ক্রিকেটের জোয়ার শুরুর আগপর্যন্ত ফুটবলই ছিল দেশের প্রধান খেলা। ফুটবল ম্যাচ মানেই গ্যালারিতে উপচেপড়া দর্শক। আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথ হলে তো কথা-ই নেই। দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর হাই-ভোল্টেজ লড়াইয়ের দিনটি রূপ নিতো অলিখিত জাতীয় দিবসে। অলিগলির সব পথ এসে যেন মিশে যেত ময়দানে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের লিগেও নিয়মিত খেলতে যেতেন ফুটবলাররা। তবে সেসব অতীত হয়ে গেছে অনেক আগেই। ফুটবলের ক্রেজটা দখলে নেয় বাইশগজের ক্রিকেট। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর থেকেই জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে ক্রিকেটের।
২০০৪ সালে মুলতান টেস্টে জিততে জিততে বাংলাদেশ হেরে গেলেও সমর্থকদের মন জিতে নিয়েছিল ঠিকই। ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ক্রিকেট পরাশক্তির বিপক্ষে জয়ের রোমাঞ্চ দেশজুড়ে ক্রিকেটের জোয়ার ডেকে এনেছিল যেন। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার পর এশিয়ার নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতবে বলে একটা সময় বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের। অথচ কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন দূরে থাক এখন যেন কেবল ডুবছেই।
চলতি মাসেই (১০ নভেম্বর) টেস্ট ক্রিকেটে দুই যুগ পার করে ফেলেছে বাংলাদেশ। দীর্ঘ পথচলায় এখন পর্যন্ত মোট ১৪৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে টাইগাররা। এর মধ্যে জয় পেয়েছে মাত্র ২১টিতে, হেরেছে ১০৮টি এবং ড্র করেছে ১৯টি। টি-টোয়েন্টিটা কখনোই সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে এই ফরম্যাটে যাত্রা শুরুর পর এখন পর্যন্ত ১৭৯টি ম্যাচ খেলে ফেলেছে বাংলাদেশ। ৬৮ জয়ের বিপরীতে হার ১০৭টি।
অন্য দুই ফরম্যাটের তুলনায় কিছুটা গর্বের জায়গা ছিল ওয়ানডে। বাইশগজে বাংলাদেশের হাতেগোনা যে কয়েকটি সাফল্য এসেছে, সিংহভাগই এই ফরম্যাটে। একদিনের ক্রিকেটে ৪৪১ টি ম্যাচে জয় ১৬০টিতে। আর পরাজয় ২৭১টিতে। অবশ্য গেল কয়েক বছর ধরে এই ফরম্যাটেও স্বস্তি নেই খুব একটা। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর চলতি বছরে ৩ জয়ের বিপরীতে সমান সংখ্যক ম্যাচে হেরেছে বাংলাদেশ। সদ্য সমাপ্ত আফগানিস্তান সিরিজেও ২-১ ব্যবধানে হারতে হয়েছে।
নাজমুল হাসান পাপনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) নিয়ে অভিযোগের অন্ত ছিল না। ক্রিকেটারদের ব্যর্থতায় ঘুরে ফিরে উঠে আসতো পাপন-নান্নু-হাথুরুদের নাম। দেশের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর রদবদল এসেছে ক্রিকেট বোর্ডে। বিসিবির নেতৃত্বভার পেয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার, অধিনায়ক এবং একসময়ের প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব সামলানো ফারুক আহমেদ। এ ছাড়া যুক্ত হয়েছেন দেশবরেণ্য ক্রিকেট কোচ ও সংগঠক নাজমুল আবেদীন ফাহিম। তাদের নেতৃত্বে নতুন আশা দেখছেন সবাই। যদিও নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণের পর এখন পর্যন্ত খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায়নি। না মাঠে না মাঠের বাইরে।
পাকিস্তানের মাটিতে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ জয় বাদ দিলে ‘নতুন বাংলাদেশে’ ব্যর্থতাই সঙ্গী। ভারতের মাটিতে দুই ফরম্যাটে হোয়াইটওয়াশের পর ঘরের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার তুলনামূলক কম অভিজ্ঞ দলের বিপক্ষেও চিত্রটা বদলায়নি। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির হতাশা ঝেড়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত সিরিজে কোনো রকমে হোয়াইটওয়াশ এড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিপরীতে আফগানরা যে যোগ্য দল হিসেবেই সিরিজ জিতেছে এ নিয়ে দ্বিমত থাকবে না কারোরই। