ছকে বাঁধা জীবনের অনেক কিছুই ওলটপালট করে গেলো ‘আগ্রাসী’ এপ্রিল মাস। তাপদাহে পোড়া মানুষ ‘অচেনা’ এই এপ্রিলকে মনে রাখবে বহুদিন। মাসজুড়ে দেশের ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটারেই ছিল মরুর উষ্ণতা। খরতাপ একে একে ভেঙেছে অতীতের অনেক রেকর্ড। জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে গেল ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া তাপপ্রবাহের এমন রুদ্ররূপ অনেকেই আগে দেখেনি।
এক মাসের প্রবল গরমে জীবন ও সম্পদের হয়ে গেছে বড় ক্ষতি। নিভে গেছে ৯৫ প্রাণ। বিপর্যয়ে পড়েছে কৃষি, নেমেছে পানির স্তর। বেঁকে গেছে রেলপথ, বিটুমিন উঠে এবড়োখেবড়ো সড়ক। অনেকটাই থমকে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। জীবিকা হারান কোটি মানুষ। কমিয়ে দিয়েছে উৎপাদন ক্ষমতা, বেড়েছে অর্থনীতির ঝুঁকি। দীর্ঘমেয়াদি হুমকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। গরমে শুধু যাতায়াত ভাড়াই নয়, নানা খাতে টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরমে যত মানুষের মৃত্যু হয়, এর পুরো ছবি আদতে উঠে আসে না। শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কমে, কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিদ্যুতের ওপর চাপ পড়ে। পরিসংখ্যানে এসব বিষয়ে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। সব মিলিয়ে তাপপ্রবাহ ধীরে ধীরে ‘নীরব ঘাতক’ হয়ে উঠছে। ফলে তাপপ্রবাহকে দ্রুত দুর্যোগ ঘোষণা করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ তাদের।
এপ্রিলে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা থাকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এবার মাসজুড়েই গড়ে সারাদেশে তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রির ওপর। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ১৯৮৯ সালের পর গেল ৩৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তপ্ত দিন ছিল গতকাল। এর আগে ১৯৮৯ সালে বগুড়ায় ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা। চুয়াডাঙ্গায় এদিন থার্মোমিটারের পারদ ওঠে ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলিসিয়াসে। আর ঢাকায় তাপমাত্রা ওঠে ৩৮ দশমিক ৬ ডিগ্রিতে। এর আগে ২০১৪ সালের ২১ মে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা এতদিন দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল। মঙ্গলবার তা ভেঙে গেল। আর স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের নথিভুক্ত ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এবারের এপ্রিলে টানা যতদিন তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা গত ৭৬ বছরে দেখা যায়নি। টানা তাপপ্রবাহ শুরু হয় ১ এপ্রিল থেকে। মঙ্গলবারও তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ফলে ৩০ দিনই তাপপ্রবাহ দেখল বাংলাদেশ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে ১৯৮১ সাল থেকে সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহের উপাত্ত আছে। সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর আগে ২০১০ সালে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ২০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল।
তবে তা টানা ছিল না। এবার তাপপ্রবাহের বিস্তৃতিও ছিল বেশি। এ বছর দেশের ৭৫ শতাংশ এলাকা দিয়ে টানা তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে, যা আগে কখনোই ছিল না।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১৯৮১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বজ্রঝড়ের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবারের এপ্রিলে মাত্র একটি বজ্রঝড় বা কালবৈশাখী হয়েছে। তাও হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলে। আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা প্রকৃতির এ আচরণকে অস্বাভাবিক বলছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ৪৩ বছরে এপ্রিলে ৩৬৫টি বড় বজ্রঝড় হয়। সবচেয়ে বেশি ঝড় হয়েছিল ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে, ১৪টি। আর ১৯৯৯ ও ২০০৯ সালের এপ্রিলে সবচেয়ে কম চারটি করে ঝড় হয়। গত বছরের এপ্রিলে বজ্রঝড় হয়েছিল সাতটি। ২০২২ ও ২০২১ সালে হয় যথাক্রমে ৯টি ও ৮টি।
আবহাওয়াবিদ মো. তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, অন্য বছর সাধারণত এপ্রিলে গড়ে আট দিন বৃষ্টি হয়। এ বছর ছিল ব্যতিক্রম। আবহাওয়া ও জলবায়ুর স্থানীয় ও বৈশ্বিক বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন এবং উষ্ণায়নের কারণেই এমনটা হচ্ছে। এর ছোঁয়া বাংলাদেশের জলবায়ুতেও লেগেছে। যে বছরগুলোতে এল নিনো সচল থাকে, সে বছর তাপমাত্রা বাড়ে।