ঢাকা ০২:১৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুনামগঞ্জে চোখের সামনেই কোটি টাকার মাছ লুটের হিড়িক

সুনামগঞ্জের দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ উপজেলায় ঘোষণা দিয়ে ইজারাকৃত বৈধ জলমহালের কোটি কোটি টাকার মাছ লুটের হিড়িক পড়েছে। মাইকে ঘোষণা দিয়ে প্রশাসনের সামনেই দিনে-দুপুরে আনন্দ-উল্লাস করে হাজারো মানুষ মাছ লুট করে করতে নেমে পড়েছে বিলে।

মাছ শিকারের মাইকিং শুনে আশপাশের কয়েক ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের হাজারো জনতা জলমহালের কয়েক কোটি টাকার মাছ ধরে নিয়ে গেছে। পূর্ব ঘোষণা দিয়ে বৈধ বিলগুলোতে লুট চালালেও প্রশাসন অসহায়। এমন ঘটনায় আতঙ্কিত হাওর অঞ্চলের জলমহাল ইজারাদার ও সংশ্লিষ্টরা।

জেলার তিন উপজেলায় এক সপ্তাহে লুট হয়েছে দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ উপজেলা ১২ জলমহাল। জলমহালগুলো হলো- কামান বিল, হাতনী বিল, বারোঘর বিল, চনপইট্টা বিলের, লাইরা-দীঘা বিল ও বেতইরা বিল ও ভাটিগাং বিল, জোয়ারিয়া বিল, মেধা বিল, বাইল্লা বিলসহ প্রায় ১২টি বিলের মাছ লুটে নেয়া হয়েছে। এসব জলমহাল থেকে মাছ লুটের ঘটনায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ইজারাদারদের।

সর্ব প্রথম ২৮ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) সকালে দিরাই উপজেলার কামান বিলের মাছ জোর করে ধরে নেয় কয়েক হাজার মানুষ। এর পরদিন শনিবার আবারও বিভিন্ন যানবাহনে করে এসে মাছ লুটপাট চালায় বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মানুষজন।

ধারাবাহিকভাবে শনিবার ও রোববার সকালে শাল্লা সদর বাহাড়া ইউনিয়নের যাত্রাপুর গ্রাম সংলগ্ন জোয়ারিয়া বিলের মাছ জোরপূর্বক ধরে নেয় কয়েক গ্রামের মানুষ। এছাড়া রবিবার (২ মার্চ) সকালে দিরাই উপজেলার মেঘনা-বারোঘর জলমহালের একটি বিল ও একই উপজেলার হাতনী বিল জোর করে মাছ ধরে নেয় বিলের আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ।

এরপর সোমবার দিরাই উপজেলার কাশীপুর লাইরা দীঘা গ্রুপ ফিসারীর এলংজুরি ও আলীপুর গ্রামের পেছনের লাইরা-দীঘা ও চনপইট্টা বিলের পাইলের (অভয়ারণ্য সৃষ্টি করে মাছ বড় করা) প্রায় কোটি টাকার মাছ ধরে নেয় বিলের আশপাশ এলাকার কয়েক হাজার মানুষ।

পরেরদিন মঙ্গলবার (৪ মার্চ) শাল্লা উপজেলার আটগাঁও গ্রামের কাছের কাশীপুর লাইরা দীঘা গ্রুপ ফিসারীর সতোয়া নদীর মাছ লুট করে দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ১০-১৫ টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। মঙ্গলবার সকালে একই উপজেলার কাশীপুর গ্রামের কাছের বাইল্লা বিল ও ইয়ারাবাদ গ্রামের কাছের বড়গাঁও-ইয়ারাবাদ গ্রুপ জলমহালের ভাটিগাং বিল লুটপাট করে স্থানীয় লোকজন।

বুধবার (৫ মার্চ) সকালে দিরাই উপজেলার কেজাউরা গ্রামে মেধা বিলও বেতইরা জলমহালে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার মানুষ মাছ ধরার পলো, জালসহ নানা উপকরণ নিয়ে নেমে পড়েন। এতে অংশ নেয় পুরষের পাশাপাশি নারী-শিশু-কিশোরাও।

