নাটোরের গত এক মাসে চার উপজেলায় বিএনপি ও জামায়াতের ৯ নেতা-কর্মী ও সমর্থককে পিটিয়ে, কুপিয়ে, হাত-পায়ের রগ কেটে, গুলি করে গুরুতর জখম করা হয়েছে। বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার নয়টি ঘটনার ছয়টি ঘটেছে নলডাঙ্গা উপজেলায়। বাকি তিনটি নাটোর সদর, সিংড়া ও লালপুর উপজেলার। আহতদের মধ্যে পাঁচজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাকিরা বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এক বিএনপি নেতার শরীরে তিনটি গুলি লেগেছে। দুজনের হাত–পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়েছে। বাকি ছয়জনের হাত-পা ভেঙে দিয়েছে মুখোশধারীরা। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বিএনপি ও দুজন যুবদলের নেতা। বাকি ছয়জন জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী ও সমর্থক।
একই কায়দায় হামলার শিকার হয়ে খুন হন রাজশাহী মহানগরের জামায়াত কর্মী ডা. কাজেম আলী ও পল্লী চিকিৎসক এরশাদ আলী দুলাল, রংপুরে জামায়াত নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহবুবার রহমান। অপরদিকে নওগাঁয় ইউপি কার্যালয়ে ঢুকে চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমানকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। হামলার সময় তারা হেলমেট ও মাস্ক পরা ছিলো বলে জানায় প্রত্যক্ষদর্শীরা। এছাড়াও গত দুই মাসে রানীনগর ও আত্রাই উপজেলায় বিএনপির চার নেতা-কর্মীকে কুপিয়ে জখমের ঘটনা ঘটে।
বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটলেও গত রোববার দুটি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। হামলার শিকার দুই ব্যক্তি বাদী হয়ে মামলা দুটি করেছেন। মামলায় কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। এসব হামলা-মামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হননি।
আহত নেতা-কর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এবং সব কটি ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কখনো দিনে, কখনো রাতে পথ রোধ করে মুখোশধারীরা হামলা চালিয়েছে। সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে হাত-পা, কেটে দেওয়া হয়েছে রগ, করা হয়েছে গুলি। নয়জনের ওপর পৃথকভাবে নয়টি হামলার সময় লোহার রড, চায়নিজ কুড়াল ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় সব কটিতে মুখোশধারীরা ছিল।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, স্থানীয়ভাবে তাঁদের কারও সঙ্গে বিরোধ নেই। রাজনৈতিক কারণেই হামলাগুলো হয়েছে। পুলিশের নীরব ভূমিকার কারণে অপরাধীরা ধরা পড়ছে না। তবে পুলিশ বলছে, তারা নিজেদের মতো করে তদন্ত করছে।
পুলিশ, ভুক্তভোগী নেতা-কর্মী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৬ অক্টোবর রাত আটটায় নাটোরের নলডাঙ্গায় প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে। নলডাঙ্গা জামায়াতে ইসলামীর পৃষ্ঠপোষক ও অর্থ জোগানদাতা নাসির উদ্দিন সরকার (৬৫) মোটরসাইকেলে নলডাঙ্গা বাজার থেকে নিজ বাড়ি বাঁশিলায় ফিরছিলেন। মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন জামায়াতের কর্মী ও ইসলামি বক্তা আবু নওশাদ নোমানী (৪২)। নাসির উদ্দিন ছিলেন পেছনে। তাঁরা সোনাপাতিল–তালতলায় পৌঁছালে মুখোশধারী ছয়-সাতজন মোটরসাইকেলটির পথ আগলে দাঁড়ায়। রড দিয়ে দুজনকে বেধড়ক পিটিয়ে অচেতন করে ফেলে রেখে যায়। পরের ঘটনাটি ঘটে ২৫ অক্টোবর রাত পৌনে নয়টার দিকে। নসরতপুর বাজার থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় রাস্তায় পিটিয়ে জখম করা হয় জামায়াতের কর্মী ও পল্লিচিকিৎসক আলাউদ্দিনকে (৬০)। পরদিন ২৬ অক্টোবর রাতে হামলা হয় আরেক পল্লিচিকিৎসকের ও নলডাঙ্গা উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ফজলুর রহমানের (৬৫) ওপর। তাঁর হাত-পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়।
২৯ অক্টোবর সকালে বিএনপির অবরোধ চলাকালে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম (৪২)। যুবলীগের একটি মিছিল থেকে দুর্বৃত্তরা তাঁকে ধাওয়া করে গুলি করে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এ সময় দুর্বৃত্তদের মুখে কোনো মুখোশ ছিল না। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সাইফুল ইসলাম এখনো রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
