় তাই এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।