তবে পুলিশ প্রশাসনের লোকজন তাদের বাধা ও অনুরোধ করলেও তাতে কোন লাভ হয়নি। জোরপূর্বক লুটপাট চালায়। সর্বশেষ শুক্রবার (৭ মার্চ) দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের কাউয়াজুরি বলগাডুবি জলমহালের মাছ লুট হয়। এদিন শল্লা উপজেলার সতোয়া জলমহালের মাছ লুটের চেষ্টা করা হয়।

খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বাধা দিলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় মাছ ধরতে আসা জনতা জলমহাল ইজারাদারদের দুইটি ছাউনি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। যদিও পরে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং স্থানীয়দের যৌথ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনা হয়।

জোয়ারিয়া বিলের ইজারাদার যাত্রাপুর হিলিপ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি হিমাদ্রী সরকার বলেন, “বিলে বাঁশ-কাঠা দেওয়া, পাহারাদার রাখাসহ প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আগামী বছর মাছ ধরার কথা ছিল কিন্তু জোর করে দুই দিন মাছ ধরে অর্ধকোটি টাকার ক্ষতি করা হয়েছে।”

সুনামগঞ্জ জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, “দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জে জলমহাল লুট করার সাথে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ জড়িত। তাজাড়া পলো, টেঁটা, কুচ দিয়ে সংঘবদ্ধভাবে মাছ ধরতে আসে। এসব জলমহাল সরকারি ইজারার আওতায়। এই জলমহালগুলো লুটের কারণে আগামীতে ইজারা প্রদানে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিবে। এর ফলে দেশ গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। এতে দেশের উন্নয়নমূলক কাজ বিঘ্নিত হবে। যারা এই কাজের সাথে জড়িত তারা নিজেদের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। আমি অনুরোধ করব তারা যেনো এসব কাজ থেকে বিরত থাকেন। ক্ষতিগ্রস্ত ইজারাদাররা যদি আইনী পদক্ষেপ নেন তাহলে আমি আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে অনুরোধ করবো যেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।”

 

জনপ্রিয় সংবাদ

সুনামগঞ্জে চোখের সামনেই কোটি টাকার মাছ লুটের হিড়িক

আপডেট সময় ০৮:০১:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ মার্চ ২০২৫

সুনামগঞ্জের দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ উপজেলায় ঘোষণা দিয়ে ইজারাকৃত বৈধ জলমহালের কোটি কোটি টাকার মাছ লুটের হিড়িক পড়েছে। মাইকে ঘোষণা দিয়ে প্রশাসনের সামনেই দিনে-দুপুরে আনন্দ-উল্লাস করে হাজারো মানুষ মাছ লুট করে করতে নেমে পড়েছে বিলে।

মাছ শিকারের মাইকিং শুনে আশপাশের কয়েক ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের হাজারো জনতা জলমহালের কয়েক কোটি টাকার মাছ ধরে নিয়ে গেছে। পূর্ব ঘোষণা দিয়ে বৈধ বিলগুলোতে লুট চালালেও প্রশাসন অসহায়। এমন ঘটনায় আতঙ্কিত হাওর অঞ্চলের জলমহাল ইজারাদার ও সংশ্লিষ্টরা।

জেলার তিন উপজেলায় এক সপ্তাহে লুট হয়েছে দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ উপজেলা ১২ জলমহাল। জলমহালগুলো হলো- কামান বিল, হাতনী বিল, বারোঘর বিল, চনপইট্টা বিলের, লাইরা-দীঘা বিল ও বেতইরা বিল ও ভাটিগাং বিল, জোয়ারিয়া বিল, মেধা বিল, বাইল্লা বিলসহ প্রায় ১২টি বিলের মাছ লুটে নেয়া হয়েছে। এসব জলমহাল থেকে মাছ লুটের ঘটনায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ইজারাদারদের।

সর্ব প্রথম ২৮ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) সকালে দিরাই উপজেলার কামান বিলের মাছ জোর করে ধরে নেয় কয়েক হাজার মানুষ। এর পরদিন শনিবার আবারও বিভিন্ন যানবাহনে করে এসে মাছ লুটপাট চালায় বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মানুষজন।