৩০ অক্টোবর রাতে নলডাঙ্গার খাজুরা ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মোশারফ হোসেনকে (৭৪) বাড়ি থেকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে হাত-পা ভেঙে সড়কের পাশে ফেলে দেওয়া হয়। ৩ নভেম্বর রাতে লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া বাজারে দোকান বন্ধ করে বাড়িতে ফেরার পথে বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ সরকারকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে ১০ কিলোমিটার দূরে গোপালপুর মহিলা কলেজের পাশে নিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। পরে তাঁর হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। ১০ নভেম্বর দুপুরে জুমার নামাজ শেষে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে সিংড়ার সাতারদীঘি ইউনিয়ন জামায়াতের সেক্রেটারি আবদুর রাজ্জাককে (৭০) পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়।
আবদুর রাজ্জাককে পেটানোর ঘটনা ঘটেছিল সিংড়া উপজেলার কালীগঞ্জে। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এক ব্যক্তি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যক্তি বলেন, একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে মোটরসাইকেলের পথ আগলে দাঁড়ায়। মাইক্রোবাস থেকে ছয়–সাতজন নেমে মোটরসাইকেল চালকের (আবদুর রাজ্জাক) চোখ বেঁধে ফেলে। তারপর তাঁকে গাড়িতে তুলে চলে যায় তারা।
সর্বশেষ ১২ নভেম্বর নলডাঙ্গায় এক যুবদল নেতাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে হাতুড়িপেটা করে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রাত সাড়ে আটটার দিকে উপজেলার রামশাকাজীপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী সজীব হোসেন (৩২) বিপ্রবেলঘরিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড শাখা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক।
হামলায় আহত নয়জনের মধ্যে সাইফুল ইসলাম, মাসুদ সরকার, আবদুর রাজ্জাক ও সজীব হোসেন-চারজন এখনো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন ফজলুর রহমান।
গত ১৬ অক্টোবর প্রথম হামলার শিকার হয়েছিলেন নাসির উদ্দিন। ঘটনার ২৮ দিনের মাথায় গত রোববার তাঁর অভিযোগটি মামলা হিসেবে নিয়েছে পুলিশ। নাসির উদ্দিন বলেন, তিনি সক্রিয় রাজনীতি করেন না, তবে জামায়াতের সমর্থক। রাজনৈতিক আক্রোশে তাঁর ওপর হামলা হয়েছে বলে ধারণা করেন তিনি। পল্লিচিকিৎসক আলাউদ্দিন বলেন, তাঁর সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। জামায়াত করেন বলেই রাতের আঁধারে হামলা করে ভয় দেখানো হয়েছে। তাঁর মেয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। শুরুতে নিতে না চাইলেও পরে পুলিশ মামলাটি রেকর্ড করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে নলডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম বলেন, পুলিশের ওপর আস্থা না থাকলে ভুক্তভোগীরা আদালতে যেতে পারেন। আদালতে মামলা করলে অন্য সংস্থাকে দিয়েও তো তদন্ত করা যায়।
সিংড়া থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, কালীগঞ্জের একজনের ঘটনা লোকমুখে শুনেছি। কেউ অভিযোগ দেয়নি। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। গোপনে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
নাটোর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব রহিম নেওয়াজ বলেন, পুলিশ দুর্বৃত্তদের কাউকে এখনো শনাক্ত করেনি। গ্রেপ্তার করবে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি প্রশাসনের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখেন, ভুক্তভোগী মামলা করতে না পারলে পুলিশ কি হামলাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারে না?
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাটোরের পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, অনেকগুলো ঘটনা। তিনি খোঁজখবর নিয়ে জানাতে পারবেন।
কেন এই হামলা-জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙে পড়েন গুলিবিদ্ধ বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, কারও সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ নেই। এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তাঁর বাড়ির সামনেই ঘটনাটি ঘটে। তাঁর মা ও কিশোর ছেলেও সামনেই ছিল তখন। ঘটনার ভয়াবহতায় তাঁর বৃদ্ধ মা এখনো স্বাভাবিক হতে পারছেন না।