নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার নাম শুনলেই বলেন- আমি সুদখোর। এমন সব শব্দ ব্যবহার করেন তাতে মনে হয় আমার সম্পর্কে তার ধারণা খুবই খারাপ। শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে ‘ডয়েচে ভেলে খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীনের এক প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে দেশের সর্বোচ্চ ডাকু, সন্ত্রাসী কিংবা অপরাধী অথবা আমি সেরা চোর মনে করেন। এ জাতীয় জিনিস তিনি মনে করেন। এগুলো ভেবেই তিনি তার মতামত দেন।
শ্রম আদালতের রায় ঘোষণার পর গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান ড. ইউনূস। এই প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও আলোচনা হয় অনুষ্ঠানে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কেউ গণতন্ত্রের বিপক্ষে নই। আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে, মনবাধিকারের পক্ষে, ন্যায়নীতির পক্ষে এটি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়া। এগুলো না থাকলে জাতি হিসেবে আমরা টিকে থাকবো না। এগুলো মুখফুটে বলতে হবে। আমার মনে হয় এগুলো সবারই মনের কথা।
তিনি আরও বলেন, আমি গণতন্ত্রের কথা বলি হয়তো মানুষ এটা চায়। এতে তাদের মধ্যে একটা সাহস আসবে যে আমি বলছি তাই তাদেরও বলতে হবে। তারাও বলতে পারবে।
গণতন্ত্র এবং মনবাধিকারের পক্ষে এক কণ্ঠে এখন কেউ কথা বলতে পারছে না জানিয়ে তিনি বলেন, আমার মনে হয় না মানুষ মুখ ফুটে গণতন্ত্র এবং মনবাধিকারের পক্ষে এক কণ্ঠে কথা বলতে পারছে। এক বাক্যে বা পরিষ্কার কণ্ঠে গণতন্ত্রের কথা বলা আমাদের দায়িত্ব। তা না হলে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকবে না।
অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে অনেক কাজ করেছেন ড. ইউনূস। তবে বর্তমানে দলটির সঙ্গে সম্পর্কে কোনো ঘটতি থাকলে সেটি কি করণে হতে পারে এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে নোবেলজয়ী এ অর্থনীতিবিদ বলেন, যাই হোক এটি আমার তরফ থেকে হয়নি। আমি তাকে শ্রদ্ধা করে ওয়াশিংটন ডিসিতে আমাদের মাইক্রো ক্রেডিট সামিটে প্রধান অতিথি করে নিয়ে গিয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, এই মাইক্রো ক্রেডিটটা পৃথিবীর সবার সামনে এসেছে। বড় আকারে এসেছে এবং এটি বাংলাদেশের অবদান হিসেবে সবাই স্বীকৃতি দিচ্ছে। সেই অনুষ্ঠানে পৃথিবীর সেরারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের এই গৌরবটা তিনি যেনো আমাদের পক্ষ থেকে গ্রহণ করেন। তিনি রাজি হয়েছিলেন। তিনি গেছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই সম্পর্ক থেকে যাবার কথা ছিল। তবে কি কারণে এই সম্পর্ক ঘাটতি শুরু হলো এটা বুঝতে পারিনি। এর কিছুদিন পর থেকে তার আচরণ বা কথাবার্তার পরিবর্তন হতে শুরু করলো এবং তা এমনভাবে পরিবর্তন হলো এখন আমাকে চোর ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না।
২০০৭ সালের ওয়ান ইলাভেনের সময়ে ক্ষমতা দখল বা বিরাজনীতিকরণ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ওয়ান ইলাভেনের সময়ে মিলিটারিরা আমার বাসায় সারারাত বসে ছিল। আমাকে রাজি করার জন্য। যদি ক্ষমতা চাইতাম তাহলে সেই রাতে আমি তাদের বলতাম চলেন, কি করতে হবে বলেন, কোন জামা পড়বো। কিন্তু আমি তো সেটা করিনি। তাদের সঙ্গে তর্ক করেছি।
তিনি বলেন, আমি মিলিটারিদের বলেছি- আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েন না। আমি এই কাজের জন্য উপযুক্ত নই। আপনারা অন্য লোক খুঁজেন। কিন্তু মিলিটারিরা তাদের মন ঠিক করে রেখেছে যে দায়িত্ব আমাকেই দিবে। কিন্তু পরে তারা নিরাশ হয়ে ফিরে গেলো। তবে যাবার আগে বলে গেছে- তারা সকালে আবার আসবে এবং তখন যেনো তাদের বলি আমি রাজি। কিন্তু আমি তাদের বলেছি। সকালে এলেও একই উত্তর পাবেন। কারণ এটা তো এমন কিছু না যে মনের মধ্যে সন্দেহ রেখে বা দ্বন্দ্ব রেখে না করছি। পরিষ্কারভাবেই তাদের না করেছি।
ড. ইউনূস বলেন, দেশের সরকারের প্রধান হবার জন্য অফার করা হচ্ছে এই সুযোগ কে ছাড়ে? কিন্তু আমি তো ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমার নামে বলা হচ্ছে ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা প্রকাশের কথা। বছর নিয়ে তো কোনো প্রশ্নই উঠার কথা নয়। আমি বলেছি, এই কাজের জন্য আমি নই। দেশ পরিচালনা করা আমার দায়িত্ব না। আমি জানি না এটা কিভাবে পরিচালনা করতে হয়। আমি যেটা জানি সেটা করি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস একসঙ্গে কাজ করার বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক এক সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মেয়ে মনিকা ইউনূস।
মেয়ের সেই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমাকে যেখানে চোর বানিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে একসঙ্গে কাজ করার প্রশ্নই উঠছে না। আমার নাম উঠলেই তার রাগ উঠে যায়। আমাকে সুদখোর না বললে তার মন তৃপ্ত হয় না। পদ্মা নদীতে আমাকে না চুবালে তার মনে শান্তি আসে না। তাহলে তার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে আমি কি করে বলবো। বলতে তো হবে তাকে, যদি কিছু বলতে হয়।