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের এমন বিপর্যয় মেনে নিতে পারছেন না ভক্ত সমর্থকরা। এরই সঙ্গে টানা চারটি সিরিজ হারলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এম এম কায়সার। ক্রীড়া সাংবাদিকতায় বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে এখন সম্পাদক হিসেবে হিসেবে আছেন স্পোর্টস বাংলায়। ক্রিকেটপ্রেমীদের ক্রিকেটে আগ্রহ কমে যাওয়া নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে বলেন, যে কোনো খেলায় সাফল্যই শেষ কথা। আপনি সাফল্য পেলে মানুষ আগ্রহী হবে। সম্পৃক্ত থাকতে চাইবে। মাঠের খেলায় মানুষ সাফল্য খোঁজে। সাফল্যের অংশীদার হতে চায়। আপনি যখন জয় থেকে দূরে সরে যেতে থাকবেন তখন মানুষের মধ্যে ডিপ্রেশন চলে আসে। ভক্ত-সমর্থকরা হতাশ হয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে এখন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
মাঠের ব্যর্থতার নেপথ্যে নিম্নমানের ঘরোয়া লিগ এবং অবকাঠামোগত বিষয়কে দুষছেন জ্যেষ্ঠ এই ক্রীড়া সাংবাদিক। বলছিলেন, আমরা কেন ধারাবাহিকভাবে অধারাবাহিক, এটার জন্য আপনাকে তাকাতে হবে ঘরোয়া ক্রিকেট এবং অবকাঠামোগত দিকে। আপনি ক্লাস টেন পাশ না করে ইন্টারমিডিয়েটে উঠে গেলে তো সমস্যা হবেই। ঘরোয়া ক্রিকেটে সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েই আপনাকে জাতীয় দলে আসতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে হয় উল্টোটা। আর ঘরোয়ার মানও খুব একটা ভালো না। যে উইকেটে খেলা হচ্ছে এটা কম্পিটিটিভ না। আর জাতীয় দলের ক্রিকেটাররাও ঘরোয়াতে খেলা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখান না। অথচ ভারতের বর্তমান দলের সবচেয়ে সিনিয়র দুজন ক্রিকেটার রোহিত শর্মা বিরাট কোহলিদের খারাপ ফর্মের সময়ে ঘরোয়াতে খেলতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ব্যর্থতা কাটাবে কোথায়?
নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব নেওয়ার পর বিসিবিতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন নেই বলেও মনে করেন জ্যেষ্ঠ এই ক্রীড়া সাংবাদিক। তিনি বলেন, আমি অন্তত এখনো তেমন কোনো পরিবর্তন দেখছি না। আমাদের এখানে সমস্যা হচ্ছে, যিনি নেতা হন, তিনিই একাই সব দিক দেখেন। তাহলে বাকি যারা আছে তারা কি যোগ্য না? নাকি তাদের সেভাবে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। বোর্ড সঠিকভাবে পরিচালনা করতে চাইলে সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এখন উনি (ফারুক) কেমন পরিকল্পনা করছেন সেটা হয়তো তিনিই ভালো জানেন।
নাজিব সুগান নামের এক শিক্ষার্থী বোর্ড ও ক্রিকেটারদের দায় দিলেন। তার মতে, বাংলাদেশের দর্শকের একটি অংশ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের আমরা এখন আর আগের মতো আগ্রহে ভরে বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখার সেই টান পাই না। অথচ রাত জেগে বিদেশি ক্লাব ফুটবল দেখি। আগ্রহ হারানোর পেছনে দায়ভার নিতে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং ক্রিকেটারদেরই।
বাংলাদেশের বাজে পারফরম্যান্সের কারণে ক্রিকেট নিয়ে সমর্থকদের আগ্রহ কমছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বিসিবি পরিচালক নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলছিলেন, ‘সমর্থকদের আগ্রহ কমেনি। জিনিসটা হলো সমর্থকরা অসন্তুষ্ট কিছুটা, তবে সেটা খুব স্বাভাবিক। দল যদি ভালো না করে জাতীয় দল যদি আফগানিস্তানের সাথেও সিরিজ হারে তাহলে সমর্থকরা অখুশি থাকবে সেটা খুব স্বাভাবিক। একটা দুইটা ম্যাচ হারতেই পারে। আফগানিস্তানের সাথে সিরিজ জিতবে সেরকম শক্তি আমাদের হওয়া উচিত। সেটা তাদের অসন্তোষের কারণ হতে পারে।’
মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিলে বিজ্ঞাপনী বাজারে নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ নিয়ে বিসিবি পরিচালক বলেন, ‘দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নেবে না। দর্শকরা সমালোচনা করবে আরো বেশি যা স্বাভাবিক। আমার মনে হয় না আমাদের দর্শকরা সে রকম এবং এটা সত্য ভালো করলে ভালো মার্কেট হবে খারাপ করলে মার্কেট খারাপ হবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। জাতীয় দল ভালো করলে জাতীয় দলের মার্কেট ভালো থাকবে। ক্রিকেট বোর্ডের মার্কেট ভালো থাকবে।’