গরমের তীব্রতায় প্রতিনিয়তই মারা যাচ্ছে গরু, কমে যাচ্ছে গরুর ওজন। ব্যাহত হচ্ছে দুধের উৎপাদন। অনেক স্থানে হঠাৎ গর্ভপাত হয়ে যাচ্ছে গাভির। বারবার গোসল করানো, টিনের চালে পাটের বস্তা রাখা, স্যালাইন ও গ্লুকোজ খাওয়ানো এবং পাখা চালিয়েও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না পরিস্থিতি। ডেইরি খাতের এমন বিপর্যয়ে ঈদুল আজহার আগে খামারিদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। তাদের লাভের স্বপ্ন এখন গুড়ে বালি। এমন দুর্দিনে খামারিদের পাশে নেই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয়ভাবে কিছু পরামর্শ দিয়ে দায় সারছে অধিদপ্তর।
৫৫ হাজারের বেশি খামারি বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সদস্য। বিডিএফএর তথ্য বলছে, এবার কোরবানি ঘিরে সারাদেশে ১ কোটি ২০ লাখের মতো পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে গরমে ১৫ দিনের ব্যবধানে ৯৯ শতাংশেরও বেশি পশুর ওজন কমে গেছে। গরু-মহিষের আকারভেদে ওজন কমেছে ৩০ থেকে ৭০ কেজি পর্যন্ত। প্রতিটি গরুর থেকে দুধের উৎপাদন কমেছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন খামারে গরম, লোডশেডিং ও বাদলা রোগে দুই হাজার গরু মারা গেছে। এক হাজারের বেশি গাভি সাত-আট মাসে গর্ভপাত করেছে। গরু সুস্থ রাখতে খামারগুলোতে খরচ বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ।
কেরানীগঞ্জের ফিড অ্যান্ড ফ্রেশ এগ্রোর কর্ণধার মো. আকবর আলম জানান, তার খামারে ৭০০ গরু আছে। এক মাস আগেও প্রতিদিন দুই হাজার লিটার দুধ পাওয়া যেত। এখন ১ হাজার ৮০০ লিটার উৎপাদন হচ্ছে। ওজন কমার বিষয়ে তিনি বলেন, রোজার সময় যে গরুর ওজন ছিল ১ হাজার ১২০ কেজি, সেই গরু গত পরশু দিন ওজন দেখলাম ১ হাজার ১১০ কেজি। এতদিনে গরুটির ওজন হওয়ার কথা ছিল ১ হাজার ২০০ কেজিরও বেশি। ১৫ দিনে ৬০-৭০ কেজি ওজন হারিয়ে ফেলেছে।
পাবনার বেড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান বলেন, কেন গরু মারা যাচ্ছে, তা পরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ গবেষণা কেন্দ্রের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। তাপপ্রবাহে করণীয় বিষয়ে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। নিয়মিত পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে একাধিক বৈঠকে। তবে উপজেলার চর নাকালিয়া, চর সাঁড়াশিয়া, হাটুরিয়া, নাকালিয়া, পেচাকোলার অনেক খামারি জানান, এ ধরনের কোনো লিফলেট কিংবা পরামর্শমূলক দিকনির্দেশনা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে তারা পাননি। উপজেলা প্রাণিসম্পদের সহযোগিতা না পেয়ে গ্রাম্য পশু চিকিৎসককে দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
চর সাঁড়াশিয়া গ্রামের খামারি আবদুস সাত্তার বলেন, গত ১৫ দিনে চর নাকালিয়া ও চর সাঁড়াশিয়া গ্রামে এক হাজারেরও বেশি গরু-ছাগল অজানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। গরুর শরীরে প্রথমে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও কাঁপুনি দেখা দেওয়ার পর খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে এক পর্যায়ে দুর্বল হয়ে মারা যায়। অনেক খামারি গরু-ছাগল আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কিত হয়ে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন।
গাইবান্ধায় তিন দিনে ১৩ গরুর মৃত্যু হয়েছে। জেলার উত্তর গিদারী গাছের ভিটা গ্রামের চাষি জোহা মিয়ার খামারের ছয়টি গরু মারা গেছে। বগুড়ার ধুনটের এলাঙ্গী ইউনিয়নের শৈলমারী গ্রামে অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮ কৃষকের ২৬টি গরু মারা গেছে। রংপুরে ১০ দিনে অন্তত ২০টি গরু মারা গেছে।
এমন বিপদেও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর খামারিদের পাশে নেই বলে অভিযোগ করেছেন পাঁচ জেলার অন্তত ১০ খামারি। তারা বলছেন, টাকা ছাড়া মেলে না ওষুধ ও চিকিৎসা। চুয়াডাঙ্গার খামারি আবদুল লতিফ বলেন, আগে গরু অসুস্থ হলে ভেটেরিনারি চিকিৎসক মোটরসাইকেলে খামারে আসতেন। তখন তাঁকে ৫০০ টাকা দিলেই হতো। এখন ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিকের নামে একটি বড় গাড়ি খামারে আসে। এতে খরচ হয় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা। অথচ এ সেবা বিনামূল্যে দেওয়ার কথা ছিল।
বিডিএফএ সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ঈদ ঘিরে সব খামারি গরু মোটাতাজা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অথচ গরমের তীব্রতায় গরু-মহিষ খাবার কমিয়ে দিয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শুকিয়ে যাচ্ছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হলিস্টিন ফ্রিজিয়ান জাতের গরু। এক হাজারেরও বেশি গরুর সাত-আট মাসে গর্ভপাত হয়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা খামারিদের জন্য খুব কঠিন। আধুনিক খামারিরা আগেভাগে প্রস্তুতি নিলেও প্রান্তিক খামারিদের অধিকাংশই জানেন না, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। অন্যদিকে গরু সুস্থ রাখতে খামারগুলোতে খরচ বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, তাপপ্রবাহকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এগুলো মোকাবিলা করতে আমরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলে সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছি। তারা খামারিদের সহায়তা করছেন। ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হচ্ছে। কাজে কেউ গাফিলতি করলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।