ঢাকা ১০:৫৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সিরাজগঞ্জে একই পরিবারের ৩ জনকে গলা কেটে হত্যার রহস্য উন্মোচন

সিরাজগঞ্জে একই পরিবারের ৩ জনকে গলা কেটে হত্যার রহস্য উন্মোচন হয়েছে। ভাগনে রাজীব কুমার ভৌমিকের (৩৫) সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল মামা বিকাশ সরকারের (৪৫)। এর জের ধরেই শুরু হয় মনোমালিন্য। টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে মামার বাসায় যান ভাগনে রাজীব। এরপর একে একে মামাতো বোন, মামি ও মামাকে হত্যা করেন রাজীব।

বুধবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেলে সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে প্রেস কনফারেন্সে এসব কথা জানান পুলিশ সুপার মো. আরিফুর রহমান মন্ডল।

এর আগে গতকাল মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুরে তাড়াশ উপজেলা থেকে বিকাশের ভাগনে রাজীব কুমার ভৌমিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাজীব সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের মৃত বিশ্বনাথ ও নিহত বিকাশের বড় বোন প্রমীলা রানির ছেলে। আগের দিন যখন বিকাশ এবং তার স্ত্রী ও মেয়ের খোঁজ মিলছিল না তখন তার মাসতুতো ভাই ও পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাকর্মীদের সঙ্গে রিপোর্ট করতে থানাতেও যান রাজীব।

পুলিশ সুপার বলেন, আসামিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, হত্যাকারী রাজীব কুমার ভৌমিক বিকাশ চন্দ্র সরকারের বড় বোন প্রমীলা রানির ছেলে। রাজীবরে বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে ২০২১ সালে মামা বিকাশ চন্দ্র সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে খাদ্যশস্য কেনাবেচার ব্যবসায় যুক্ত হন রাজীব। বিকাশ চন্দ্র সরকার তার ভাগনে রাজীর কুমার ভৌমিককে ব্যবসার পুঁজি হিসেবে ২০ লাখ টাকা দেন। এরপর ব্যবসা চলমান থাকাকালীন রাজীব কুমার ভৌমিক তার মামাকে বিভিন্ন ধাপে ব্যবসার লভ্যাংশসহ প্রায় ২৬ লাখ টাকা ফেরত দিলেও চলতি বছর এসে রাজীবের কাছে তার মামা বিকাশ চন্দ্র সরকার আরও ৩৫ লাখ টাকা দাবি করেন।

এরপর বিকাশ চন্দ্র সরকার গত ২২ জানুয়ারি দাবিকৃত টাকা ৭-৮ দিনের মধ্যে ফেরত দেওয়ার জন্য ভাগনে রাজীবকে অনেক চাপ দেন এবং টাকার জন্য রাজীবের মাকেও ফোনে অনেক বকাবকি করেন। রাজীব কুমার ভৌমিক টাকা ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং মামার বকাবকিতে মনঃকষ্ট পাওয়ায় তার মামাসহ পুরো পরিবারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

এরপর গত শনিবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেল ৪টা ৪৮ মিনিটে মামাকে ফোন করে পাওনা টাকা নিয়ে বাসায় আসতে চান রাজীব। বিকাশ চন্দ্র সরকার তাড়াশ উপজেলার বাইরে থাকায় তার ভাগনেকে টাকা নিয়ে সরাসরি তার তাড়াশের বাসায় গিয়ে মামির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাসাতেই থাকতে বলেন।

