ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে নির্মূলের কথা বলে ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় চলতে থাকা জায়নবাদী আগ্রাসনে ৩৪ হাজারের বেশি প্রাণহানির পরও হামাস এখনো সেখানে টিকে রয়েছে। ইসরায়েল অবশ্য এখন রাফাহ শহরকে হামাসের চূড়ান্ত নির্মূলের অন্তরায় হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সমাধান না করে হামাসকে নিঃশেষ করা বস্তুত সম্ভবই নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার ‘স্ট্র্যাটেজিক কনসালটিভ গ্রুপ’ চলতি মাসের শুরুতে বৈঠক হয়েছে। সেখানে রাফাহ শহরে সম্ভাব্য অভিযানের কথা তুলে ধরে তেল আবিব।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ফিলিস্তিনিদের ওপর নানা জায়গায় দশকের পর দশক ধরে চলা আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে যখন রাজনৈতিক সমাধানের সংকট তৈরি হয়েছে, সেই চাহিদা মেটাতে গিয়ে তৈরি হয় হামাস। গাজা থেকে ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ)’-এর মোড়কে চলা শাসনকে উচ্ছেদ করে তারাই এখন গাজার নিয়ন্ত্রক। পিএ প্রশাসনে ফাতাহর প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকা- এবং আপসকামী মনোভাব হামাসের জনপ্রিয়তাকে বৃদ্ধি করেছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার মাধ্যমে তারা আরও একবার নিজেদের অনড় স্বাধীনতাকামী অবস্থান জানান দিয়েছে। যুদ্ধের এতদিনেও হামাসের প্রভাব একেবারে বিলীন হয়নি।
এ পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করেছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক ‘রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ’-এর বিশ্লেষক এইচএ হ্যালেয়ার বলেন, ‘হামাস বলতে চায়, কেউ তাদের স্পর্শই করতে পারেনি। আবার ইসরায়েলিরা বলছে, তারা তাদের উদ্দেশ্যে সফল। এ প্রেক্ষাপটে দুপক্ষের তরফ থেকে ব্যাপক ভুয়া প্রচার রয়েছে।’ ইসরায়েলের তরফ থেকে গাজায় হামাসের গুরুতর ক্ষতিসাধনের সাফল্য প্রচার করা হচ্ছে। ইসরায়েলি বিশ্লেষকরাও এ বিষয়ে আশাবাদী। ‘ইসরায়েলি ইনস্টিটিউট ফর রিজিওনাল ফরেন পলিসি’-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গিল মুচিয়ানো মনে করেন, বছরের পর বছর ধরে গাজা শহরকে কেন্দ্র করে ক্ষেপণাস্ত্রসহ অস্ত্রশস্ত্র তৈরির যে ক্ষমতা অর্জন করেছিল, তা ধ্বংস হয়েছে।
তেল আবিব ইউনিভার্সিটির গবেষক মাইকেল মিলসটেইনও মনে করেন, গাজায় হামাসের শক্তিক্ষয় হয়েছে ৭০ শতাংশের আশপাশে। এ ছাড়া হামাসের সুড়ঙ্গ যোগাযোগ কমপক্ষে অর্ধেকই ধ্বংস হয়েছে।
দীর্ঘ যুদ্ধ কবে থামবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। গত কয়েক দিন থেকে শোনা যাচ্ছে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার লাখ লাখ মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র রাফাহ শহরের অভিযানের ব্যাপারে আবার ভাবনাচিন্তা করছেন। শেষ পর্যন্ত রাফাহ শহরে ইসরায়েলি অভিযান হলে, তা ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানিকে আরও বাড়াবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দশকের পর দশক থেকে রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া ফিলিস্তিন সংকট জিইয়ে রাখলে এবং হামাসকে সামরিকভাবে কাবু করলে ইসরায়েল রাষ্ট্র নিরাপদ হবে, বিষয়টি এমন নয়।
এ বিষয়ে একজন ইসরায়েলি তাত্ত্বিকেরও মনোভাবও তেমনই। ‘ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ’-এর বিশ্লেষক কোরিব মিকাইল বলেন, হামাসের যোদ্ধাসংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেলেও, ‘সংগঠনটি রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকবে’। বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, হামাস যোদ্ধা হারালেও, তারা শিগগিরই সেই জায়গা পূরণ করতে পারবে। কারণ হামাসের টিকে থাকার জ্বালানি হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক সংকট।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএএন হামাস নেতাদের মনোভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য বাসেম নাইম গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে ধরে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে, শরণার্থীদের নিজ ভূমিতে ফিরে আসার অধিকার সুরক্ষিত করলে হামাস অস্ত্র পরিত্যাগ করবে।’ তিনি স্পষ্ট করে জানান, ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের যেসব ভূমির দখল করেছে, সেগুলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলে যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হামাস।