হঠাৎ করে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। গত ১৬ ডিসেম্বর বেসরকারি একটি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। সেখানে তার একটি বক্তব্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সব চেষ্টাই করা হয়েছে-এই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি সেদিন বলেছিলেন, “তারা যদি নির্বাচনে আসে, তবে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে- এমন কথা নির্বাচন কমিশন থেকে তাদের বারবার বলা হয়েছে। শুধু পিছিয়ে দেওয়া না, বলা হয়েছিল যে, সবাইকে জেল থেকে মুক্ত করা হবে।”
কৃষিমন্ত্রীর উক্ত বক্তব্যের পর সবাই বলতে শুরু করেন, তার মানে- বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা রাজনৈতিক। রাজনৈতিক কারণেই তাদের জেলে নেওয়া হয়েছে। সমালোচনার তীর এতোটাই বিদ্ধ করে যে দুদিন বাদেই কৃষিমন্ত্রী নিজ বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে বলেন, “নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অর্থ কী? বিএনপি যদি রাজি হয়, তাহলে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। তিনি সেই কথাটিই বলেছেন।”
এরপর পদ্মা-মেঘনায় অনেক জল গড়িয়েছে। ০৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখে আওয়ামী লীগ ভূমিধ্বস জয় পেয়ে সরকার গঠন করেছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকেই, বিশেষ করে সিনিয়র নেতাদের অনেকেই কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেছেন। নির্বাচনের পর মাস দুয়েক রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা ছিল মূলত: নির্বাচনটি বৈধ নাকি অবৈধ হয়েছে তা নিয়ে।
কিন্তু, সম্প্রতি সে জায়গা দখল করে নিয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা এবং তাদের কারাগারে প্রেরণের বিষয়টি। তবে, লক্ষণীয় যে, অতি সম্প্রতি এ নিয়ে আলোচনা শুরু করছেন খোদ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাই!
‘এ সরকারের আমলে বিএনপির ৮০ ভাগ নেতাকর্মী নিগৃহীত হয়েছে’- বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে গত ২৯ মার্চ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চান।
এর আগে ঢাকায় দলীয় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব দাবি করেন, তার দলের ৮০ শতাংশ মানুষ নিপীড়নের শিকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, “এ সরকারের আমলে বিএনপির ৮০ ভাগ নেতাকর্মী নাকি নিগৃহীত হয়েছে। আমি মির্জা ফখরুলকে বলব, এসব মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকুন। ৮০ ভাগ নেতাকর্মীরা কারা? আমির খসরু, মির্জা ফখরুল একে একে জেল থেকে বের হয়ে গেছেন। তাহলে নিগৃহীত কে হচ্ছে? তাদের তালিকা প্রকাশ্যে দিতে হবে।”
এরপর ১৫ এপ্রিল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বিএনপির কাছে দলটির দাবি করা ‘জেলে থাকা ৬০ লাখ নেতাকর্মী’র তালিকা চেয়ে বলেন, “তাদের জেলে থাকা ৬০ লাখ লোকের তালিকা দিতে হবে। এই তালিকা আমরা দেখতে চাই। না হয় এই মিথ্যা বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে বিএনপিকে। ৬০ লাখ লোকের তালিকা চাই। একটা সময় তারা বলেছে, ২০ হাজার। এখন সেটা ৬০ লাখ হলো কী করে? ৬০ লাখ বন্দির তালিকা অবিলম্বে প্রকাশ করুক। না হয় মিথ্যাচারের জন্য জাতির কাছে মির্জা ফখরুলকে ক্ষমা চাইতে হবে।”
তারপর, বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) এক বিবৃতিতে ওবায়দুল কাদের বলেন, “বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতৃবৃন্দ লাগাতারভাবে মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। একদিকে তারা আগুন- সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করছে অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বিরোধীদল দমনের মিথ্যা অভিযোগ উপস্থাপন করছে।”
সরকার বেপরোয়াভাবে কাউকে কারাগারে পাঠাচ্ছে না উল্লেখ করে বিবৃতিতে তিনি বলেন, “সন্ত্রাস ও সহিংসতার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএনপির নেতাকর্মীরা আইন ও আদালতের মুখোমুখি হচ্ছে এবং জামিনে মুক্তিও পাচ্ছে। তবে যারা নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে- জনগণের জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি করেছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে সেসব সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদারদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা ও মহামান্য আদালত যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। বিএনপি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। সে কারণে বিএনপি নেতারা বিরোধী দল দমনের মিথ্যা অভিযোগ তুলে সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দেওয়ার অপচেষ্টা করছে।”
এদিকে, শুক্তবার (১৯ এপ্রিল) গণভবনে কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ‘বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোনো মামলাই রাজনৈতিক নয়’ দাবি করে বলেছেন, অগ্নিসংযোগ, গ্রেনেড হামলা, আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান ও দুর্নীতির মতো সুনির্দিষ্ট ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তরাই এ সংক্রান্ত মামলার আসামি হয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘আজকে তারা (বিএনপি) সব জায়গায় কান্নাকাটি করে বলছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা। তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে মামলাগুলো কিসের মামলা? অগ্নিসন্ত্রাস, অস্ত্র পাচার, গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন অপরাধের মামলা। তারা অপরাধ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেটিই তো বাস্তবতা।’ এসব মামলা দ্রুত শেষ করে দোষীদের শাস্তি দিয়ে দেয়া উচিত বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওদের বিরুদ্ধে কোনো মামলাই রাজনৈতিক মামলা না, সবগুলো অগ্নিসন্ত্রাসের মামলা। তারা আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। নির্বাচন ঠেকাতে যেয়ে রেলে আগুন দিয়ে মা-শিশুকে পুড়িয়ে মেরেছে, যারা এগুলো করল তাদের বিরুদ্ধে কি মামলা হবে না? তাদেরকে কি মানুষ পূজা করবে? সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।