পুলিশ সুপার বলেন, রাজীব যখন বাসায় যান তখন তার মামি সন্ধ্যাপূজা করছিলেন। রাজীব বাসায় তার মামার অনুপস্থিতির সুযোগে তার মামি এবং মামাতো বোন তুষিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। একপর্যায়ে রাজীবকে কফি খাওয়ানোর জন্য তার মামি পূজা শেষে বাসার নিচে দোকানে কফির প্যাকেট কিনতে গেলে রাজীব ব্যাগে করে রাস্তা থেকে ২৫০ টাকা দিয়ে কিনে আনা লোহার রড দিয়ে তার মামাতো বোনের মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করে। এতে তুষি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এরমধ্যে তার মামি কফি কিনে বাসায় প্রবেশ করলে মামিকেও একইভাবে রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে রাজীব। মামি এবং মামাতো বোন তুষিকে মারধরের পর রাজীব চলে যেতে চায়। কিন্তু এর মধ্যেই তার মামা বাসায় ঢুকলে মামাকেও প্রথমে রড দিয়ে আঘাত করে রাজীব।

এরপর তার মামাকে গলাকেটে হত্যা নিশ্চিতের পর মরদেহ টেনে বেডরুমে নিয়ে যান। এর মধ্যে তার মামি ও মামাতো বোনের গোঙানির শব্দ পেলে তাদেরকেও গলাকেটে হত্যা নিশ্চিত করে বাইরে তালা দিয়ে চলে যায় রাজীব। যাওয়ার পথে তিনি লোহার রড একটি পুকুরে ফেলে দেন এবং রক্তমাখা হাসুয়াসহ ব্যাগটি নিজ বাড়িতে নিয়ে যান।

পুলিশ সুপার আরও বলেন, আমরা বিকাশের ফোনের একটি কল রেকর্ড থেকে প্রথম সূত্র পাই। এরপর তথ্যপ্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পরে রাজীবকে গ্রেপ্তার করি। এরপর রাজীব আমাদের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে। তবে এটাই সত্য যে রাজীব একাই তিনজনকে হত্যা করে। এরপরও আমরা সবকিছু যাচাই-বাছাই করছি। তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

প্রেস কনফারেন্সে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. সামিউল আলম, উল্লাপাড়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার অমৃত কুমার সূত্রধর, জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) শাখার ওসি জুলহাজ উদ্দীন, তাড়াশ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নজরুল ইসলামসহ জেলা পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

সিরাজগঞ্জে একই পরিবারের ৩ জনকে গলা কেটে হত্যার রহস্য উন্মোচন

আপডেট সময় ০৬:২৯:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৪

সিরাজগঞ্জে একই পরিবারের ৩ জনকে গলা কেটে হত্যার রহস্য উন্মোচন হয়েছে। ভাগনে রাজীব কুমার ভৌমিকের (৩৫) সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল মামা বিকাশ সরকারের (৪৫)। এর জের ধরেই শুরু হয় মনোমালিন্য। টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে মামার বাসায় যান ভাগনে রাজীব। এরপর একে একে মামাতো বোন, মামি ও মামাকে হত্যা করেন রাজীব।

বুধবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেলে সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে প্রেস কনফারেন্সে এসব কথা জানান পুলিশ সুপার মো. আরিফুর রহমান মন্ডল।

এর আগে গতকাল মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুরে তাড়াশ উপজেলা থেকে বিকাশের ভাগনে রাজীব কুমার ভৌমিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাজীব সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের মৃত বিশ্বনাথ ও নিহত বিকাশের বড় বোন প্রমীলা রানির ছেলে। আগের দিন যখন বিকাশ এবং তার স্ত্রী ও মেয়ের খোঁজ মিলছিল না তখন তার মাসতুতো ভাই ও পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাকর্মীদের সঙ্গে রিপোর্ট করতে থানাতেও যান রাজীব।

পুলিশ সুপার বলেন, আসামিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, হত্যাকারী রাজীব কুমার ভৌমিক বিকাশ চন্দ্র সরকারের বড় বোন প্রমীলা রানির ছেলে। রাজীবরে বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে ২০২১ সালে মামা বিকাশ চন্দ্র সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে খাদ্যশস্য কেনাবেচার ব্যবসায় যুক্ত হন রাজীব। বিকাশ চন্দ্র সরকার তার ভাগনে রাজীর কুমার ভৌমিককে ব্যবসার পুঁজি হিসেবে ২০ লাখ টাকা দেন। এরপর ব্যবসা চলমান থাকাকালীন রাজীব কুমার ভৌমিক তার মামাকে বিভিন্ন ধাপে ব্যবসার লভ্যাংশসহ প্রায় ২৬ লাখ টাকা ফেরত দিলেও চলতি বছর এসে রাজীবের কাছে তার মামা বিকাশ চন্দ্র সরকার আরও ৩৫ লাখ টাকা দাবি করেন।

