সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো দুই বছর ধরে ভারতীয় চিনি চোরাচালানের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে। ট্রাকে ট্রাকে এসব চিনি সিলেট নগরে ঢোকে। এরপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় গোটা দেশে। এতে অনেক চক্র জড়িত। এসব চক্রের হোতা ছিলেন ছাত্রলীগ চার নেতা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তারা এখন লাপাত্তা।
চোরাকারবারিদের দেওয়া তথ্যমতে, সীমান্তের শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে ‘বুঙ্গার চিনি’ হিসেবে পরিচিত ভারতীয় চিনি বাংলাদেশে ঢোকে। সিলেট থেকে এসব চিনি নিরাপদে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে ছাত্রলীগের চার নেতা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন। তারা হলেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ, মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নাঈম আহমদ এবং সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সিলেট সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রুহেল আহমদ।
জানা গেছে, সিলেটের জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলার সীমান্তবর্তী শতাধিক স্থান দিয়ে চিনিসহ চোরাই পণ্য সিলেটে ঢোকে। সাধারণত শুকনো মৌসুমে হাঁটাপথে বা মোটরসাইকেলে এবং বর্ষায় নৌকাযোগে পণ্য সীমান্তে আনা হয়। এতে সীমান্ত এলাকার অন্তত এক হাজার চোরাকারবারি সম্পৃক্ত। পরবর্তী সময়ে সীমান্ত এলাকা থেকে এসব চিনি ট্রাকে করে নিরাপদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর কাজটিই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সমন্বয় করতেন ছাত্রলীগের ওই চার নেতা।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ৩০ আগস্ট সিলেটের পুলিশ সুপার পদে যোগ দিয়েছেন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তিনি গতকাল রোববার বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। আগের বিষয় নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে এখন থেকে যে বা যারা চোরাচালানে জড়িত থাকবেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যে দলেরই হোক না কেন, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’
গোয়াইনঘাট উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী সোনাটিলা গ্রাম। গ্রামটির ঝোপঝাড়বেষ্টিত উঁচুনিচু টিলা বেয়ে কিছুক্ষণ পরপর বাংলাদেশে ঢুকছেন কয়েকজন নারী-পুরুষ। তাদের কারও মাথায় চিনির বস্তা, কারও মাথায় পণ্যসামগ্রীর বোচকা। সীমান্ত দিয়ে আনা চিনির বস্তা মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকে আশপাশের বাড়ি ও দোকানে মজুত করা হচ্ছে। পরে সড়ক ও নৌপথে সেই চিনি যাচ্ছে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সরেজমিনে চার দিন সিলেটের তিনটি উপজেলার বিভিন্ন সীমান্তবর্তী গ্রাম ঘুরে চোরাচালানের এমন চিত্র দেখা যায়।
চোরাকারবারি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার চিনি আসে। এসব চিনি তামাবিল-জৈন্তাপুর-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ভোলাগঞ্জ-কোম্পানীগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে নগরের পাইকারি বাজার কালীঘাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। অভিযুক্ত চার ছাত্রলীগ নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের অনুসারীরা পাহারা দিয়ে প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত চোরাই চিনির ট্রাক শহরে ঢোকাতেন।
সূত্র জানায়, শহরে নির্বিঘ্নে চোরাই চিনি প্রবেশ করাতে ট্রাকপ্রতি গড়ে পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা কারবারিদের দিতে হতো। এতে প্রতি মাসে গড়ে কোটি টাকা টাকা করতেন ছাত্রলীগ নেতারা। ছাত্রলীগের চার নেতা ছাড়াও যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের আরও কয়েকজন নেতা একইভাবে কারবারিদের সহায়তা করতেন।
সীমান্তের একাধিক বাসিন্দা জানান, অসাধু ব্যবসায়ীরা কম দামে চিনি কিনে ছাত্রলীগের প্রহরায় সড়ক ও নৌপথে নগরের কালীঘাটসহ সিলেটে নিয়ে যেতেন। পরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিনি পাঠানো হতো। কালীঘাট এলাকার দুজন ব্যবসায়ী জানান, ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর কারবারিরা অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। চোরাচালানের হোতা ছাত্রলীগ নেতারাও আত্মগোপনে চলে যান। এতে পাচার অনেকটা কমে যায়। আগে প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ ছোট-বড় ট্রাকে চিনি কালীঘাটে আসত। এসব ট্রাকে গড়ে ৫০ কেজির ৬০ থেকে ১৩০ বস্তা চিনি থাকত। এ ছাড়া কালীঘাটঘেঁষা সুরমা নদী দিয়েও প্রতিদিন কয়েক শ বস্তা চিনি আসত।
সীমান্তের বাসিন্দা ও চোরাচালানে সম্পৃক্ত অন্তত ১৬ জন জানান, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীর পাশাপাশি জেলার অন্তত ১০ থেকে ১২ জন সাবেক জনপ্রতিনিধি চোরাচালানে জড়িত। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাদের বেশির ভাগই এখন আত্মগোপনে। চিনি পাচারের হোতা হিসেবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ, মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম আহমদ ও সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রুহেল আহমদ। গত বছরের ১৩ আগস্ট ওই চারজনসহ ছাত্রলীগের ৫৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছিলেন আইনজীবী প্রবাল চৌধুরী।
মামলার আরজিতে প্রবাল চৌধুরী অভিযোগ করেন, ফেসবুকে চোরাকারবারি ও অছাত্র দিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের বিষয়ে প্রতিবাদমূলক স্ট্যাটাস দেওয়ার পর অভিযুক্তরা তাকে প্রাণে মারতে গুলি করেন। এতে তিনি আহত হন। মামলায় ওই চার নেতা ছাড়াও সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মিছবাউল করিম, জকিগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুল আলমের নাম উল্লেখ করেন। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি।
অভিযোগের বিষয়ে নাজমুল, রাহেল, নাঈম ও রুহেলের মুঠোফোনে গত শুক্রবার কল করলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন পাওয়া যায়। সরকার পতনের পর তাদের প্রকাশ্যে দেখাও যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, সরকার পতনের পর অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতারা গা ঢাকা দিয়েছেন। তা ছাড়া ছাত্র-জনতা এখনো মাঠে আছেন। সীমান্তে নজরদারিও বেড়েছে। তাই চিনি চোরাচালান আপাতত কিছুটা কমেছে। আবার যেন কেউ চোরাচালান করতে না পারে, সেদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
সূত্র- প্রথম আলো