ধারাবাহিকভাবে শনিবার ও রোববার সকালে শাল্লা সদর বাহাড়া ইউনিয়নের যাত্রাপুর গ্রাম সংলগ্ন জোয়ারিয়া বিলের মাছ জোরপূর্বক ধরে নেয় কয়েক গ্রামের মানুষ। এছাড়া রবিবার (২ মার্চ) সকালে দিরাই উপজেলার মেঘনা-বারোঘর জলমহালের একটি বিল ও একই উপজেলার হাতনী বিল জোর করে মাছ ধরে নেয় বিলের আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ।

এরপর সোমবার দিরাই উপজেলার কাশীপুর লাইরা দীঘা গ্রুপ ফিসারীর এলংজুরি ও আলীপুর গ্রামের পেছনের লাইরা-দীঘা ও চনপইট্টা বিলের পাইলের (অভয়ারণ্য সৃষ্টি করে মাছ বড় করা) প্রায় কোটি টাকার মাছ ধরে নেয় বিলের আশপাশ এলাকার কয়েক হাজার মানুষ।

পরেরদিন মঙ্গলবার (৪ মার্চ) শাল্লা উপজেলার আটগাঁও গ্রামের কাছের কাশীপুর লাইরা দীঘা গ্রুপ ফিসারীর সতোয়া নদীর মাছ লুট করে দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ১০-১৫ টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। মঙ্গলবার সকালে একই উপজেলার কাশীপুর গ্রামের কাছের বাইল্লা বিল ও ইয়ারাবাদ গ্রামের কাছের বড়গাঁও-ইয়ারাবাদ গ্রুপ জলমহালের ভাটিগাং বিল লুটপাট করে স্থানীয় লোকজন।

বুধবার (৫ মার্চ) সকালে দিরাই উপজেলার কেজাউরা গ্রামে মেধা বিলও বেতইরা জলমহালে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার মানুষ মাছ ধরার পলো, জালসহ নানা উপকরণ নিয়ে নেমে পড়েন। এতে অংশ নেয় পুরষের পাশাপাশি নারী-শিশু-কিশোরাও।

তবে পুলিশ প্রশাসনের লোকজন তাদের বাধা ও অনুরোধ করলেও তাতে কোন লাভ হয়নি। জোরপূর্বক লুটপাট চালায়। সর্বশেষ শুক্রবার (৭ মার্চ) দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের কাউয়াজুরি বলগাডুবি জলমহালের মাছ লুট হয়। এদিন শল্লা উপজেলার সতোয়া জলমহালের মাছ লুটের চেষ্টা করা হয়।

খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বাধা দিলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় মাছ ধরতে আসা জনতা জলমহাল ইজারাদারদের দুইটি ছাউনি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। যদিও পরে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং স্থানীয়দের যৌথ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনা হয়।

জোয়ারিয়া বিলের ইজারাদার যাত্রাপুর হিলিপ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি হিমাদ্রী সরকার বলেন, “বিলে বাঁশ-কাঠা দেওয়া, পাহারাদার রাখাসহ প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আগামী বছর মাছ ধরার কথা ছিল কিন্তু জোর করে দুই দিন মাছ ধরে অর্ধকোটি টাকার ক্ষতি করা হয়েছে।”

সুনামগঞ্জ জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, “দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জে জলমহাল লুট করার সাথে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ জড়িত। তাজাড়া পলো, টেঁটা, কুচ দিয়ে সংঘবদ্ধভাবে মাছ ধরতে আসে। এসব জলমহাল সরকারি ইজারার আওতায়। এই জলমহালগুলো লুটের কারণে আগামীতে ইজারা প্রদানে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিবে। এর ফলে দেশ গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। এতে দেশের উন্নয়নমূলক কাজ বিঘ্নিত হবে। যারা এই কাজের সাথে জড়িত তারা নিজেদের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। আমি অনুরোধ করব তারা যেনো এসব কাজ থেকে বিরত থাকেন। ক্ষতিগ্রস্ত ইজারাদাররা যদি আইনী পদক্ষেপ নেন তাহলে আমি আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকে অনুরোধ করবো যেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।”