এরপর বিকাশ চন্দ্র সরকার গত ২২ জানুয়ারি দাবিকৃত টাকা ৭-৮ দিনের মধ্যে ফেরত দেওয়ার জন্য ভাগনে রাজীবকে অনেক চাপ দেন এবং টাকার জন্য রাজীবের মাকেও ফোনে অনেক বকাবকি করেন। রাজীব কুমার ভৌমিক টাকা ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং মামার বকাবকিতে মনঃকষ্ট পাওয়ায় তার মামাসহ পুরো পরিবারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

এরপর গত শনিবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেল ৪টা ৪৮ মিনিটে মামাকে ফোন করে পাওনা টাকা নিয়ে বাসায় আসতে চান রাজীব। বিকাশ চন্দ্র সরকার তাড়াশ উপজেলার বাইরে থাকায় তার ভাগনেকে টাকা নিয়ে সরাসরি তার তাড়াশের বাসায় গিয়ে মামির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাসাতেই থাকতে বলেন।

পুলিশ সুপার বলেন, রাজীব যখন বাসায় যান তখন তার মামি সন্ধ্যাপূজা করছিলেন। রাজীব বাসায় তার মামার অনুপস্থিতির সুযোগে তার মামি এবং মামাতো বোন তুষিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। একপর্যায়ে রাজীবকে কফি খাওয়ানোর জন্য তার মামি পূজা শেষে বাসার নিচে দোকানে কফির প্যাকেট কিনতে গেলে রাজীব ব্যাগে করে রাস্তা থেকে ২৫০ টাকা দিয়ে কিনে আনা লোহার রড দিয়ে তার মামাতো বোনের মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করে। এতে তুষি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এরমধ্যে তার মামি কফি কিনে বাসায় প্রবেশ করলে মামিকেও একইভাবে রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে রাজীব। মামি এবং মামাতো বোন তুষিকে মারধরের পর রাজীব চলে যেতে চায়। কিন্তু এর মধ্যেই তার মামা বাসায় ঢুকলে মামাকেও প্রথমে রড দিয়ে আঘাত করে রাজীব।

এরপর তার মামাকে গলাকেটে হত্যা নিশ্চিতের পর মরদেহ টেনে বেডরুমে নিয়ে যান। এর মধ্যে তার মামি ও মামাতো বোনের গোঙানির শব্দ পেলে তাদেরকেও গলাকেটে হত্যা নিশ্চিত করে বাইরে তালা দিয়ে চলে যায় রাজীব। যাওয়ার পথে তিনি লোহার রড একটি পুকুরে ফেলে দেন এবং রক্তমাখা হাসুয়াসহ ব্যাগটি নিজ বাড়িতে নিয়ে যান।

পুলিশ সুপার আরও বলেন, আমরা বিকাশের ফোনের একটি কল রেকর্ড থেকে প্রথম সূত্র পাই। এরপর তথ্যপ্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পরে রাজীবকে গ্রেপ্তার করি। এরপর রাজীব আমাদের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে। তবে এটাই সত্য যে রাজীব একাই তিনজনকে হত্যা করে। এরপরও আমরা সবকিছু যাচাই-বাছাই করছি। তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

প্রেস কনফারেন্সে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. সামিউল আলম, উল্লাপাড়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার অমৃত কুমার সূত্রধর, জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) শাখার ওসি জুলহাজ উদ্দীন, তাড়াশ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নজরুল ইসলামসহ জেলা পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।